সারা বছর ধরে বুকের ভেতর লালিত স্বপ্ন যখন এক পলকে ভেঙেচুড়ে তছনছ হয়ে যায়, তখন মানুষের দুঃখের ভার কতোটা হতে পারে, তা পরিমাপের বোধহয় প্রয়োজন নেই। ঘরে অসুস্থ স্বামীকে রেখে সেই খালিশপুর থেকে খুলনার জাতিসংঘ শিশুপার্কে এসে ভাসমান আল্পনা আঁকিয়ে রহিমা বেগম যখন জানতে পারেন, এবছর পহেলা বৈশাখে এ পার্কে মেলা বসার অনুমতি নেই, তখন তার ভেতরটা যেন মোচর দিয়ে উঠেছিল।
অভিবাসী ডটকম এর সামনে রহিমা বেগমের সেই দুঃখ যেন খানিকটা উপচে পড়লো। বললেন, ‘আমি জানি পহেলা বৈশাখে এখানে মেলা হয়। এজন্য কারো কাছে জিজ্ঞাসা না করে নিশ্চিন্তে চলে আসি। কিন্তু এবার এসে দেখি মেলার অনুমতি নেই। কি রকম লাগে বলেন! এতদিন ধরে আশায় আছি, অন্য কোথাও যাবো না, এই পার্কেই অনেক মানুষ আসে। ভালো ব্যবসা হবে। কিন্তু কিছুই হলো না।’
রহিমা বেগম অনেকটা জোর করেই দেখালেন তার টাকার থলি। বললেন, ‘এই দেখেন কয় টাকা সারাদিনে ইনকাম করছি।’ দেখা গেল, থলেতে বড়জোর ৪০-৫০ টাকা, এর বেশি হবে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বাড়ি কখন যাবেন, এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, ‘আরেকটু থাকবো। অন্তত আসা-যাওয়ার খরচটা ওঠে কিনা দেখি।’
এদিকে অনেকক্ষণ ধরে চোখে পড়ছে রঙ-বেরঙের হাতি-ঘোড়া, বিমান, মাছ সদৃশ গ্যাস বেলুন নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন একজন বৃদ্ধ। আনুমানিক দুই ঘণ্টার মধ্যে সাকুল্যে দুটি বেলুন বিক্রি করতে দেখা গেছে তাকে। ব্যবসার হাল যে আজ খুব খারাপ গেছে, তা তার চোখমুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে বললেন, ‘শফি শেখ।’ বয়স কত? ‘৭১ বছর’-উত্তর দিলেন।
ব্যবসা আজ কেমন হলো, তা আরেকটু ঝালিয়ে নিতে জনাব শফিকে প্রশ্ন করা হয়, আজ কেমন ব্যবসা করলেন? তার কথাতেও রহিমা বেগমের প্রতিধ্বনি। ‘এই পার্কে মেলা হয় প্রতি বছর। এবছর মেলার অনুমতি দেয়নি। তাই আমাদের ব্যবসাও নেই।’ খানিকটা রাগের স্বরেই বললেন, ‘সরকার যদি পারমিশন (অনুমতি) না দেয়, তাহলে করার তো কিছু নেই।’
এসময় শফি শেখ যোগ করলেন, ‘গত দুই বছর তো করোনা গেছে। লকডাউনে সব বন্ধ ছিল। এবছর আশায় ছিলাম করোনা নেই, অন্তত ভালো বেঁচাকেনা হবে। এখন লকডাউন চলে গেছে, এখন তো অনুমতি দেয়া উচিৎ। এই দিনটার জন্য তো আমরা বসে থাকি। অনুষ্ঠান হলে তো দুটো টাকা বেশি ইনকাম হয়। আজ যেখানে ৫-৭ হাজার টাকা বেঁচা-বিক্রির আশা করেছি। সেখানে বিক্রি করেছি মাত্র ৫০০ টাকা। এ মধ্যে কয় টাকাই বা লাভ হবে? মাল বাকি আনি, এই বলে যে অমুক দিন দেবো। কিন্তু মাল বেঁচা না হলে তো দিতে পারবো না। কথার বরখেলাপ হয়ে যাবে।’
আরেকটু সামনে এগোতে দেখা গেল, বেলুন, খেলনার ছোটো একটি চাকাওয়ালা দোকান। কিছু মানুষের জটলা সেখানে। কাছে এগোতেই দেখা গেল, শিশুদের জন্য খেলনা কিনছেন একটি পরিবার। এই দোকানদারের নাম মারুফ। বয়সে তরুণ এ যুবকের কাছে ব্যবসা কেমন চলছে, জানতে চাইলে বলেন, ‘মোটামুটি, খুব ভালো না।’
উৎসব পালন করতে, ঘুরে বেড়াতে মানুষজন আরো যেসব জায়গাগুলোতে একটু বেশি যায়, এবার গন্তব্য সেদিক। জাতিসংঘ শিশু পার্ক থেকে বেরিয়ে কয়েকটি জায়গা ঘুরে ভাসমান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল সেই একই চিত্র। আমজাদ নামের চটপটি বিক্রেতা বললেন, ‘যা বেঁচার তা দুপুরের আগে করে নেয়ার চেষ্টা করেছি। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান তো বিকালের আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও আমাদের মূল ব্যবসাটাই জমে সন্ধ্যার সময়। কিন্তু কি আর করা। এবছর ধরা।’
সবমিলিয়ে বলা যেতে পারে, পহেলা বৈশাখ পালনের বিধিনিষেধের কারণে বাংলা বছরের প্রথম দিনটি একেবারেই খারাপ গেছে ভাসমান এ মানুষগুলোর!