যুদ্ধ, নিপীড়ন, জ্বালানি খাদ্য ও অন্যান্য সঙ্কটের কারণে বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যূত মানুষের সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১০ কোটি ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যূতির সংখ্যা এ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে উল্লেখ করে জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, এই যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট খাদ্য সঙ্কটের জন্য আরো বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হতে পারে।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার বাস্তুচ্যূতি সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের শেষের দিকে নিপীড়ন, সংঘাত, অপব্যবহার এবং সহিংসতার ফলে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৯.৩ মিলিয়ন মানুষ বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে আরো এক একটি ৪০ লাখ মানুষ সেই সংখ্যায় সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অবরুদ্ধ শস্য রপ্তানি এবং ব্যাহত ফসলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে অন্যত্র আরো বাস্তুচ্যুতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি।
আরো পড়ুন:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি ৩ জনের একজন বাস্তুচ্যূত হবে!
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি এই সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুদ্ধ, মানবাধিকার, জলবায়ু সব কিছুর উপরে যদি খাদ্যের সঙ্কট থাকে- তবে তা এই প্রতিবেদনে আমি যে প্রবণতাসমূহের উল্লেখ করেছি সেগুলোকে ত্বরান্বিত করবে। এবং এটি পরিসংখ্যানের একটি “বিস্ময়কর” ধারণা।
তিনি আরো বলেন, ‘এটি দ্রুত সমাধান না হলে স্পষ্টতই প্রভাবটি বেশ বিধ্বংসী হবে। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি এবং হিংসাত্মক বিদ্রোহের ফলে ইতোমধ্যেই আরো বেশি মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে এটি ভয়াবহতার রূপ ছাড়িয়ে যাবে।’
জাতিসংঘের মতে, ‘নিজ দেশের সীমানার মধ্যেই বাস্তুচ্যূত মানুষের সংখ্যা গত ১০ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।’ গ্র্যান্ডি বলেন, ‘গত দশকের প্রতি বছরেই এই সংখ্যা আরোহণ হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে এই মানবিক ট্র্যাজেডি মোকাবিলা করার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নিতে হবে। সংঘাতের সমাধান এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সবাইকে একত্রিত হতে হবে। নয়তো এই ভয়ানক প্রবণতা অব্যাহত থেকেই যাবে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, রেকর্ড অনুযায়ী ২০২১ সালের শেষে প্রায় ২৭.১ মিলিয়ন মানুষ শরণার্থী হিসাবে বসবাস করেছে। যেখানে আশ্রয়প্রার্থীদের মোট সংখ্যা এখন ১১ শতাংশ বেড়ে ৪.৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
আরো পড়ুন:
উদ্বাস্তু শিল্পের সৌন্দর্য
টানা ১৫ বছর ধরে চলমান সংঘাতের কারণে নিজ দেশে বাস্তুচ্যূত হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৫৩.২ মিলিয়নে পৌঁছেছে। ইউএনএইচসিআর বলেছে যে, গত বছরটি আফগানিস্তানের মতো দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের মুখোমুখি দেশগুলিতে সহিংসতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন অস্থিরতার উত্থানের জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল।
গ্র্যান্ডি ইউক্রেনীয়দের পালানোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে তাদের স্বাগত জানিয়েছেন। তবে সিরিয়া এবং আফগানিস্তানের মতো দেশগুলিতে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা লোকদের সঙ্গে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে এ ঘটনার বৈপরীত্য রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি ইউক্রেনকে প্রদত্ত সম্পদের ‘একচেটিয়া’ বলে অভিহিত করার সমালোচনাও করেছিলেন।
ইথিওপিয়ায় দুই বছরের পুরনো সংঘাত এবং আফ্রিকার হর্নে খরার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যেন আমাদের অন্য সঙ্কট ভুলে না যায়। শরণার্থী সঙ্কটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া ‘অসম’ হয়েছে বলে গ্র্যান্ডি মনে করেন। তিনি শরণার্থীদের ছোট দল এবং অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া নিয়ে দেশগুলোর দ্বন্দ্ব উল্লেখ করে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের প্রতি ইইউ দেশগুলির উদারতার সঙ্গে তুলনা করেছেন।’
আরো পড়ুন:
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাস্তুচ্যুতি: দশ বছরের দশটি কৌশল
তিনি আরো যোগ করে বলেন, ‘অবশ্যই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রমাণ করে, উদ্বাস্তু আগমনে সাড়া দেওয়া, ধনী দেশগুলির উপকূলে বা সীমান্তে মরিয়া হয়ে বাস্তুচ্যূতদের আগমন নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। কারণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলি ২০২১ সালের শেষে বিশ্বের ৮৩ শতাংশ শরণার্থীকে স্বাগত জানিয়েছে।’
সূত্র: আল জাজিরা