অভিবাসীদের কল্যাণ কি শুধু অভিবাসীদের অর্থেই সীমাবদ্ধ?

0
1047
ছবি: গেটি ইমেজ

আমিনুল হক তুষার

অভিবাসী শ্রমিকদের নিজ দেশের অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতি প্রদান, তাদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সব উদ্যোগ তুলে ধরতে প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদা ও আয়োজনের সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস’ পালন করা হয় । যদিও দিবসটি পালনের মূল উদ্যোগটি গ্রহণ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, যাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌথভাবে পালন করে রিক্রুটিং এজেন্সির এসোসিয়েশন (বায়রা) এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক। কিছু বিদেশ ফেরত প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবার এই দিবস পালনে অংশগ্রহণ করলেও সিংহভাগ প্রবাসীর পরিবারই দিবসটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় আজও। এমনকি তাদের অনেকেই প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণার্থে সরকারের গৃহীত নানান ধরণের কর্মসূচি সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখেন না।

বিএমইটির পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫-৭ লক্ষ লোক বিদেশ যান, যার মধ্যে নারী অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যদিও এই বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে মাত্র দুই লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন শ্রমিক অভিবাসন করতে পেরেছেন। তারপরও বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুসারে বাংলাদেশ হতে শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বর্তমানে যদি বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রায় এক কোটির অধিক কর্মী কর্মরত থাকেন, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় তাদের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল কমপক্ষে তিন-চার কোটি মানুষ বা তারও বেশি। এই সব স্বল্প শিক্ষিত বা আধা দক্ষ শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের জন্য আজ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পূর্বের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সরকার করোনা মহামারির প্রকোপ থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য নানান ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা অবশ্যই অত্যাবশকীয় ছিল- বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্থ ও বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের জন্য। তাদের জন্য ত্রাণ ও জরুরি উপহার সামগ্রী বিতরণ, জরুরি আর্থিক সহায়তা, এমনকি ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ প্যাকেজও চালু করেছে সরকার। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়, বরং সমস্যা হচ্ছে তার সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থাপনায় ও প্রবাসীদের কল্যাণার্থে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়ন কৌশলে। তাছাড়া সরকারি বরাদ্দের উৎসসমূহও একটি বিষয়, যা সম্পর্কে অভিবাসীদের ওয়াকিবহাল থাকা উচিত।

অভিবাসী শ্রমিকরা ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স নেয়ার জন্য সরকারি তহবিলে একটি নির্দিষ্ট অংকের ফি জমা দেয় (সরকারি সিটিজেন চার্টার অনুসারে তা তিন হাজর ৫০০ টাকা) – যা কল্যাণ ফি নামে পরিচিত। যদিও বেশির ভাগ অভিবাসী শ্রমিক জানেন না, এই টাকা তাদের কল্যাণের জন্যেই নেয়া হয়! এছাড়া অনেক অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবার অভিবাসীদের কল্যাণে সরকার জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এর মাধ্যমে কি কি সেবা দিয়ে থাকে সেই ব্যাপারেও বলতে গেলে খুব কম ধারণা রাখেন তারা। যদিও কিছু কিছু এনজিও বা উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে তারা সেই সহায়তা বা সেবাগুলো পেয়ে থাকেন, কিন্তু সিংহভাগের কাছেই তা বলতে গেলে অজানা। শুধু তাই নয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেও তারা তা প্রাপ্তির জন্য খুব একটা আগ্রহী থাকেন না।

বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে এই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। আমরা জানি, অভিবাসী শ্রমিকরা কল্যাণ ফি হিসেবে জনপ্রতি তিন হাজার ৫০০ টাকা সরকারি তহবিলে নিজে অথবা তাদের এজেন্সি কর্তৃক জমা দেন, যা বার্ষিক অভিবাসীদের সংখ্যার বিচারে বিশাল অংকের টাকা। বিএমইটি ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এর বার্ষিক প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৫ হতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের কল্যাণ তহবিলে জমাকৃত অর্থ তাদের কল্যাণার্থে (মৃত কর্মীর দাফন, আর্থিক সহায়তা, সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত) ব্যয়কৃত অর্থের চেয়েও বেশি।

যেমন, ২০১৬ সালে ব্যায়কৃত (কল্যাণার্থে) অর্থ ছিল আনুমানিক ২১৬৫.৪৬ মিলিয়ন টাকা, যার বিপরীতে জমাকৃত কল্যাণ ফি ছিল ২৬৫২.০৫ মিলিয়ন টাকা। একই ভাবে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ এ ব্যয় ছিল যথাক্রমে: ১৮৪২.৯৪ মিলিয়ন, ১৯৩৪.৪৪ মিলিয়ন, ও ১৯৯৪.৬৩ মিলিয়ন টাকা। যার বিপরীতে আদায়কৃত কল্যাণ ফি ছিল (আনুমানিক) যথাক্রমে: ৩৫২৯.৮৩ মিলিয়ন, ২৫৬৯.৬৩ মিলিয়ন ও ২৪৫০.৫৫ মিলিয়ন টাকা। (সূত্র: বিএমইটি ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদন )

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে অভিবাসীরা সরকারি তহবিলে কল্যাণ ফি হিসেবে যতটা দিচ্ছেন তা দিয়েই মূলত তাদের কল্যাণ ব্যয় মিটানো হচ্ছে। আবার বিদেশে অবস্থিত মিশনসমূহের জন্য বরাদ্দও এই তহবিল থেকেই দেয়া হয়। পারতপক্ষে, সরকারি পৃথক কোনো বরাদ্দ তাদের কল্যাণে রাখা হচ্ছে না বা তার প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে অনুভূত হচ্ছে না।

অন্যদিকে, বছরভিত্তিক অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা, মৃতদেহ আনয়ন, পরিবহন ও সৎকার ব্যয় এবং আর্থিক সহায়তার পরিসংখ্যানেও অসমতা পাওয়া যায়। যেমন, সরকারি হিসেবে ২০১৬ সালে মোট ৫ হাজার ১০৫ জন অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। যাদের ভিতর ২ হাজার ৯৫১ জন মৃতদেহ পরিবহন ও সৎকারের জন্য অনুদান পেয়েছেন। আর ১ হাজার ১৪২ জন মৃত শ্রমিকের পরিবার পেয়েছেন আর্থিক সহায়তা। একইভাবে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মৃত অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে: ৩ হাজার ৫০৫, ৩ হাজার ৯৪২ ও ৪ হাজার ৭৭ জন।

সূত্র: বিএমইটি ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদন

এর বিপরীতে আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ এ যথাক্রমে: ৯৫৫, ১০৫৮ ও ৮৬০ জন। আবার পরিবহন ও সৎকারের অনুদান পেয়েছিলেন যথাক্রমে: ৩ হাজার ২৬৩, ৩ হাজার ৬৭৬ ও ৩ হাজার ৬৫৮ জন। তার মানে, কিছু সংখ্যক অভিবাসীর পরিবার হয় কল্যাণার্থে বরাদ্দকৃত অর্থ পাচ্ছেন না অথবা বিভিন্ন জটিলতার কারণে সময় মতো নিতে পারছেন না।

অন্যদিকে দেখা যায়, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক (যা সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অভিবাসী কর্মী ও প্রবাসীদের জন্য একটি বিশেষায়িত ব্যাংক) থেকে ঋণ বিতরণও করা হচ্ছে প্রবাসীদের কল্যাণ বোর্ডের টাকা থেকে, তাও ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায়, প্রবাসী বা বিদেশ ফেরত কর্মীদের কোনো কাজে আসছে না বা ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া জটিল হওয়াতে তারা তা গ্রহণে আগ্রহী হচ্ছে না। ২০১৭ -২০১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত দেখা যায়, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ৪০০ কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে ৩৮০ কোটি টাকাই কল্যাণ তহবিলের দেয়া। এছাড়াও দেখা যায়, প্রবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লিগ্যাল এইড সহায়তার জন্য খুবই কম বরাদ্ধ।

উপরন্তু যেসব ডকুমেন্টেশন বা ফর্ম তাদের ওই সেবাসমুহ প্রাপ্তির জন্য পূরণ করতে হচ্ছে তার উপরও তাদের অনেক সময় পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। এর ফলে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে তাদের ভরসা করতে হচ্ছে অন্যদের উপর। ফলে এখানে অনুপ্রবেশ ঘটেছে একশ্রেণীর মধ্যসত্বভোগীর। তৃণমূলপর্যায়ে অভিবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে কল্যাণ সহায়তা প্রাপ্তিতে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সত্যিকার অর্থে সরকারের উদ্যোগ খুবই সীমিত। ফলে তারা বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি কল্যাণ সেবা প্রাপ্তি হতে। 

তাই আজ একটি প্রশ্ন থেকেই যায়-এই সব কল্যাণ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য কি শুধু অভিবাসীদেরই অর্থের যোগান দিতে হবে, নাকি সরকারও তার রাজস্ব তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখবে? জাতীয় বাজেটে বরাবরই প্রবাসীদের জন্য স্বল্প বরাদ্দ থাকে, যতটুকুও থাকে তার সিংহভাগই ব্যয় হয় প্রশাসনিক বা অবকাঠামোগত খাতে। যেমন ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৪১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ০.১১৩ শতাংশ। অভিবাসী কল্যাণে বলতে গেলে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ থাকেই না। যারা দেশের অর্থনীতিতে করোনাকালীন সময়ে মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছে তাদের জন্য কি রাষ্ট্র কিছুই করবে না আগামী বছরগুলোতে?

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here