স্পেনের অধিবাসী মার্টিন জামোরা, তিনি মারা যাওয়া অভিবাসীদের মৃতদেহ সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন উপায়ে নিখোঁজ হওয়া অভিবাসীদের মৃতদেহ তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন।
ভূমধ্যসাগর অভিবাসীদের জন্য ভয়ংকর এক মৃত্যুফাঁদ। যার মধ্যে স্পেনের পরিস্থিতি বেশিই বিপজ্জনক, কারণ এটি একমাত্র ইউরোপীয় দেশ যেখানে আটলান্টিক এবং ভূমধ্যসাগর উভয় অঞ্চলের মানব পাচারের রুট রয়েছে।
একটি বেসরকারি সংস্থা ক্যামিনান্দো ফ্রন্টেরাসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই রুটে দুই হাজার ৮৭ জন মারা গেছেন বা স্পেনের তীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করে নিখোঁজ হয়েছেন।
স্প্যানিশ গণমাধ্যম মাঝে মাঝে সাম্প্রতিক মৃতদেহের খবর প্রচার করে থাকে। তারপর, যখন শিরোনামগুলি স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য যায়, মূলত ৭১ বছর বয়সী মার্টিন জামোরার কাজ তখন শুরু হয়।
দুঃখের বিষয় হলো, বেশিরভাগ সময়ে ডুবে যাওয়া এসব অভিবাসীদের সিংহভাগেরই পরিচয় পাওয়া যায় না এবং তারা কোন দেশের নাগরিক তাও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়না।
কিন্তু এসব নিখোঁজ অভিবাসীদের মৃতদেহ তাদের পরিবারের কাছে পৌছে দেওয়ার একটি উপায় অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন মিস্টার জামোরা। জিব্রাল্টারের নিকটবর্তী আলজেসিরাসের মৃতদেহ সৎকারকারী সাউদার্ন ফিউনারাল অ্যাসিস্ট্যান্সের কর্ণধার তিনি।
জামোরা বলেছেন যে, তিনি দুই দশকে ৮০০ টিরও বেশি মৃতদেহ ফিরিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছেন, তিনি অন্য কয়েকজনের মতো এটিকে একটি ব্যবসায়িক মডেল হিসেবে তৈরি করেছেন। মৃতদেহ হস্তান্তর করার জন্য পৌর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয় তার।
এরপর শুরু হয় নিখোাঁজ এসব মৃতদেহের পরিচয় সন্ধানের অভিযান। তিনি মৃতদের আত্মীয়দের খুঁজে বের করার জন্য চোরাচালানকারীদের সঙ্গেও কাজ করেন এবং আফ্রিকায় বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন।
যেসব পরিবার তাদের প্রিয়জনকে নিখোঁজ ভেবে সব আশা হারিয়ে ফেলেছিল, তাদের জন্য জামোরা আশার প্রদীপ নিয়ে হাজির হন।
২৭ বছর বয়সী আছরাফ আমির, একজন তানজানিয়ান মেকানিক। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ ছিলেন। স্পেনে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার অভিবাসীদের তালিকার মধ্যে তিনি ছিলেন। তাকে হয়তো অন্যান্য বেনামী মৃতদের সঙ্গে একটি গণকবরে পাঠানো হত যদি না মার্টিন জামোরা জানতে পারতেন যে, তার শরীরের একটি নাম আছে।
জামোরা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তার পরিবারের কাছে পৌঁছেছিলেন। তিনি তাদের ছেলের লাশ খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি মরক্কোতে তাদের কাছে মৃতদেহটি হস্তান্তর করেন। অবশ্য এর বিনিময়ে মৃতের স্বজনদের জামোরাকে অর্থ পরিশোধ করতে হয়।
একটি মৃতদেহ বাড়িতে পেতে ৩ হাজার ৫ শত ইউরো বা তার বেশি খরচ করতে হয়। তিনি বলেন, কোনো স্প্যানিশ সংস্থা তার কাজের জন্য অর্থ প্রদান করবে না এবং এই কাজের মুনাফা কম।
জামোরা যেভাবে লাশ শনাক্ত করেন
লাশের শরীর রহস্যময়। গলিত লাশের শরীরের জামাকাপড়ই প্রায়ক্ষেত্রে একমাত্র সূত্র হিসেবে কাজ করে।
জামোরা বলেন, ‘কারো মুখ শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে, কিন্তু একটি জুতা, একটি জার্সি, একটি টি-শার্ট পরিবারের একজন সদস্য অবশ্যই চিনতে পারবে।
১৯৯৯ সালে এক মরোক্কান মৃতদেহের কাপড়ের ভিতরে একটি নোট পেয়েছিলেন তিনি, আর এভাবেই তিনি লাশ শণাক্তের প্রথম সূত্রটির সন্ধান পেয়েছিলেন। সেই সময়ে সরকার স্থানীয় কবরস্থানের পাশে একটি মাঠে বেনামী মৃতদেহগুলি শেষকৃত্যের জন্য প্রস্তুত করছিল।
জামোরা তখন সেই লাশসহ সৈকতে আবিষ্কৃত হওয়া আরো অন্য ১৫ জনের মৃতদেহগুলি তার মর্গে ফিরিয়ে আনেন এবং স্পেনের একটি ফোন নম্বর সহ স্যাঁতসেঁতে নোটটি আবিষ্কার করেন।
তিনি সেই নম্বরে ফোন করেন এবং লাইনের অপর প্রান্তের একজন ব্যক্তি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে, একই লোকটি জামোরাকে আবার ফোন করে স্বীকার করেছে যে, সে ডুবে যাওয়া যুবকের ভগ্নিপতি ছিল।
জামোরা বলেন ‘আমি তাকে বলেছিলাম, অর্ধেক মূল্যে লাশটি বাড়ি পৌঁছে দেব, কিন্তু তোমাকে বাকিদের পরিবারের খোঁজ করতে সাহায্য করতে হবে।’
লোকটি জামোরাকে দক্ষিণ-পূর্ব মরোক্কোর সেই অঞ্চলের ঠিকানা দিয়েছিল। জামোরা প্রথমে সেই যুবকের দেহকে সুসজ্জিত করে ফেরত পাঠান। এরপর তিনি একজন স্থানীয় বিচারকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মরোক্কোতে অন্য মৃত অভিবাসীদের কাপড় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পান।
জামোরা ও তার সঙ্গীরা গ্রাম থেকে গ্রামে গেলেন, একটি বড় আলনা নিয়ে যার উপর তারা মৃত অভিবাসীদের কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, আংটি এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ। জামোরা বিশ্বাস করতেন সেই বাজারে মৃতব্যক্তিদের কারো না কারো স্বজন আসবেই।
দুই সপ্তাহ পর তারা বাকি ১৫ জনের আত্মীয়কে শনাক্ত করে প্রতিটি লাশ বাড়ি পৌঁছে দিতে সক্ষম হন।
আলজেসিরাসের সিটি মর্গের পরিচালক জোসে ম্যানুয়েল ক্যাস্টিলো বলেন, জামোরা কর্তৃপক্ষের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করেছেন। ‘কাউকে না কাউকে তো মৃতদেহ প্রত্যাবাসনের দায়িত্ব নিতে হতো, এবং যদি এটি মার্টিন জামোরা হয় তবে তা দুর্দান্ত।’
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস