বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

জাতির জীবনে আজ এক অবিস্মরণীয় দিন

স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে জাতির জীবনে আজ এক অবিস্মরণীয় দিন। আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে তদানীন্তন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়।  তৎকালীন কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। এই দিন ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশের আগামীদিনের প্রত্যাশিত দিক-নির্দেশনা, সাংবিধানিক এবং যৌক্তিক অধিকার রক্ষার জন্য মুজিবনগর সরকার গঠন করা ছিল তৎকালীন সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে না চাওয়ার কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের সাধারণ মানুষ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য শপথ নিয়েছিল তখনই মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা তৎকালীন বাংলার জনগণ উপলব্ধি করেছিল।

১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পবিত্র কোরান তেলওয়াতের পর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং নবগঠিত সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় এবং মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম. এ. জি ওসমানী (পরবর্তীতে জেনারেল) বক্তব্য রাখেন।  এমনিভাবেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক সরকার বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করলো।

মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রাক্কালে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল তার ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান” ঘোষণাপত্রের নবম অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সমাাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং উহা দ্বারা পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।

ছবি: সংগৃহীত

ঘোষণাপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, এতদ্বারা আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্র প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।

রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী।

সদ্যসৃষ্ট রাষ্ট্রের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক জনগণ ও দেশী-বিদেশী সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন, মুজিবনগর সরকার গঠন করার ফলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার ‘‘মুজিবনগর সরকার” গঠন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য গৌরবগাঁথা সাফল্যের স্বাক্ষরও বটে।

যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা এদেশকে স্বাধীন করার জন্য গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল মুজিবনগর সরকার ছিল তাদের ঐক্য ও নির্দেশনার প্রতীক।

দেশকে শত্র“ মুক্ত করার জন্য গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও মুজিবনগর সরকারই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম দায়িত্বশীল সরকার” এই সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যৌক্তিকতার প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা, বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে কর্তৃত্ব স্থাপন করা, মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, দেশের ভিতরে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং পশ্চিমাদের অপপ্রচার প্রতিহত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা।

মুজিবনগর সরকারে আব্দুল মান্নানকে প্রেস, তথ্য রেডিও ও চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান, মো. ইউসুফ আলীকে ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান, মতিউর রহমানকে বাণিজ্য বিভাগের প্রধান, আমিরুল ইসলামকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এবং মেজর আব্দুর রবকে (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সরকারি উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তারা মুজিবনগর সরকারে দায়িত্ব পালন করেন।  নুরুল কাদের খান, এস. এ সামাদ, খন্দকার আসাদুজ্জামান, ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ড. সাদাত হোসাইন ও ড. আকবর আলী খান তাদের মধ্যে অন্যতম।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর পাড়ায় পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হলেও মুজিবনগর সরকারই প্রথমে মুক্তিবাহিনীদের বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র এবং কলকাতা ও আগরতলার ট্রেজারি থেকে টাকা পয়সা এনে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধে যাবতীয় সহযোগিতা করেছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের তদারকি করাসহ দেশের ক্ষতিগ্রস্থ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে সারা দেশকে ছয়টি জোনে ভাগ করে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব প্রদান করেন। 

পশ্চিম জোনে দায়িত্ব পালন করেন আজিজুর রহমান এবং আশরাফুল ইসলাম। পূর্ব জোনে দায়িত্ব পালন করেন লে. কর্নেল এম এ রব, উত্তর জোনে মতিউর রহমান এবং আব্দুর রউফ, উত্তর-পূর্ব জোনে দেওয়ান ফরিদ গাজী এবং শামসুর রহমান খান, দক্ষিণ-পূর্ব জোনে নূরুল ইসলাম চৌধুরী এবং জহুর আহমেদ চৌধুরী, দক্ষিণ-পশ্চিম জোনে ফণি ভূষণ মজুমদার এবং এম. এ রউফ চৌধুরী।

মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা কামনা করে এবং তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে বলেই বাংলার জনগণসহ বিশ্ববাসী মনে করে।

মুজিবনগর সরকার ধীরে ধীরে দেশের সর্বস্তরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান করেন, তারই ধারাবাহিকতায় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন, আনিসুজ্জামান, খান সরাওয়ার মোরশেদ, স্বদেশ রঞ্জন দায়িত্ব পালন করেন।

ছবি: সংগৃহীত

যুব ক্যাম্পের পরিচালক হিসেবে এস আর মীর্জা, তথ্য ও প্রচার বিভাগের পরিচালক হিসেবে এম. আর আকতার মুকুল, চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক হিসেবে আব্দুল জব্বার খান, চারুকলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে স্থপতি কামরুল হাসান, স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক হিসেবে টি হোসাইন এবং ত্রাণের কমিশনার হিসেবে জে. জি ভৌমিক দায়িত্ব পালন করেন এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও হোসেন আলীকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে আশফাকুর রহমান খান, সহিদুল ইসলাম, টি. এইচ সিকদার, বেলাল মোহাম্মদ, তাহের সুলতান, কামাল লোহানী, নাসিমুল কাদের চৌধুরীকে বাংলা সংবাদ, আলী জাকেরকে ইংরেজী সংবাদ, আলমগীর কবীরকে ইংরেজী সংবাদের ভাষ্যকার, জাহিদ সিদ্দিকীকে উর্দু অনুষ্ঠানের প্রধান, সমর দাস এবং অজিত রায়কে সঙ্গীত, হাসান ইমামকে নাটকের প্রধান, আশরাফুল আলমকে বহিবির্ভাগের অনুষ্ঠান ধারণ এবং সাক্ষাৎকার বিভাগে, সৈয়দ আব্দুল শাকুর ও রেজাউল করিম চৌধুরীকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার সৈন্যরা যখন আত্মসমর্পন করলো, তখন মুজিবনগর সরকার রাজধানী ঢাকায় এসে নতুন একটি দেশ বাংলাদেশের সকল দায়িত্ব বুঝে নেয়। এরপর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করেন, যার ফলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

মুজিবনগর সরকার হচ্ছে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসটি জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথা দিন।

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা