বৈদেশিক কর্মসংস্থানে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

0
730
A group of people who has lost their lands by river erosion, sit at a village, by the Brhammaputra river. Bangladesh. (Photo by: Majority World/Universal Images Group via Getty Images)

বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ কতোটা ভূক্তভোগী তা বলার অপেক্ষা রাখে না, যদিও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের দায় মাত্র দশমিক ৪৭ শতাংশ । অথচ উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ও ওজন গ্যাস নিঃসরণের দরুন প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করছি আমরা।

বিশেষত কৃষি ও মৎস্য ক্ষেত্রে নির্ভরশীল জীবন ও জীবিকা আজ হুমকির সম্মুখীন। অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ও শৈত্যপ্রবাহ বিগত ৩০ বছরের চেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে, যার ভূক্তভোগী হয়েছে দক্ষিণাঞ্চল হতে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী।

ঋতু পরিবর্তনের পাশাপাশি কৃষি জমিতে সমুদ্রের নোনা পানি প্রবেশ করায়, প্রতিবছরই চাষ উপযোগিতা হারাচ্ছে বিপুল পরিমান জমি। যার ফলে তৈরি হচ্ছে কৃষি জমির সংকট । সেই সঙ্গে বারবার সংঘটিত বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের তাণ্ডবে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কৃষিকাজ ।

সাম্প্রতি, বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এক কোটি ৮০ লক্ষের অধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি নির্ভর জনগোষ্ঠী এর সরাসরি ভূক্তভোগী ।

 ফলে এই সকল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা খাপ খাওয়াতে বা অভিযোজন করতে পারছে না, তারা বেকার হয়ে যাচ্ছেন। কৃষিতে কর্মসংস্থানের এই সীমাবদ্ধতা বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে নগরমুখী করছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মহীন, বেকার জনগোষ্ঠী, বাড়ছে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের চাপ। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই জলবায়ু বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছেছে ৬০ লাখে।

এই বিপুল কর্মহীন জনগোষ্ঠীর অনেকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমান। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অভিবাসনেওে যুক্ত হচ্ছেন তারা। যদিও বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরাসরি ভূক্তভোগী জেলা হতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রবণতা কম। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিএমইটির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বাগেরহাট থেকে ৪০ হাজার ৩ শত ৫৮ জন, সাতক্ষীরা থেকে ৩৯ হাজার ৮ শত ১০ জন ও খুলনা থেকে ৩৮ হাজার ৯ শত ৭৫ জন এখন পর্যন্ত বৈদেশিক কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন।

কিন্তু এই সকল অঞ্চল থেকে ঢাকা বা অন্য মেগা সিটিতে অভ্যন্তরীণভাবে অভিবাসিত হওয়ার হার অনেক বেশি। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর ২২ লক্ষের অধিক নবীন শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। যেখানে আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে গড়ে ৮-১০ লক্ষ মানুষের । তার উপরে যদি জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন উদ্বাস্তু ও বেকার জনগোষ্ঠী এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে পরিস্থিতির ভয়াবহতা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান না করতে পারলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, মুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে পিষ্ট হতে হবে বাংলাদেশকে । তাই এক্ষেত্রে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ছাড়া আর বিকল্প থাকে না আমাদের হাতে । কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, আমাদের মতো অনেক দেশ আছে- যারা একই সমস্যায় জর্জরিত। নিশ্চয়ই তারাও খুঁজছে বিকল্প কর্মসংস্থান বা অভিবাসনের সুযোগ।

তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের দ্বারা দক্ষ কর্মী তৈরি করা। সেই সঙ্গে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নিত্য নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়াতে হবে।

গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন ‘কপ-২৬’ এ জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ একত্র হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি মোকাবেলার কর্মপরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণের জন্য। বাংলাদেশ সেখানে বলিষ্ঠ ভাষায় প্রতিনিধিত্ব করেছে সকল ভূক্তভোগী দেশের, তুলে ধরেছে আসন্ন সংকট মোকাবেলার কৌশল।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্কটিশ পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে, বিশ্বকে জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আশা করছি, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো সুদুরপ্রসারী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জলবায়ু অভিবাসীদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান যুক্ত করা গেলে এক দিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের উপর চাপ কমবে।

জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে অধিক কার্বন উৎপাদনকারী দেশের উপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে বাংলাদেশকে। চলমান জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু তহবিল পাওয়ার দাবির সঙ্গে এই দাবিটিও যেন শক্তিশালী হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে আরো উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলার কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে – অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো থেকে দক্ষ অভিবাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে উচিত বিকল্প ও অভিযোজিত কর্মসংস্থান নিশ্চিতে উদ্যোগ নেয়া ।

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here