প্রেসিডেন্ট ব্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া কথিত বিশেষ অভিযান শুরু করে ইউক্রেনে। চলমান অভিযানটি দুই মাস অতিবাহিত করেছে। কিন্তু এরই মধ্যে এক কোটিরও বেশি ইউক্রেনীয় তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বিপুলসংখ্যক এই নাগরিকদের মধ্যে ৩৭ লাখ মানুষ একেবারের জন্য দেশত্যাগ করেছে। মূূলত যুদ্ধকালীন এই সময়ে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা খুঁজতে এই মানুষগুলো ভিন দেশে গিয়ে শরণার্থী হয়েছে।
আশ্রয়দাতা দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা বিপুলসংখ্যক এই শরণার্থীদের প্রতি অসাধারণভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা বিপদাপন্ন এই মানুষদের খাবার, পানি, আশ্রয় ও চিকিৎসা সহায়তাসহ জীবন ধারণের মৌলিক সেবাসমূহ প্রদান করে চলেছে।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ইউক্রেনের পাশের দেশ পোল্যান্ড ২০ লক্ষাধিক ইউক্রেনীয়কে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনিয়ানদের জন্য যথাসম্ভব দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে নেয়া এসব পদক্ষেপ যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যূত লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করেছে বলেও পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অভিমত।
যদিও যুদ্ধ, সংঘাত, সহিংসতা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। বছরের পর বছর এমনকি কয়েক দশক ধরে শরণার্থী নামক প্রপঞ্চটি বহন করতে করতে সাধারণ এই মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
চলুন দেখে নেয়া যাক, পৃথিবীজুড়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা শরণার্থী সংকট সম্পর্কে ১২টি মর্মান্তিক তথ্য:
এক. ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই শরণার্থী সংখ্যা রেকর্ড উচ্চতায় ছিলো
ইউক্রেনে রাশিয়ার কথিত বিশেষ অভিযানের কারণে লাখ লাখ মানুষের শরণার্থী হচ্ছেন এবং এই সংবাদ পৃথিবীজুড়ে প্রচারও পাচ্ছে দেদারছে। যদিও ইউক্রেনের ঘটনার আগে থেকেই পৃথিবীজুড়ে শরণার্থী সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলছিল। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ২৬ দশমিক ৬ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থী এবং ৫০ দশমিক ৯ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যূত হয়েছে। উপরন্ত বিশ্বব্যাপী ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে এবং ভেনেজুয়েলার ৪ দশমিক এক মিলিয়ন নাগরিক বাস্তুচ্যূত হয়েছে।
দুই. জোরপূর্বক বাস্তুচ্যূত মানুষেরা দেশ গঠন করলে তা হবে বিশ্বের ১৭তম জনবহুল দেশ
২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৮৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়েছে, যা জার্মানির মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনীয় শরণার্থী এবং যারা গত বছরের পুরোটা সময় অন্যান্য বৈশ্বিক সংঘাত ও সঙ্কট থেকে পালিয়ে এসেছে, তাদের সবাইকে একসঙ্গে করে একটি দেশ গঠন করা হলে, অনুমানভিত্তিক সেই দেশ হবে পৃথিবীর ১৭তম জনবহুল দেশ।
তিন. শরণার্থীরা গড়ে ২০ বছর পুনর্বাসন এবং আত্মীকরণের জন্য অপেক্ষা করে
মোটামুটিভাবে ধরলে, শরণার্থী জীবন ২০ বছরের এক দীর্ঘ বিচ্ছেদ জীবন। একইসঙ্গে একটা নতুন জীবন শুরু করার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় শরণার্থীদের। সত্যি বলতে কী, কেউ স্বেছায় শরণার্থী হয় না বা শরণার্থী হয়ে থাকতে চায় না। মূলত বেঁচে থাকার তাগিদে এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে অতীত জীবনকে ত্যাগ করে শরণার্থী পরিচয়টিকে একটি হাতিয়ার বা উপায় হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ।
চার. ৮৫ শতাংশ শরণার্থীকেই গ্রহণ করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলো
শরণার্থীদের গ্রহণের জন্য সম্পদশালী ও ধনী দেশগুলোর কাছে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থাকা স্বত্ত্বেও অবিশ্বাস্যভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাঁধেই সিংহভাগ শরণার্থীর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংকটাপূর্ণ অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোই হয়ে ওঠে শরণার্থীদের প্রধান আশ্রয়স্থল। সাদা চোখে এর অন্যতম কারণ হলো, কাছাকাছি হওয়ার ফলে সীমানা পেরিয়ে খুব সহজেই তারা প্রতিবেশী দেশে পোঁছাতে পারে। আদতে, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পার্থক্যের জায়গা এখানেই। তারা উন্নত দেশগুলোর মতো আশ্রয়হীনদের অকথ্যভাবে ফিরিয়ে দিতে পারে না। ফলে দিনকে দিন উন্নয়নশীল দেশের কাঁধে বেড়েই চলেছে শরণার্থী গ্রহণের সংখ্যা। হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট শরণার্থীর ৮৫ শতাংশই বহন করছে এই উন্নয়নশীল দেশসমূহ।
পাঁচ. তুরস্ক সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শরণার্থীকে স্বাগত জানিয়েছে…
তুরস্কে শরণার্থীদের সিংহভাগই এসেছে সিরিয়া থেকে। সিরিয়া এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধে ভুগছে। কলাম্বিয়ায় বেশিরভাগ বাস্তুচ্যূত মানুষেরা আসে মূলত ভেনেজুয়েলা থেকে। এরপর উগান্ডায় আসে দক্ষিণ সুদান থেকে, পাকিস্তানে আসে আফগানিস্তান এবং জার্মানিতে আসে সিরিয়া থেকে।
ছয়. আরুবা এবং লেবানন সীমান্তে শরণার্থী আধিক্য
আরুবার প্রতি এক হাজার বাসিন্দার মধ্যে ১৫৬ জন শরণার্থী রয়েছে। অন্যদিকে লেবাননে প্রতি হাজার বাসিন্দার মধ্যে ১৩৪ জন শরণার্থী। অথচ এর ঠিক বিপরীত চিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে, যেখানে প্রতি এক হাজার বাসিন্দার মধ্যে মাত্র ০ দশমিক ৮৪ জন শরণার্থী রয়েছে।
সাত. নতুন দেশে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পান ১ শতাংশেরও কম শরণার্থী
শরণার্থীরা যখন তাদের নিজ দেশ থেকে পালিয়ে যায়, তখন তাদের কাছে বেশিরভাগ সময়ই সামান্য অর্থ ও সম্পদ থাকে কিংবা অনেকের হাত থাকে একেবারেই ফাঁকা। ফলে তাদের আশ্রয়, খাবার, পানি এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহায়তার দরকার হয়। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় নূন্যতম সহযোগিতা পান না। সেভ দ্য চিলড্রেন এর তথ্য অনুযায়ী, এক শতাংশেরও কম শরণার্থীকে একটি নতুন দেশে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়।
আট. বিশ্বের মোট শরণার্থীর অর্ধেকই শিশু
বিশ্বের মোট শরণার্থীর অর্ধেকই শিশু। বিশ্লেষকদের দেয়া তথ্যমতে, প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শরণার্থীর বয়স ১৮ বছরের নিচে। মানবিক বিচারে যা কিনা খুবই ভয়াবহ। কারণ অভিভাবকহীন অবস্থায় শরণার্থী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি নিগৃহিত ও নিপীড়নের শিকার হয়।
৯. শরণার্থী শিশুদের প্রায় অর্ধেকই পড়াশোনা বা স্কুলের বাইরে
শরণার্থী শিশুদের বেশিরভাগই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং এর বাইরে প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব এবং ঝরে পড়ার সামাজিক চাপের কারণে সেখানে উপস্থিতির হার কমে যায়।
১০. ইউক্রেনের বাইরে আরো ৩০টি অঞ্চলে চলমান সংঘাত শরণার্থী তৈরী করছে
দুই দশকের সংঘাতে সোমালিয়ায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়েছে। একই সময়ে গোষ্ঠীগত সহিংসতা এবং নিপীড়নের কারণে মধ্য আমেরিকায় সাত লক্ষ ২০ হাজারের অধিক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এদিকে মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশে সর্বশেষ আশ্রয় নিয়েছে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ।
১১. এক দশকের যুদ্ধে সিরিয়ায় পাঁচ লাখ ৭০ হাজার শরণার্থী তৈরি হয়েছে
গৃহযদ্ধের কারণে সিরিয়ার বহু সাধারণ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তুরস্ক, লেবানন, জর্ডান ও তার বাইরে আশ্রয় নিয়েছে অতিরিক্ত ৬.৭ মিলিয়ন বাস্তুচ্যূত সিরিয়ান। এছাড়া মোট ১৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।
১২. শরণার্থীদের সহায়তার ১০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘাটতি
ইয়েমেন, আফগানিস্তান এবং সুদানসহ বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক সংকটে থাকা দেশগুলো তাদের ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পেয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, তহবিলের অভাবে প্রয়োজনীয় যে প্রোগ্রামগুলোকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে সেগুলো হলো বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্য পরিষেবা সরবরাহ করা। ব্যাহত হওয়া অন্যান্য পরিষেবার মধ্যে রয়েছে শিশু সুরক্ষা, যৌন স্বাস্থের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং শিক্ষামূলক উদ্যোগসমূহ। সবমিলিয়ে এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ১০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘাটতি রয়েছে।
সূত্র: গ্লোবাল সিটিজেন