ইতালি ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। যেখানে প্রায় ১৬ লাখ মুসলমানের বসবাস, যার মধ্যে বাংলাদেশি মুসলমান রয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার। তবে উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, গোটা ইতালিতে এত সংখ্যক মুসলমানের অবস্থান থাকা স্বত্বেও দেশটিতে মসজিদের সংখ্যা মাত্র আটটি!
তুলনামূলকভাবে, ফ্রান্স, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ইতালির চেয়ে তিন থেকে চারগুণ বেশি, সেখানে দুই হাজার দুইশো মসজিদ রয়েছে। যেখানে যুক্তরাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ইতালির চেয়ে দ্বিগুণ, সেখানে রয়েছে পনেরোশো মসজিদ।
পদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান গবেষক মারিয়া বোম্বার্ডিয়ার মতে, প্রাতিষ্ঠানিক এই আটটি মসজিদের বাইরে ইতালিতে প্রায় ৮০০ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং মুসাল্লা রয়েছে, যেগুলোকে অনানুষ্ঠানিকভাবে গ্যারেজ, বেসমেন্ট এবং গুদামঘরের মতো জায়গায় নামাজের স্থান এবং সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত মিলনস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে মসজিদের অভাব বিভিন্ন কারণে হতে পারে। প্রথমত, ইতালি ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দেয়, ধর্মীয় ছুটির দিন পালন করাসহ কর অনুদানের মাধ্যমে জনসাধারণের অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
অনেক সময় মসজিদের জন্য তহবিল পাওয়া গেলেও, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মসজিদ খোলার অনুমতি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়গুলি প্রায়ই নির্মাণের বিরোধিতা করে। বোম্বার্ডিয়ার বলেন, ‘যখন একটি মসজিদ নির্মাণের সুযোগ আসে, তখন মুসলিম সম্প্রদায়গুলো মিনার এবং গম্বুজের মতো স্বতন্ত্র স্থাপত্য উপাদান এড়িয়ে চলতে থাকে, যাতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়।
মসজিদ বন্ধের জন্য অতীতে ইতালি সরকারের অনেকগুলি প্রচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরোধিতার কারণে অনেক মসজিদ নির্মাণ বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে লেগা নর্ড রাজনৈতিক দলটি একটি নতুন বিল প্রবর্তন করেছিল বলে জানা যায়। যার ফলে দেশের অনেক জায়গায় নতুন মসজিদ নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়। তখন এই যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, মুসলমানরা যে কোন জায়গায় নামাজ পড়তে পারে এবং মসজিদের প্রয়োজন নেই। পরবর্তীতে অবশ্য বিলটি অনুমোদিত হয়নি।
বোম্বার্ডিয়ার এর মতে, ‘মুসলিম সম্প্রদায়গুলি মসজিদ নির্মাণের জন্য বিদেশি তহবিলের উপর নির্ভর করার কারণে (সৌদি আরব রোমের মসজিদকে অর্থায়ন করেছে এবং কাতার ইতালিতে মুসলিম প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অর্থদাতা) কট্টর মৌলবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রভাব থাকার ঝুঁকি থেকে যায়।
বোম্বার্ডিয়ার ব্যাখ্যা করেছেন, ইতালি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় বহুত্ববাদী চিন্তায় অনন্য অবস্থানে রয়েছে । এখানে ইসলামী সম্প্রদায় মূলত সাম্প্রতিক সময়ে আগত অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত, যার কোনটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
ঐতিহ্যগতভাবে, ইতালিয়ানদের সিংহভাগই ক্যাথলিক। এর বাইরে ইতালিতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ রয়েছেন যারা ধর্মহীন, অ-খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত, তাদের সংখ্যা ১ শতাংশ। যদিও গত দুই দশকে অভিবাসীরা ইতালীয় একক সাংস্কৃতিক প্রথাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
ইতালির অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, আশির দশকের শেষের দিকে অভিবাসন নিয়ে এত উচ্চবাচ্য ছিল না। ১৯৮১ সালে ইতালি একটি কাঠামোগত অভিবাসন কর্মসূচি চালু করার আগ পর্যন্ত দেশটির একটি ‘উন্মুক্ত সীমানা নীতি’ ছিল।
ইতালিতে এখন প্রতি তিনজন অভিবাসীর মধ্যে একজন মুসলিম, যা জনসংখ্যার প্রায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইতালির রোমে অবস্থিত পালেরমোর মসজিদের ইমাম আবদার রাহমান মুস্তাফি। তিনি বলেন, এখানকার মুসলমান সম্প্রদায় মূলত ৩৪ টি দেশের মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। পালেরমো মসজিদ ১৯৮৯ সালে উন্মুক্ত হয়েছিল, তিনি ২০০৯ সাল থেকে সেখানে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মুসলমানদের পাশাপাশি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের জন্য সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
মুস্তাফি বলেন, সিসিলি ৮২৭ থকে ১০৭২ সাল পর্যন্ত আরব শাসনের অধীনে ছিল। যেকারণে ইসলাম ইতালির ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। পারিবারিক নামগুলিতেও এখন অব্দি ইসলামিক আধিপত্য রয়েছে। মুস্তাফি বলেন, ‘ক্রমবর্ধমানভাবে ইতালিয়ানদের ‘এই ধরনের প্রথা এখনও বিদ্যমান আছে দেখে আমার গর্ব হয়।’
মুস্তাফি যোগ করেন, যদিও ইতালিতে মুসলমানদের প্রতি অনেক নেতিবাচকতা রয়েছে কিন্তু সংহতির মাধ্যমে তিনি এই বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, কোয়ার্টজ