বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

কিয়েভে এক অবিস্মরণীয় রাত

ড. সেলিম জাহান

আমি উদ্বিগ্ন, ব্যথিত ও শঙ্কিতও বটে। সংবাদে যতই দেখছি, ততই আমার ভয় বাড়ছে। রণ দামামা বাজছে একটি দেশকে নিয়ে। এই দেশটির জন্যে আমার হৃদয়ে একটি নরম জায়গা আছে। দাপ্তরিক কাজে দেশটিতে আমার প্রথম যাওয়া ২০০৫ সালে। তারপরও বেশ ক’বার গেছি সেখানে। রাজধানী কিয়েভের পথঘাটে প্রচুর হেঁটেছি, ক্রিমিয়ার রাজনৈতিক সঙ্কটাপন্ন অঞ্চলে আলোচনার জন্যে গেছি। দেশটির ‘আত্মমর্যাদার আন্দোলনের’ ইতিহাস এখনও মনে আছে আমার। চেরনোবিলের কথা কি করে ভুলি? উলিয়া তাইমোশেঙ্কোর মাথার ওপরে বেনী করা ছবি এখনও চোখে ভাসে। দেশটির নাম ইউক্রেন।

আজ ১৫ বছরের বেশি সময় পরও কত স্মৃতি ইউক্রেনকে নিয়ে। দেশটির জন্য একটি দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচি প্রণয়নের জন্যে বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার যৌথ মিশনের দলপতি হিসেবে ইউক্রেন গিয়েছিলাম। কিয়েভে নেমেই কাজে নেমে পড়া গেলো।

মনে আছে সে সময়ে ইউক্রেনের অবস্থা ভালো ছিল না। অন্য সব বাদ দিয়েও এইডস সমস্যায় দেশটি তখন জর্জরিত-এক লাখের ওপরে মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত। কিয়েভ রেলস্টেশনে ইনজেকশন সিরিঞ্জের ছড়াছড়ি। এখানে-ওখানে এইডস আক্রান্ত মানুষজন শুয়ে আছে-মরা মাছের মতো নির্লিপ্ত তাদের চোখ, টিম টিমে বাতি এখানে ওখানে – একটি মৃতপুরীর ছায়া চারদিকে।

ইউক্রেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উলিয়া তাইমোশেঙ্কো

এর পরিপ্রেক্ষিতেই আলোচনা চলছিল দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী উলিয়া তাইমোশেঙ্কোর সঙ্গে। প্রথম দর্শনেই এই স্বর্ণকেশী রাজনীতিবিদের মাথার ওপরে বেনী করা চুল আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। স্মিতহাস্যে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এমনটা তুমি আগে দেখেছো?’ আমি হেসে বললাম, ‘আগে দেখেছি বলেই বিস্মিত হয়েছি। আমার বোনকে করতে দেখেছি। তার বান্ধবীদের করতে দেখেছি। আমাদের দেশে এটাকে কলাবেনী বলে’।

‘বলো কি!’, এবার তার অবাক হওয়ার পালা। ‘আমাকে লোকে যা দিয়ে চেনে, তা আগেই হাতছাড়া হয়ে গেছে’, তার কণ্ঠস্বরে কৃত্রিম অভিমানের সুর। এখানে বলে রাখি, প্রথম সাক্ষাতের ১২ বছর পর যখন লাটভিয়ার রিগায় তার সঙ্গে দেখা হয়, তখন তার সেই বিখ্যাত বেনী সম্পূর্ণ অন্তর্হিত।

উলিয়া এক তুখোড় রাজনীতিবিদ। ইউক্রেনের দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচির ক্ষেত্রে তিনি খুব সন্তর্পণে ক্রিমিয়া প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলছিলেন। কিন্তু আমি বললাম যে, ক্রিমিয়ার দরিদ্র অঞ্চলকে বাদ দিয়ে ইউক্রেনের জন্য দারিদ্র্য নিরসন কর্মসূচী করা, আর ডেনমার্কের যুবরাজকে বাদ দিয়ে ‘হ্যামলেট’ নাটক করা একই কথা। আমার কণ্ঠের দার্ঢ্যতা দেখে তিনি রাজী হন। সিদ্ধান্ত হয় যে, দু’দিন পরই আমি আমার দলবল নিয়ে ক্রিমিয়া যাব সরেজমিনে সব দেখার জন্য। আমাদের নিরাপত্তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আমার ক্রিমিয়া ভ্রমণটি তিনটে কারণে মনে থাকবে। প্রথমত, আমরা সদলবলে রওনা হয়েছিলাম বিকেলে কিয়েভ রেলস্টেশন থেকে, সেই পুরোনো রাশান রেলে। সবার জন্যই থাকবে এক একটি সুশোভিত কেবিন। তার সামনে লেসের পর্দা টানা কাঁচের বারান্দা। এমন রেল আমি আগে আর দেখিনি কোথাও। দ্বিতীয়ত, সারারাতের পর সকালে যখন বাইরের কাঁচের বারান্দায় এসে পর্দা সরালাম, তখন দেখি বাইরের পুরোটা, মাইলের পর মাইল শুধু শুভ্র তুষারে ঢাকা। আর কোন কিছু নেই – তার মাঝ দিয়ে আমাদের রেলগাড়ি হুস্ হুস্ করে চলছে। সে সব দেখে আমার শুধু ‘ ডক্টর জিভাগো’ ছবিটির কথা আর তার মূখ্য সঙ্গীতটিই মনে পড়ছিল।

তৃতীয়ত, ক্রিমিয়ায় পৌঁছানোর পর আমাদেরকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গভর্নরের দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রাথমিক কুশলাদি বিনিময়ের পর দোভাষীর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। ক্রিমিয়াকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য গভর্নর আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। আলাপের একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘তুমি বাংলাদেশের লোক। তুমি আমাদের অবস্থা বুঝবে। আমি বুঝলাম, তিনি কী বলতে চাইছেন।

রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সংঘাত ও অসহিষ্ণুতার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন হওয়ার আগেই প্রচুর রাশান সেখানে থিতু হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়েও বহু রাশান পরিবারকে খুব সুপরিকল্পিতভাবে সেখানে অভিবাসনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

এর ফলে ইউক্রেনে একটি বিভাজিত সমাজ গড়ে ওঠে-রাশান ও ইউক্রেনিয়ান। তাদের আবাসন এলাকা আলাদা, ইউক্রেনিয়ানদের রাশান ভাষা শিখতে হয়, রাশান শিশুদের রাশান স্কুলে যেতে হয়। দেশটিতে দু’টো গোষ্ঠীর মধ্যে চাপা সংঘাত বিদ্যমান। এ সবের কারণে গত দশকের মাঝামাঝিতে গড়ে ওঠে ইউক্রেনের আত্মমর্যাদার আন্দোলন। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ভিক্টর ইয়োনুকোভিচ দেশ থেকে পালিয়ে যান।

ইউক্রেন ভ্রমণ
ছবি: লেখক

এ চালচিত্রেরই একটি প্রলম্বিত অংশ হচ্ছে ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়ার বেশিরভাগ মানুষই রাশান ও তাতার। তারা মনে করে, ক্রিমিয়া রাশিয়ারই অংশ। এর সূত্র ধরে পুতিন ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে সেটাকে রাশিয়ার অংশ করে নেন। কেউ তাকে আটকাতে পারেনি। পুতিনের প্রজন্মের রাশানরা মনে করে, ইউক্রেন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, ইউক্রেন রাশিয়ারই অংশ এবং ঐ ভূখন্ডটির ওপর তাদের দাবি আছে। সুতরাং পুতিনের এবারের ইউক্রেন দখলের হুমকির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে।

তবে ইউক্রেন বিষয়ে একটি স্মৃতি আমি কখনো ভুলবো না-সে স্মৃতি আমাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। ২০০৫ সালের কথা। এক রাতে আমি এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে রেলে ফিরছি। কিয়েভ স্টেশনে ফিরে দেখি, মুষলধারে বৃষ্টি। স্টেশনের অবস্থা দেখে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম না সেখানে অপেক্ষা করতে। ভাবলাম, হাতে একটি ভালো মজবুত ছাতা আছে এবং আমার হোটেলও মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ স্টেশন থেকে, সুতরাং দৌড়েই চলে যেতে পারবো। যেই ভাবা, সেই কাজ। ছাতা খুলে নেমে পড়লাম বৃষ্টিতে।

দু’মিনিট পরই বুঝলাম, খুব অর্বাচীনের মতো একটা কাজ করেছি। এ বৃষ্টি সাধারণ বৃষ্টি নয়, শীতের বৃষ্টি। এবং সে বৃষ্টি আসছে ঝাপটা মেরে নানান দিক থেকে। ছাতাতে তা মানছে না। বৃষ্টির সঙ্গে আছে ঠান্ডা হাওয়া। পাঁচ পা যেতেই আমি ভিজে চুপসে গেছি, গায়ের গরম কোটকে শীতল একটা কম্বলের মতো মনে হচ্ছিল। ঠান্ডা আমার হাড়ে হাড়ে বিঁধছিল।

আলো-আঁধারিতে হঠাৎ দেখি উল্টো দিক থেকে একজন তরুণি মা আসছেন। তার মাথায় কিছু নেই। বর্ষার অঝোর ধারা তার পিঠ ছাপানো চুল বেয়ে নামছে। বৃষ্টির ছাঁটে সে ঠিক করে তাকাতে পারছে না। তার গায়ে পাতলা একটি বর্ষাতি। সেটা দিয়ে সে ঢেকে নিয়েছে তার শিশু সন্তানকে। কিন্তু রক্ষা করা যাচ্ছে না তাকে জলধারা থেকে। অন্য হাতে সে ধরে আছে একটি ছোট্ট মেয়ের হাত। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ওরা গৃহহীন।

ছোট্ট মেয়েটি ও তার মা শীতে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে। ঠান্ডায় নীল হয়ে গেছে ছোট্ট মেয়েটির গোলাপি ঠোঁট। আমার মনে হলো, আর ক’মিনিটের মধ্যেই তো আমি পৌঁছে যাবো আমার পাঁচতারা হোটেলের আরামে, উষ্ণতায়। কিন্তু এদের! এদের কি হবে? কোথায় যাবে এই তরুণি মা আর তার দু’টো শিশু সন্তান? কোথায় কাটাবে সারারাত? আমার কি যে হলো? হঠাৎ করে ছাতাটি তরুণি মা’য়ের হাতে ধরিয়ে, দিলাম দৌড়। সেটা কি ওদের কাছ থেকে পালাতে গিয়ে না কি দ্রুত হোটেলে পৌঁছে যেতে, কে জানে?

লেখক: অর্থনীতিবিদ, লেখক ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা