বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

মুক্তিপণ না দিলে হত্যার হুমকি

ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী ৯ বাংলাদেশীকে ভূমধ্যসাগরে আটকে রেখে মুক্তিপণ চাইছে লিবিয়ার মাফিয়া চক্র

সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার ৯ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ভূমধ্যসাগরে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবী করছে লিবিয়ার একটি মাফিয়া চক্র। ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার পর গত বুধবার তাদেরকে আটক করে মুক্তিপণ দাবি করে চক্রটি। আটককৃতদের কয়েকজন তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন।

মাফিয়া চক্রটি ব্যাপক নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আটককৃতদের মাধ্যমে জানিয়েছে, আগামী সোমবারের মধ্যে জনপ্রতি সাড়ে আট লাখ টাকা দিতে ব্যর্থ হলে, সবাইকে হত্যা করে ভূমধ্যসাগরে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হবে।

বন্দি ৯ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর প্রত্যেকের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে। এর মধ্যে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমবাগ গ্রামের তিনজন রয়েছেন। তারা হলেন মো: সাজানুর রহমান (৩৬), মো. নাসির মিয়া (২১) ও আফজাল (২২)। এছাড়া রয়েছেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার নওবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা উজ্জ্বল (২৮)। বন্দি বাকি পাঁচজনের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি।

লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে বন্দিদের পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় অভিবাসী ডটকম এর। আটক মো. সাজানুর রহমানের ভাই মো. অছিউর রহমান গতকাল মাঝরাতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভূমধ্যসাগরের মধ্যে নৌযানে আটকে রেখে আমার ভাইকে লিবিয়ার মাফিয়ারা নির্যাতন করছে। হাঁত পা বেঁধে দুইজন তাকে ক্রমাগত মারছে। মাফিয়ারা আমার ভাইয়ের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে, কোনো খাবারও খেতে দিচ্ছে না, ও এখন মৃত্যুশয্যায়। অন্যদিকে দুইজন মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যত যা করার দরকার তা করছে। কিছুক্ষণ পর পর ফোন করে আমার ভাইকে দিয়ে কথা বলিয়ে আমাদের কাছে মুক্তিপণ চাইছে। তারা বলেছে, সোমবারের মধ্যে সাড়ে আট লাখ টাকা না দিলে আমার ভাইসহ অন্যদের হত্যা করে ভূমধ্যসাগরে লাশ ভাসিয়ে দেবে। এর বাইরে অন্য কোনো কথা বলতে দিতে চাইছে না তারা।’

ভূমধ্যসাগরে মাফিয়াদের হাতে বন্দি মো: সাজানুর রহমানের পাসপোর্ট (৩০)।

মো: অছিউর রহমান জানিয়েছেন, তার ভাই মো: সাজানুর রহমানের সঙ্গে সিলেটের আরো যে আটজন বন্দি রয়েছেন, তাদের ওপরও একইভাবে মুক্তিপণের দাবিতে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশী মাফিয়ারা।

সন্তানকে আটকে রেখে নির্যাতনের কথা শুনে অসুস্থ হয়ে মৃতশয্যায় রয়েছেন মোহাম্মদ সাজানুর রহমানের বৃদ্ধ বাবা-মা। সাজানুরের স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশু সন্তান রয়েছে। সাজানুরের বয়স ৩০ বছর।

জনাব অছিউর রহমানের কথার সূত্র ধরে আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা অভিবাসী ডটকম এর। ২১ বছর বয়সী মো. নাসির মিয়ার বাবা শেরেকুল মিয়া বিলাপ করে আজ সকালে বলেন, ‘আমার বুকের ধনকে ওরা মেরে ফেলবে। অনেক নির্যাতন চালাচ্ছে ওর ওপর। দয়া করে আমার ছেলেটাকে বাঁচান।’

ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশী আফজালের বাবা ফজলু মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে স্বচ্ছল হবে, আমাদের সুখে রাখবে। আমি কী ওর মুখ আর দেখতে পারবো?’ জনাব ফজলু জানান, আজ সকালেও ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। সেসময় বারবার সোমবারের মধ্যে মুক্তিপণের টাকা দেয়ার জন্য মিনতি করেছিলেন আফজাল।

বন্দি উজ্জ্বলের শ্বশুর মো. ফারুক মিয়া বলেন, ‘ধার দেনা করে আমাদের না জানিয়েই উজ্জ্বল বিদেশ চলে গিয়েছিল। আমার মেয়ের একটি বাচ্চা সন্তান রয়েছে, ওর কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে এদের কী হবে!’

মাফিয়াদের হাতে বন্দিদের পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারা বলেছেন, তাদের হাতে কারোরই নগদ টাকা নেই। একারণে মুক্তিপণের অর্থ জোগাড় করতে তারা জায়গা-জমি বিক্রি করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন।

আরো পড়ুন:

এ বছর ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ ১৬০০ অভিবাসন প্রত্যাশী

বন্দি অভিবাসন প্রত্যাশীদের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, বাংলাদেশি দালাল ও মাফিয়াদের হাতেই আটক রয়েছেন তাদের স্বজনরা। এর মধ্যে সাজানুর তার ভাইকে ফোন মারফত জানিয়েছেন, তাকে যে চক্রটি আটক করেছে, তাদের অন্যতম হোতা হলেন হবিগঞ্জের বাসিন্দা তৈমুর মিয়া নামের একজন। এই তৈমুর মিয়ার প্রলোভনে পড়েই ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাজানুর।

ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা কোনোভাবেই থামছে না। গত এপ্রিলেও লিবিয়ার উপকূলে একটি নৌযান থেকে ৫০০ বাংলাদেশীসহ ৬০০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে আটক করে দেশটির কোস্টগার্ড।

ভূমধ্যসাগর দিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের ইউরোপে যাওয়া প্রসঙ্গে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এর প্রধান শরিফুল হাসান অভিবাসী ডটকমকে বলেন, ‘ইউরোপে প্রবেশের জন্য অভিবাসন প্রত্যাশীদের অন্যতম পছন্দের রুট ভূমধ্যসাগর। যথারীতি মাফিয়া চত্রের কাছেও মানব পাচারের অন্যতম নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় রুট হয়ে উঠেছে এই ভূমধ্যসাগর। অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে অঞ্চলটিতে নজরদারি বাড়ানো স্বত্বেও কোনোভাবেই তা থামানো যাচ্ছে না।’

আরো পড়ুন:

ভূমধ্যসাগর ‘ডুবে’ গেছে, বেলারুশ-পোল্যান্ড জেগে উঠেছে

ভূমধ্যসাগরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসন প্রত্যাশীর উপস্থিতি প্রসঙ্গে জনাব শরিফুল হাসান বলেন, ‘আমাদের দেশের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষ অনিয়মিত উপায়ে ইউরোপ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরকে বেছে নেয় এবং এই আগ্রহ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যা সত্যিই উদ্বেগজনক। এর মধ্যে ফরিদপুর, মাদারিপুর ও শরিয়তপুর এবং সিলেটের হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের উল্লেখযোগ্যসংখক মানুষ রয়েছে।’

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এর প্রধান ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ জনাব শরিফুল ইসলাম আরো বলেন, ‘অনিয়মিত উপায়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে ঢোকা যে খুবই বিপজ্জনক ও ভয়াবহ এ বিষয়টি সবার আগে এ মানুষগুলোর পরিবারের সদস্যদের উপলব্ধী করতে হবে এবং তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনে নিরুৎসাহিত করতে। অন্যদিকে ফরিদপুর ও সিলেট অঞ্চলের মতো অভিবাসনপ্রবণ এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনিয়মিত উপায়ে বিদেশগমণ ঠেকাতে আরো সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা