‘কাঁটাতার দিয়ে নয়, সহানুভূতির সঙ্গে অভিবাসীদের স্বাগত জানানো উচিত’-আব্দুলরাজাক গুরনাহ

0
589
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ


এবছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ বলেছেন, কাঁটাতার দিয়ে নয়, বরং ইউরোপের উচিত সহানুভূতির সঙ্গে অভিবাসীদের স্বাগত জানানো। এছাড়া অভিবাসন প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের নীতির কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আচরণ ‘অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক’। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর গতকাল বৃহস্পতিবার ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবারিতে রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গুরনাহ এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।

গুরনাহ তার গ্রন্থসমূহে বাস্তুচ্যূত মানুষের ওপর সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব তুলে ধরার জন্য পরিচিতি পেয়েছেন। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সুইডিশ একাডেমি গুরনাহকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফোন করলে তিনি নাকি খুবই অবাক হয়েছিলেন। কারণ তার কাছে সেই ফোন কলটি নাকি সম্পূর্ণ ‘অপ্রত্যাশিত’ ছিল।

তানজানিয়ায় জন্মগ্রহণ করা আব্দুলরাজাক গুরনাহ শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ড পাড়ি জমান। ১৯৮৭ সালে প্রথমবারের মতো তার উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তিনি তার উপন্যাসে ক্রমাগতভাবে বাস্তুচ্যূত মানুষের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন।

গুরনাহ কাব্যময়তার মধ্য দিয়ে অভিবাসন বিষয়ক অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করেছেন। কীভাবে মানুষ পরিবার থেকে আলাদা হয়, কীভাবে নতুন একটি পরিবেশে মানুষ জীবন গোছানোর চেষ্টা করে এবং কীভাবে অভিবাসীরা কোনো একটি সমাজের মধ্যে থেকেও নিজেকে প্রতিনিয়ত অপর বা বিদেশি ভাবে-এসব কিছুই সূক্ষভাবে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন।

রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে গুরনাহ সাফ বলেছেন, তিনি নিজেই অনুভব করেছিলেন যে, ব্রিটিশ সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছে। ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবারিতে তার বাসভবনে বসে দেয়া এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এখন, মনে হচ্ছে আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তিদের অথবা এই দেশে প্রবেশের জন্য আগ্রহী ব্যক্তিদের ব্যাপারে সরকারের মনোভাব খুবই খারাপ।’

‘সংকটাপন্ন জায়গাগুলো থেকে উঠে আসা মানুষগুলো সমৃদ্ধ একটি দেশে আসতে চাইছে, ‘এটা ভেবে তারা বিস্মিত হচ্ছে। কিন্তু কেনো তারা বিস্মিত হবে? সমৃদ্ধ দেশে কে না আসতে চায়? আসলে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া ন্যাক্কারজনক’-বলেন গুরনাহ।

উপনিবেশিকতা নিয়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ও এ সম্পর্কিত চিরাচরিত জ্ঞানের মধ্যে যে ফারাক বিদ্যমান তা পূরণে গুরনাহ ব্যাপকভাবে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তার মতে, ‘এখানে কথাসাহিত্য একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে: এটি যে শুধু মানুষকে শিক্ষিত করে তোলে তা নয়, তথ্য দিয়ে, সম্পৃক্ততা তৈরি করে, এ বিষয়ে কথা বলে, মানুষের জীবন গঠনে সহায়তা করতে পারে এটি।’

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রিটেনের অতীত ইতিহাস নিয়ে সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ‘ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষা’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঠিক তার পরের দিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গুরনাহ বলেছিলেন, তিনি বৃটেনের পক্ষপাতমূলক কিছু নির্দিষ্ট ইতিহাস- ঐতিহ্য উদযাপনের মনোভাবকে সমর্থন করেন না।

গুরনাহ স্পষ্ট ভাষায় যোগ করেন, ‘আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে। যদি ইতিহাস থেকে ভয়ঙ্কর কোনো কিছু জানার থেকে থাকে, তাহলে তাদেরকে সেটা জানতে হবে। আপনি একবাক্যে বলতে পারেন না, ‘সমালোচনাকারীরা আমাদেরকে অবমাননা করছে।’

বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকু নিয়ে যারা স্বদেশ থেকে পালিয়ে এতটা পথ পাড়ি দেন, তাদের সংকল্প ও সাহস দেখে গুরনাহ অভিভূত হন বলে অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

এদিকে অভিবাসী প্রসঙ্গে এ ঔপন্যাসিক বলেন, ‘তারা (ইউরোপীয়রা) ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ নামে একটি প্রপঞ্চ ব্যবহার করছে। তাদের কাছে ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ হওয়া একধরনের অপরাধ। কেনো নয়?’ তিনি যোগ করেন, ‘কয়েক শতাব্দীকাল ধরে লক্ষ লক্ষ ইউরোপিয়ান এই কারণে তাদের বাড়িঘর ছেড়েছিল এবং ঠিক এই কারণেই তারা পৃথিবীতে আক্রমণ করেছিল।’

গুরনাহ স্পষ্ট ভাষায় জানান, তিনি মোটেও সবার জন্য উন্মুক্ত অভিবাসনের পক্ষে কথা বলছেন না। তবে অভিবাসীদের নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও অপমানজনক উপস্থাপনাও সমীচীন নয় বলে তিনি মনে করেন। এসময় তিনি ব্রেক্সিট প্রসঙ্গে নিজের মতামত ব্যক্ত করে জানান, ব্রেক্সিটের কারণে অভিবাসনের স্বাভাবিক প্রবণতার বিপরীতে ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।

সাহিত্যে খুব কম সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ লেখককে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে- রয়টার্স সাক্ষাৎকারগ্রহণকালে এমন প্রসঙ্গ তুললে এককথায় গুরনাহ উত্তর দেন, ‘পৃথিবী বদলে যাচ্ছে’।

সবশেষে গুরনাহ জানান, এড়িয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ অথবা প্রচলিত স্বীকৃতি থেকে অ-ইউরোপিয় মানুষদের বাদ দেয়া অথবা প্রচলিত স্বীকৃতি থেকে নারীদের বাদ দেয়ার প্রসঙ্গকে ইস্যু হিসেবে দাঁড় করিয়ে এখন কথা বলা শুরু হয়েছে। এর ফলাফল দেখার জন্য তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে কী ঘটে’-বলেন ৭৩ বছর বয়সী ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ।


সাক্ষাৎকার অবলম্বনে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন রয়টার্স-এর ক্যান্টারবারি প্রতিবেদক গাই ফলকনব্রিজ ও নাটালি থমাস।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here