বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

বৈশ্বিক দুর্যোগকালীন শ্রম অভিবাসনের সুযোগ বৃদ্ধিতে কিছু সুপারিশমালা

কোভিড ১৯ মহামারির প্রকোপ শেষ হতে না হতেই ইউরোপ জুড়ে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন মহামারির প্রতিঘাতে জর্জরিত বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। ইউরোপের একাংশে ইউক্রেনীয় শরণার্থী সংকটের সঙ্গে প্রকট হয়ে উঠছে বিশ্ব বাণিজ্য, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক লেনদেন এবং অভিবাসী শ্রমিকদের উদ্বিগ্নতা ও জীবন যাপনে সংশয়।

বিশ্বব্যাপী আবারো দেখা গিয়েছে অভিবাসীদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন ও সীমান্ত অতিক্রমের জটিলতা, যা তাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ ও বটে। সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত ও সমন্বিত পদক্ষেপের ঘাটতির দরুন আমাদের দেশিয় নাগরিকগণ (যা অভিবাসী- শ্রমিক, ছাত্র, কিংবা চাকুরীজীবি) নিজ দেশে ফিরতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি শুধু যুদ্ধের জন্য নয়, বরং যে কোনো ধরণের মহামারি, বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ও দেখা যায়। তাই এই ধরণের পরিস্থিতির মোকাবেলা করা, পরিস্থিতির সাড়া প্রদান ও তার জন্য পূর্ববর্তী প্রস্তুতি রাখা আমাদের উচিত। এই সংক্রান্ত কিছু সম্ভাব্য করণীয় ও সুপারিশ উপস্থাপন করা এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।

করোনা মহামারি উত্তর বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসন, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ নিশ্চিতকরণে কিছু সুপারিশমালা ও সম্ভাব্য করণীয়:

১.প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য নিজ দেশে ও অবস্থানকারী বা গন্তব্য দেশে দুর্যোগকালীন সাড়া প্রদান, ঝুঁকি হ্রাস কৌশল ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন:

অভিবাসনে ইচ্ছুক, প্রবাস ফেরত ও অভিবাসী শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের দুর্যোগকালীন ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে সুশীল সমাজ, উন্নয়ন কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও নীতি নির্ধারকদের সমন্বয়ে ‘জরুরি সাড়া প্রদান ও ঝুঁকি হ্রাস কৌশলগত পরিকল্পনা’ প্রণয়ন। বিভিন্ন অডিও-ভিজ্যুয়াল, লিফলেট বা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে প্রাক-বহির্গমন ওরিয়েন্টশন বা অন্যান্য প্রশিক্ষণে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে করণীয় সম্পর্কে অবহিতকরণ।

বিদেশি মিশনের বা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দুযোর্গকালীন সাড়া প্রদানের (অভিবাসীর প্রত্যাবর্তন, ত্রাণ বিতরণ, আশ্রয়ণ সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা ও আইনগত সহায়তা) উপর প্রশিক্ষণ প্রদান ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ।

২. রেমিট্যান্স প্রেরণ ও অর্থনৈতিক লেনদেন প্রক্রিয়া ডিজটালাইজেশন ও সহজলভ্যকরণ:

ডিজিটাল লেনদেনকে (পোস্ট অফিস, মোবাইল ব্যাংকিং, ভিসা/ মাস্টার কার্ড) স্বল্প খরচে নিয়মিত ও সহজলভ্য করতে নীতি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রণয়ন।

তৃণমূল পর্যায়ে অভিবাসীদের প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বীকৃত মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রণয়ন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার উপর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য (ব্যাংক, মাইক্রোফিন্যান্স ইনস্টিটিউট, মোবাইল মানি ট্রান্সফার এজেন্ট, পোস্ট অফিস ইত্যাদির সমন্বয়ে) কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।

অধিক রেমিট্যান্স প্রেরণে উৎসাহিত করতে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা (যেমন জিরো রেমিট্যান্স কস্ট দিবস বা সপ্তাহ পালন, বিশেষ ডলার প্রাইজ বন্ড বা লটারি কুপন বিতরণ, পিপিপি এন্টারপ্রাইজ এর শেয়ার কুপন প্রদান।

৩. যেকোনো পরিস্থিতিতে গন্তব্য দেশে ও নিজ দেশে অভিবাসীদের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিকরণ:

প্রবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ও কর্মক্ষেত্র নিশ্চিতকল্পে গন্তব্য দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা।

অবস্থানকারী দেশে যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তিতে ইউনিভার্সাল হেলথ কার্ড ও ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যগত পরিচর্যা, বিভিন্ন মহামারিতে করণীয় ও ফাস্টএইড বিষয়ক প্রশিক্ষণ বা পিডিও প্রদানে গামকাকে অন্তর্ভুক্ত করা।

অভিবাসীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকল্পে নিজ দেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ (পিপিপি অর্থায়নে, যেখানে অভিবাসীদের এন্টারপ্রাইজ শেয়ার থাকবে)।

৪. প্রবাসী শ্রমিকদের জাতীয় ডাটাবেইজে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণ:

করোনা মহামারিকালীন প্রবাসীদের সহায়তা প্রদানকল্পে প্রবাসী হেল্পলাইনসহ বিভিন্ন দূতাবাস, প্রাইভেট ও এনজিও কর্তৃক পরিচালিত ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে (দ্বৈততা পরিহার করে) প্রবাসীদের ডাটাবেইজ তৈরি করা।

ডাটাবেইজে প্রদত্ত তথ্য অনুসারে অভিবাসীদের দক্ষতার স্বীকৃতি প্রদান (জাতীয় দক্ষতা কাঠামো অনুসারে) ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া।

৫. মানবপাচার ও অনিয়মিত অভিবাসন নিরুৎসাহিতকরণ ও প্রতিরোধে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ:

মানব ও শ্রমিক পাচার রোধে টাস্ক ফোর্সের (রেসকিউ, রিকভারি, রেপার্টরিএশন এন্ড ইন্টিগ্রেশন) সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অধিক কর্মযজ্ঞের ব্যপ্তি বৃদ্ধি করা।

বায়রার সঙ্গে যৌথভাবে ‘করোনা পরবর্তী দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রশমনে কৌশলগত পরিকল্পনা’ প্রণয়নে বিএমইটির উদ্যোগ গ্রহণ।
 

. বৈশ্বিক চাহিদা অনুসারে দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ ও অভিবাসনের প্রক্রিয়া তরান্বিতকরণ:

করোনা মহামারি পরবর্তীকালীন বৈশ্বিক চাহিদা অনুসারে স্বাস্থ্যখাতের কর্মী যেমন: নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ল্যবরেটরি টেকনিশিয়ান, হেলথ ইকুইপমেন্ট অপারেটর, হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট, হাসপাতাল ক্লিনার, ফার্মেসি এসিস্ট্যান্ট ইত্যাদি এবং কৃষিখাতের দক্ষ কর্মী (ল্যান্ড ফার্মার, হেভি মেশিন অপারেটর, ফুড প্রসেসিং মেশিন অপারেটর ইত্যাদি) তৈরিতে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে বিশেষ কারিকুলাম ও কোর্স চালু করা।

নতুন শ্রমবাজার তৈরি ও কর্মসংস্থানের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা।

৭. অভিবাসীর ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ:

প্রতারিত, বিদেশফেরত, দরিদ্র ও ঋণগ্রস্থ অভিবাসীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা, জীবন বীমা ও পেনশন কার্ড এর প্রচলন করা।

অভিবাসীর সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটগুলোতে বিশেষ বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কোটা ভিত্তিক আসন বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।

৮. জাতীয় ও মন্ত্রণালয় ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা হালনাগাদ ও অভিবাসী বান্ধবকরণ:

করোনা উত্তর অর্তনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ সাপেক্ষে রেমিটেন্স প্রবাহ, দক্ষ অভিবাসন ও কারিগরি দক্ষতা, উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি ও মন্ত্রণালয় ভিত্তিক পরিকল্পনা ৮ম জাতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য করে প্রণয়ন করা।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ নীতি বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় নতুন কৌশল ও লক্ষমাত্রা নির্ধারণ।

করোনা উত্তর অর্তনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ সাপেক্ষে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অর্জন ও বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন আনয়ন।

৯. দক্ষ ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকল্পে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরাম ও এ্যাসোসিয়েশনকে শক্তিশালীকরণ:

করোনা উত্তর অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা ও চাহিদা ভিত্তিক দক্ষ অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল করতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরাম, প্লাটফর্ম বা এ্যাসোসিয়েশন যেমন: কলম্বো প্রসেস, আবুধাবি ডায়লগ, গ্লোবাল ফোরাম ও মাইগ্রেশন এন্ড ডেভলপমেন্ট ইত্যাদির ভূমিকা শক্তিশালীকরণ।

আঞ্চলিক ও শ্রমিক প্রেরণকারী দেশের এসোসিয়েশন হিসেবে সার্ক এর ভূমিকা জোরদারকরণ ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে দক্ষ শ্রমিক রপ্তানিতে শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় ‘সার্ক মাইগ্রেশর সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা।

অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগে শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ‘ওআইসি এর স্ট্যান্ডার্ড এমওইউ অনুসরণ করা, ‘জেদ্দা ‍ডিক্লারেশন’ এর অনুমোদন ও অনুসরণ এবং ওআইসি এর ‘লেবার মার্কেট স্ট্রাটেজি ২০২৫’ অনুসরণ করা।

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা