বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

বিদেশফেরত রুস্তমের ঘুরে দাঁড়ানোর রহস্যটা কী?

পড়ালেখা করে বড় হবেন। শিক্ষিত হয়ে চাকরি করবেন। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবেন। অন্য অনেকের মতো এই স্বপ্নগুলো নরসিংদীর রুস্তমকেও তাড়িয়ে বেড়াতো। মাধ্যমিক পর্যন্ত এগিয়েও গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য রুস্তমের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর্থিক অনটনের কারণে বাধ্য হন পড়ালেখা থামিয়ে দিতে। এরপর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলতে গিয়ে রুস্তমের জীবনে ঘটে যায় একের পর এক দুর্ঘটনা।

প্রলোভনে পা দিয়ে দুই-দুইবার বিদেশ গিয়েও সফলতা ছিনিয়ে আনতে ব্যর্থ হন রুস্তম। শেষপর্যন্ত বিদেশ থেকে দেশে ফিরে, সহায় সম্বল হারানোর দুঃশ্চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ঠিক এমন সময় তার পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। এখান থেকে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেবা পেয়েই এখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন ২৮ বছর বয়সী এ যুবক।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রত্যাশা প্রকল্পের অধীনে কাউন্সেলিং সেবা পাওয়ার পর নিজের অনুভূতি জানিয়ে রুস্তম বলেন, ‘আমি যে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তা পেয়েছি, তা নিয়ে আমার খুব ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ছিল। একেবারে শুরুতে আমি কাউন্সেলিং সেশনে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলাম। কারণ আমার জানা মতে, এই ধরনের সেবাকে ঘিরে অনেক বেশি দুর্নাম রয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, আমি যত বেশি কাউন্সেলরের (প্রত্যাশা প্রকল্পে নিয়োজিত কাউন্সেলর) সঙ্গে কথা বলেছি, ততই ভাল বোধ করেছি।’

রুস্তমের জীবনে অন্ধকার নেমে আসার প্রথম ধাপ

পড়ালেখা থামিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রুস্তম পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে ঢাকার একটি টেক্সটাইল কারখানায় কাজ শুরু করেন রুস্তম; বেতন খুবই সামান্য। ফলে কী করে বেশি উপার্জন করা যায়, সেই চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে সারাক্ষণ। একপর্যায়ে জানতে পারেন, তার এক মামাতো ভাই বিদেশে চলে গেছে এবং সেখানে কাজ করে প্রচুর অর্থ বাড়িতে পাঠিয়েছে। মূলত এই গল্পটিই রুস্তমকে প্ররোচিত করে বিদেশে পাড়ি জমাতে।

বিদেশ যাবার প্রথম চেষ্টা

কোনো আগপাছ চিন্তা না করে রুস্তম একজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যথারীতি দালালও তাকে আশ্বস্ত করে বিদেশ পাঠানোর। দেখা গেল, বাবার জমিটুকু বিক্রি করে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা জোগাড় করে রুস্তম তুলে দেন দালালের হাতে।

ইরাকে ভালো কাজ আছে এবং এই কাজ করলে অনেক টাকা রোজগার করা যাবে-দালালের এমন প্রলোভনে পড়ে ২০১০ সালের জুন মাসে রুস্তম ইরাকে চলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, দালাল তাকে যা বলেছে, তার পুরোটাই ধোকা। সেখানে নগণ্য বেতনে তিনি নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হন, প্রতি মাসে বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ২০ হাজার টাকা। তারপরও রুস্তম বাধ্য হয়ে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু ইরাকের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ২০১৬ সালে তার চাকরিটি চলে যায় এবং তিনি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

দ্বিতীয়বারও সেই একই ফাঁদে

প্রলোভনে পড়ে প্রথমবার বিদেশ গিয়ে বড় ধরনের ধরা খাওয়ার পরও রুস্তমের বিদেশ যাবার ঘোর কাটে না; পুনরায় বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবার এক দালালের সঙ্গে সাত লাখ টাকায় চুক্তি করেন তিনি। চুক্তি অনুযায়ী তাকে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক তিনি রওয়ানাও দেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এবার তিনি আটক হন গ্রিক নৌবাহিনীর হাতে। যে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন, সেই নৌকা থেকেই রুস্তমকে আটক করা হয়।

বেশ কিছুদিন পর রুস্তম মুক্তি পান। একপর্যায়ে তিনি গ্রিক সরকারের কাছ থেকে দেশটিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে থাকার অনুমতি পান। এরপর তিনি একটি কৃষি ব্যবসায় খণ্ডকালীন চাকরি শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা উপার্জন করতেন। গ্রিসের মতো দেশে যা কিনা জীবন ধারণের জন্য একদমই অপর্যাপ্ত। তিনি বহুভাবে চেষ্টা করেছিলেন, স্থায়ী একটি চাকরি পেতে। কিন্তু তার সে স্বপ্নও বিলীন হয়ে যায়। উপায়ান্ত না পেয়ে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে তিনি খালি হাতে দেশে ফিরে আসেন।

মানসিক যন্ত্রণার শুরু

বাংলাদেশে ফিরে আসার পর রুস্তম বেকার হয়ে পড়েন এবং আর্থিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে থাকেন। মানসিক উদ্বেগ তার ভেতর এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে, বাড়ির বাইরে পর্যন্ত বের হতে চাইতেন না। সবসময় একাকি-নিঃসঙ্গ সময় কাটাতে থাকেন। ধীরে ধীরে পরিবারের সঙ্গেও তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

যেভাবে বদলে গেল হতাশার জীবন

২০২১ সালে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের একজন মাঠকর্মী রুস্তমকে রিইন্ট্রিগ্রেশন সার্ভিস সেন্টার, নরসিংদীতে একজন সম্ভাব্য সেবাগ্রহিতা হিসেবে খুঁজে পান। এরপর প্রক্রিয়া মেনে আরএসসি-এর কর্মীরা তার প্রোফাইল এবং টেইলর রিইন্ট্রিগ্রেশন প্লান তৈরী করে। প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে রুস্তমের সংকট উত্তরণ ও সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মানসিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে একজন মনোসামাজিক কাউন্সেলর রুস্তমকে নিয়ে পাঁচটি সেশনে বসেন এবং তার সংকটগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। এভাবেই কাউন্সেলরের নিবিঢ় চেষ্টায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকেন রুস্তম।

কাউন্সেলিং সেবা পাওয়া সেবাগ্রহিতার সংখ্যা

আইওএম এর তথ্য অনুসারে, বিদেশফেরতদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ মনোসামাজিক জটিলতার অন্যতম হলো উদ্বেগ, বিষন্নতা এবং তীব্র মানসিক চাপ। এগুলো সাধারণত কাউন্সেলিং সেশনের সময় চিহ্নিত করা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ হাজার ৩৮ জন সেবাগ্রহিতা কাউন্সেলিং সেশন সম্পন্ন করেছেন।

এখন রুস্তম যেমন আছেন

রুস্তম এখন বেশ আত্মপ্রত্যয়ী; স্বপ্ন দেখছেন নিজেকে এগিয়ে নেয়ার। তার মতো কেউ যেন আর এভাবে প্রলোভনে পড়ে অনিয়মিত উপায়ে বিদেশ না যায়, সে ব্যাপারেও যথেষ্ঠ তৎপর তিনি। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে সবাই যাতে নিয়ম মেনে চলে-সে পরামর্শও রুস্তমের। কাউন্সেলিং প্রসঙ্গে রুস্তম বলেন, “আমি অতীতকে ফিরিয়ে আনতে পারি না; স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে তাড়া করে। কিন্তু কাউন্সেলিং সেশনগুলো আমাকে আমার পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। এখন আমি আমার পরিস্থিতি ও নিজেকে মেনে নিতে শিখেছি।’

তথ্যসূত্র: আইওএম

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা