ইসলাম আমার সাংস্কৃতিক পটভূমি গঠন করেছে- আব্দুলরাজাক গুরনাহ

0
667
আব্দুলরাজাক গুরনাহ

নোবেল কমিটি ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে ব্রিটিশ-তানজানিয়ান ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহকে নির্বাচিত করেছেন। নির্বাচকগন মূলত, ‘উপনিবেশবাদের প্রভাব ও সংস্কৃতি এবং মহাদেশসমূহের মধ্যে উপসাগরীয় অঞ্চলের উদ্বাস্তুদের ভাগ্যের আপোষহীন ও সহানুভূতিশীল চিত্র উপস্থাপনের জন্য গুরনাহকে বেছে নিয়েছিলেন।’ সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৪০তম শারজাহ আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রশংসিত এই লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইজিপশিয়ান সংবাদপত্র আল আহরাম। পাঠকেদের জন্য সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন অনন্যা দাশ

আহরাম: আপনার উপন্যাসগুলিতে দেখা যায় গল্পের প্রধান চরিত্ররা ইতিহাস পুনর্লিখন করে। তারা স্বাধীনতা, পুরানো বিশ্বাসঘাতকতা এবং নতুন আনুগত্যের মধ্যে দিয়েই তাদের টিকে থাকার গল্পগুলি বর্ণনা করে থাকে। আসলে আপনি আপনার গল্পের নায়কদের মাধ্যমে কী বলতে চান?

গুরনাহ: হ্যাঁ, এটা সত্যি। আমি মনে করি যে, আমি জেনেশুনেই তাদের এভাবে তৈরি করতে চেয়েছি।কঠিন পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতা ও কষ্টের মধ্যেও টিকে থাকার ক্ষমতা নিয়ে কিভাবে মানুষ বেঁচে থাকে, আমি সেটি নিয়ে কিছু বলতে চেয়েছি। আমি নিশ্চিত নই যে, আমার গল্প বলার ধরণ ব্যতিক্রমী কিনা। তবে আমার বিশ্বাস অন্যরাও তাদের নিজস্ব উপায়ে গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। তাই এটাকে আমি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বলে মনে করি। এজন্য আমার লেখাকে অনন্য বলে দাবি করি না। আমি মনে করি যে অন্য যারা এই বিষয়ে লিখেছেন তারাও ইউরোপে আসার অভিজ্ঞতা এবং ভিনদেশী হিসেবে অন্য এক জায়গায় এসে শেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছেন।

আহরাম: তাহলে আপনার গল্পের চরিত্রগুলো বাস্তবের চরিত্র। আপনি কি আপনার জন্মভূমিতে তাদের দেখা পেয়েছেন এবং আপনার স্মৃতি থেকে তাদের কল্পনা করেছেন বা আপনি ব্রিটেনে যাওয়ার পর তাদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন?

গুরনাহ: তাদের কেউ কেউ আমার শৈশবের স্মৃতি থেকে উঠে এসেছে। আমি অনেকবার জাঞ্জিবারে ফিরে এসেছি। যাইহোক, আমি বিশ্বাস করতে চাই যে এই চরিত্রগুলি এবং তাদের অভিজ্ঞতা অন্য কোথাকারও হতে পারে, কারণ আমি যা জানি তা নিয়েই লিখি। তবে আমি বেশিরভাগ সময়েই অন্য জায়গা থেকে আসা এবং একই রকম পরিস্থিতি এবং অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া মানুষদের অভিজ্ঞতার বিষয়ে পড়ি । বলা যায় এই গল্পগুলো দিয়েই আমার বেড়ে ওঠা। আমি এমন মানুষদের মাঝে ছিলাম যারা নিজেরা সেইসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন এবং সেটা নিয়ে কথা বলেছেন।

আহরাম: আসলে আপনার উপন্যাসগুলি আরব বিশ্বের মানুষদের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে যারা ঔপনিবেশিকতার ভুক্তভোগী ছিলেন ও আছেন এবং যাদের আশ্রয় খুঁজে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে যেমন প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য দেশে। সম্ভবত এটি আপনার উপন্যাসগুলিকে আরও মানবিক এবং উদ্দীপক করে তুলেছে। আমি ভাবছি একজন লেখক হিসেবে আপনি কীভাবে এই আবেগ এবং মানুষের অভিজ্ঞতাগুলোকে এত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করতে পারেন, যা আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘আফটার লাইফ’-এ স্পষ্ট ছিল?

গুরনাহ: আমি বিশ্বাস করতে চাই যে আমার উপন্যাসগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করে। যাইহোক, যুদ্ধ বা ঔপনিবেশিকতার নৃশংসতা সম্পর্কে লেখালেখিতে আমার আগ্রহ ছিল না। বরং আমি যুদ্ধ এবং ঔপনিবেশিকতার প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে এবং বুঝতে চেয়েছিলাম। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে বেড়ে ওঠা মানুষ, যাদের পরিপূর্ণ অস্তিত্ব রয়েছে এবং যারা বিভিন্ন উপায়ে প্রতিরোধ করতে ও বেঁচে থাকতে সক্ষম তাদের গল্প তুলে ধরতে চেয়েছি। আমি দেখাতে চেয়েছি, কীভাবে মানুষ মানিয়ে নেয়, যারা এই পরিস্থিতির আলোকে যুদ্ধ এবং এমনকি জীবন নিয়েই পীড়িত ছিল।

আহরাম: আপনার কথার সূত্র ধরেই আমি পরবর্তী প্রশ্নের দিকে যাচ্ছি; আপনার উপন্যাসগুলিতে দেখা যায় যে কীভাবে স্মৃতি থেকে ইতিহাস মুছে যায়। এই যে উপন্যাসের মধ্য দিয়ে স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলা, এটি পশ্চিমা স্টিরিওটাইপ গল্পের ন্যারেটিভকে কতোটা চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং ভুলে যাওয়া বা ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে ফেলা ইতিহাসকে আলোকিত করতে পারে?

গুরনাহ: অনেক আফ্রিকান দেশ বিভিন্ন কারণে একবারে অনন্য উপায়ে উপনিবেশবাদের মোকাবিলা করেছে। এক্ষেত্রে খুঁটিনাটি ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে স্মৃতিটাকে সম্মিলিতভাবে ব্যবহার করার বিষয়ে আমি একরকম দ্বিধাগ্রস্ত। তা সত্ত্বেও, এই ধরনের কিছু বিষয়ে জ্ঞাত হতে আন্তর্জাতিক মনোভাব নিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলা একটি ভাল উপায়। অবশ্যই, এটি অর্জনের জন্য সাহিত্যকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আহরাম: আপনার চরিত্রে আরবি ও ইসলামিক নাম রয়েছে এবং মনে হচ্ছে আপনি পবিত্র কোরআন এবং আরব্য রজনীর গল্প দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আপনি কীভাবে এই সমস্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন আর সেটা আপনার জীবনের কোন পর্যায়ে ঘটেছিল এবং আপনি কি আরব ঔপন্যাসিকদের লেখা পড়েন, যদি পড়ে থাকেন তাহলে কোন লেখকদের?

গুরনাহ: আসলে আমি আরবি জানি না এবং আরবি উপন্যাসও খুব একটা পড়িনি, খুব কম, যেগুলো আমি কাকতালীয়ভাবে অনুবাদ হিসেবে পড়েছি এবং এখন নির্দিষ্ট নাম মনে নেই। কিন্তু আমি সত্যিই বলতে চাই যে ইসলাম আমাকে এই সমস্ত নাম দিয়েছে এবং আমার সাংস্কৃতিক পটভূমি তৈরি করেছে যেটা ঠিক আরবি সংস্কৃতি নয় যদিও পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায় লেখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের এলাকায়, আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে জানজিবারে, আমরা আমাদের চারপাশের বিশ্বের সঙ্গে এবং সেখানে অবস্থিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যেমন সৌদি আরব, সোমালিয়া, ভারত এবং অন্যান্য। তাই, এটা মোটেও বিচিত্র কিছু নয় যে, জাঞ্জিবারের প্রত্যেকেই, সেটা মুসলিম হোক বা অমুসলিম, ইসলামিক নাম বহন করে।

ইসলাম আমার সাংস্কৃতিক পটভূমি গঠন করেছে

আব্দুলরাজাক গুরনাহ

আহরাম: আপনার উপন্যাসগুলিতে সর্বদা নায়কদের আকাঙ্খা এবং দ্বিধা প্রতিফলিত হয় যেখানে আফ্রিকার ঔপনিবেশিক লেবাস ঝেড়ে ফেলে তার ঐতিহ্যের মাধ্যমে নিজের জন্য একটি নতুন পরিচয় তৈরির সংগ্রাম উঠে আসে। আপনার মতে এক্ষেত্রে আফ্রিকা কতটা সফল হয়েছে?

গুরনাহ: যখন আমি একটা সত্ত্বা তৈরির কথা ভাবি, তখন আমি ভাবি যে মানুষ সবসময় নিরাপদে থাকুক। মানুষ এমনই, আপনি জানেন, তাদের দক্ষতা এবং জীবনের অভিজ্ঞতা একেক জনকে একেক রকমভাবে গড়ে তোলে। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার কারণে তাদের শিক্ষার ধরণে কিছুটা পরিবর্তন এসছে বলে মনে হচ্ছে।

আরো পড়ুন
কাঁটাতার দিয়ে নয়, সহানুভূতির সঙ্গে অভিবাসীদের স্বাগত জানানো উচিত’-আব্দুলরাজাক গুরনাহ

কিন্তু আমি নিশ্চিত নই যে উপনিবেশিকতা একজনের পরিচয়ের ভিত্তিকে সম্পূর্ণরূপে নাড়িয়ে দেয়। হ্যাঁ, এটি আপনাকে আপস করতে বাধ্য করতে পারে কিন্তু অবশেষে আমাদের ভাবতে হবে যে মানুষ তাদের মূল্যবান জিনিসগুলিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে কতটা সফল?

এটি এমন একটি সমস্যা যেটা প্রতিটি সংস্কৃতিকেই সাথে নিয়ে বাঁচতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডে কিছু লোক আছে যারা বলে, ‘আমরা আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছি কারণ এই সব বিদেশিরা আমাদের কাছে আসছে।’ তাই আমি বিশ্বাস করি যে এটিই স্বাভাবিক এবং মনে করি না যে এটি এমন একটি সমস্যা যেটা নিয়ে উদ্বেগের প্রয়োজন আছে। কারণ সংস্কৃতি বিকাশ এবং বৃদ্ধি পায়। সাধারণত, সংস্কৃতি এমন উপায়ে ছড়িয়ে যায় এবং বিকশিত হয় যে, পরিস্থিতি মানুষের জন্য নিরাপদ না হলে, তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং বিনষ্ট হয়ে যায়।

আহরাম: আপনার ‘এডমায়ারিং সাইলেন্স’ উপন্যাসে বর্ণবাদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে পরিচয় রক্ষা করতে এবং অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে উদ্বাস্তুদের জন্য একটি প্রতীক এবং কৌশল হিসাবে নীরবতাকে কাজে লাগানোর ধারণাটি এসেছে, কীভাবে?

গুরনাহ: আপনি বলতে পারেন যে দুর্বল মানুষের কাছে নীরবতাই শেষ অবলম্বন। নীরবতাই একমাত্র উপায় হতে পারে যার মাধ্যমে আপনি আক্রমণের শিকার হলে নিজেকে বাঁচাতে পারেন। আমি আমার ‘বাই দ্য সি’ উপন্যাসে এটি খোলাসা করেছি। যেখানে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, আক্ষরিক অর্থে নিরাবতা শব্দটি নিজেই প্রতিরোধ শব্দের বিরোধী হতে পারে, কিন্তু একইভাবে নীরবতা নিজেই প্রতিরোধের একটি রূপ হয়ে উঠতে পারে।

আহরাম: আপনি ‘ডটি’ তে উদ্বাস্তু এবং অভিবাসীদের অভিজ্ঞতার উদাহরণ তৈরি করে এমন কিছু দ্বন্দ্ব প্রকাশ করেছেন। আপনি দেখিয়েছেন, কীভাবে জাতি, শ্রেণী এবং লিঙ্গভেদের স্তরগুলি ক্ষমতার প্রকৃতি এবং মাত্রা নির্ধারণ করতে পারে? কীভাবে এই স্তরগুলো আপনার উপন্যাসের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত হতে পারে এবং তারা আপনার গল্পের চরিত্রগুলোর পরিচয়কে কতটা প্রভাবিত করেছিল?

গুরনাহ: এই উপন্যাসে, আমি দুর্বল ব্যক্তিত্বদের নিয়ে কাজ করেছি, যারা পরিস্থিতির কারণে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল যাতে তারা কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে, কীভাবে তারা মানিয়ে নিতে পারে, কীভাবে তারা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে রক্ষা করতে।

আহরাম: আমি আপনাকে এটা জিজ্ঞেস না করে আমাদের কথোপোকথন শেষ করতে পারছি না- আফ্রিকান সাহিত্য সামাজিক পরিবর্তন এবং সমাজের রূপান্তরগুলোকে প্রতিফলিত করতে কতটা সফল হয়েছে? আফ্রিকান সাহিত্যে বিশেষায়িত একটি সাময়িকীর একজন সমালোচক এবং সম্পাদক হিসাবে আপনার মতামত কী?

গুরনাহ: আমি আগেই বলেছি যে আফ্রিকাতে প্রচুর সৃজনশীল মানুষ আছেন যাদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা রয়েছে যা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের পাঠকদের অবাক করে দিতে পারে। প্রকাশকরা সম্প্রতি আফ্রিকান সাহিত্যের দিকে নজর দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু অন্যদিকে, সাহিত্যের পাশাপাশি আফ্রিকানদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, একটি নির্দিষ্ট সমাজের সংস্কৃতিতে সাহিত্যের ভূমিকা ও প্রভাব কি।

সাহিত্য এমন একটি বিষয় যা একটি সমাজ থেকে অন্য সমাজে ভিন্ন হয়ে থাকে। যাইহোক, এই সবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সাহিত্য, আলোচনা এবং ধারনা ভাগ করার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপায় বাতলে দেয়। এই ধারণাগুলি ভিতর থেকে এবং বাইরে থেকে আসে। সাহিত্য সেটাই করে।

দীর্ঘ সময় ধরে, আমরা আত্ম-মমতায় নিমগ্ন ছিলাম এবং নিজের সম্পর্কে এবং আমরা কী পড়ি তা নিয়ে ভাবছিলাম। আমার মতে, সাহিত্যের উচিত নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কিছু রোল মডেল উপস্থাপন করা, যেমন ধরুন, সামাজিক নীতি বা অগ্রগতি বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উন্নয়ন ও উন্নতির বিষয়ে। এটি তার সাফল্যের মূল্যায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here