দুটি আলোকচিত্র- যা বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের দুঃখগাঁথাকে পুরোপুরি তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। প্রথম আলোকচিত্রটিতে উড্ডয়নের পর একটি ইউএস মিলিটারি বিমানের নিচ থেকে দুজন ব্যক্তিকে পড়ে যেতে দেখা যায়। পরবর্তীতে একই বিমানের হুইল ক্যারেজের মধ্য থেকে তৃতীয় আরেকজন ব্যক্তি আফগান ফুটবলার জাকি আনোয়ারির ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
দ্বিতীয় আলোকচিত্রে দেখা যায়, কাবুল বিমান বন্দরে ক্রন্দনরত একটি শিশুকে তার বাবা-মা মার্কিন সৈন্যদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এই পিতামাতার নিশ্চিত বিশ্বাস, নিজ দেশের বন্দিদশার চেয়ে অন্য যেকোনো জীবন ঢের ভালো। অন্য
সম্ভবত নিজেদের দেশের অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখার চেয়ে এই মানুষগুলো মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করাকে শ্রেয় বলে ধরে নিয়েছিল। তাদের মর্মান্তিক ও বেদনাবিধুর এই মৃত্যু সামনে আনে: প্রত্যেকটি ‘অভিবাসী’, প্রত্যেকটি ‘শরণার্থী’, ‘যারা আকাশ থেকে ঝরে পড়ে’, যারা ভুমধ্যসাগরে ডুবে মারা যায়, যারা দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, আদতে তারা কখনোই স্বদেশ ও স্বজনদের ছেড়ে যেতে চান না। তারা অন্য দেশের মানুষদের বিরক্ত করতে চান না। তারা অন্যদের জীবিকায় ভাগ বসাতে কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চান না।
আসলে এই মানুষগুলো অন্য দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কারণ তারা জীবনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তাদের হৃদয়ে যে আর কোনো আশা অবশিষ্ট নেই! শত্রু, ক্ষুধা আর পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কোনো সম্বল তাদের নেই। এক পালানো ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। অবশ্য যখন আমরা এই মানুষগুলোর প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রকাশ করি, তখন আমরা বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে কথা বলি। আমরা তাদের দেখি কিন্তু আমরা সত্যিকার অর্থেই তাদের দেখতে পাই না।
যতক্ষণ আমরা তাদের প্রতি সত্যিকার অর্থে সহানুভূতিশীল হই না, যতক্ষণ না আমরা জাকি আনোয়ারির চাহুনিকে দেখি না, ঠিক যেমনটি আমরা কয়েক বছর আগে দেখতে পাইনি, আজিয়ান সমুদ্রতটে উপুড় হয়ে থাকা অ্যালান কুর্দির নিথর দেহ। জাকি তাদেরই একজন, যিনি আমেরিকান এয়ারক্রাফট থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। জাকির বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তিনি জাতীয় যুব ফুটবল দলে খেলতেন।
আফগানিস্তানের স্পোর্টস ফেডারেশন কর্তৃক জাকির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করার পর আমি তাকে নিয়ে পড়েছিলাম। এরপর আমি তাকে নিয়ে এখানে লেখাকে যুক্তিযুক্ত মনে করেছি।
যখন আমি আমার ডেস্কটপে তার ছবিটি খুলি, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি শোকাহত হযেছিলাম। ছবিটিতে একজন প্রান্তবন্ত যুবককে দেখা যাচ্ছিল। তিনি আফগানিস্তান জাতীয় দলের লাল রংয়ের দশ নম্বর জার্সি পরা ছিলেন। তার সেই গভীর দৃষ্টি ও চাহুনির মধ্য দিয়ে তিনি যেন তার হৃদয়ে ধারণ করা স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পথ খুঁজছিলেন। একই সময়ে তিনি এই দূরত্বের মধ্যে ধোঁয়াশাও দেখতে পাচ্ছিলেন। কেউ একজন তার চোখের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাসের উপস্থিতি আবিস্কার করতে পারেন। তার চাহুনি ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, সতেজ, পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতায় পরিপূর্ণ।
আফগানিস্তানের স্পোর্টস ফেডারেশনের একজন মুখপাত্র সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছিলেন, জাকি কাবুলের একটি অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি জাতীয় ফুটবল দলে খেলে তিনি তার স্বপ্নকে সত্যি করার প্রত্যয় নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। তাকে বোকামো, হাস্যকর ও ভয়ঙ্কর এমন কিছুই করার মানুষ বলে মনে হয় না। তিনি যে আত্মাহুতি দিবেন তাও কল্পনা করা যায় না।
প্রশ্ন হলো ঠিক কতসংখ্যক ছেলে-মেয়ে, কতসংখক নারী ও পুরুষ এভাবে আশাহত হবে? এই পথ ধরে অথবা অন্য কোনো উপায়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে জাকির মতো তারা তাদের জীবনকে মুদ্রার ওপিঠে সঁপে দিবে। আর কতজন পালিয়ে যাবেন?
তালেবান এই পরিস্থিতি কতোটা সামাল দিতে পারবে যেখানে চার কোটি মানুষের ভেতর ৬৩ শতাংশ আফগান চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে এবং দেশটি বাইরের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে ৪৬ শতাংশ মানুষই ১৫ বছরের নিচে, যেখানে নারীদের কাজ করা ও জনপরিসরে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো অধিকার নেই?
আরো খবর
>সাড়ে তিন কোটি আফগানের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন
>আফগান শরণার্থীদের ঢল ঠেকাতে সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করছে তুরস্ক
>২০ হাজার আফগান শরণার্থীকে পুনর্বাসিত করবে যুক্তরাজ্য
>আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় ও দারিদ্র্যপীড়িত উগান্ডার উদারতা
এখন, তালেবান বিদেশি পক্ষসমূহের সঙ্গে কোনোরকম সংশ্লিষ্টতায় জড়ানোর ঝুঁকি নেবে না। যাহোক, তাদেরকে অবশ্যই জনগণের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং নিজেদের দুর্বলতাকে অনুধাবন করতে হবে। এখন প্রশ্ন তারা কী বিদেশি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে?
অথবা তারা কী অনুধাবন করবে যে, তারা জনগণের মঙ্গলের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং এই সদিচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য তারা সমাজের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে সামনে এগোতে পারবে? আফগানিস্তান অনেক সমস্যায় জর্জরিত একটি দেশ। এখন দেশটির এগিয়ে চলার পথ খুব শিগগিরই উন্মোচিত হবে না। অপ্রত্যাশিতভাবে দেশটির প্রতিবেশিরাও পক্ষপাতদুষ্টভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যা কিনা দেশটির অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথেও বাঁধা।
আফগানিস্তানের চেয়ে পাকিস্তান ও ইরান উন্নত। আফগানিস্তানের উন্নয়নে এই দেশ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মার্কিন ও অন্যান্য বাহিনীর আকস্মিক দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রত্যাহার অনেক আফগানদের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। একইসঙ্গে এটি প্রতিবেশী দেশগুলোকে তাদের দায়িত্বের মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছে। তারা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন তার জন্য সুদূরপ্রসারী সমাধান প্রয়োজন।
দশ নম্বর জার্সি পরিহিত জাকি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো দলের সদস্য হতে পারতো। ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স অথবা গ্রিসে তার সম্ভাবনা, তার প্রতিভা, তার ভাগ্য বিকশিত হতে পারতো।
সত্যিকার অর্থেই জাকির চাহনি ভবিষ্যতের ওপর দৃঢ়ভাবে স্থির থাকবে। তার সেই ছবিটি যা আজ পৃথিবীতে রয়ে গেছে, যে ছবির দিকে তাকালে মনে হয়, জাকি যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও তার সে চাহনি এখন অতল গহ্বর ছাড়া আর কিছুরই দিশা খুঁজে পাচ্ছে না।
লেখক: নিকোস কনস্ট্যান্ডারাস। সংবাদ মাধ্যম একাথিমেরিনাই এ প্রকাশিত নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন তুষার ফারুক।