যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফার্স্ট কর্তৃক প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদন বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। দেশটির দক্ষিণ সীমান্তে বিপুল সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীর আগমনের কারণে কয়েক সপ্তাহ আগে কঠোর এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফার্স্ট বলেছে যে, অভিবাসন এবং কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আই-সিই) আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয়ের জন্য মামলার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট তাদের পরিবার বা পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে সেখানে বসবাসের অনুমতি দেওয়ার পরিবর্তে হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে কারাগারে আটকে রেখেছে।
সংগঠনটি ভাষ্য: আশ্রয়প্রার্থীদের কারাগারে রাখার প্রক্রিয়াটি ‘অমানবিক’, অপ্রয়োজনীয় এবং অপচয়মূলক। এর জন্য মানুষের অকারণে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি হয়। একইসঙ্গে চিকিৎসা অবহেলা এবং বৈষম্যের শিকার করা হয় তাদের। ‘আশ্রয়প্রার্থীদের কারাগারে আটকে রাখা মৌলিকভাবে অমানবিক এবং নিষ্ঠুর ’-বলছেন শরণার্থীদের সুরক্ষায় কর্মরত একজন সহযোগী অ্যাটর্নি এবং লেখক বেকি জেন্ডেলম্যান।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘এটি তাদের (আশ্রয়প্রার্থীদের) আইনি প্রতিনিধিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে। তাদের ভয়ঙ্কর কারাবাসের মধ্যে ফেলে দেয়, শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবার যারা নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে গেছে, তাদের জন্য এটি পুনরায় আঘাতমূলক ও ক্ষতিকারক হতে পারে।’
‘আমি এখানে বন্দী: বাইডেন প্রশাসনের নীতিগুলি আশ্রয়প্রার্থীদের আটক করে’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গত বছরের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের গড়ে ৩.৭ মাস ধরে আটক কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছিলো।
আরো পড়ুন
অস্ত্র বিক্রিতে তৎপর হলেও ইউক্রেনীয় শরণার্থী গ্রহণে অনাগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র
একজন অভিবাসন কর্মকর্তাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এক আশ্রয়প্রার্থী ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, কেনো নিজ দেশে ফিরে গেলে তারা বিপদে পড়তে পারে। সেসময় তাদের মধ্যে অনেকেই যাদের ভেতর ভয় বা আতংঙ্ক ছিলো, তারা সেটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
সাধারণত ব্যতিক্রমী কোনো পরিস্থিতি ব্যতিত আশ্রয়প্রার্থীদের আটকে রাখা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে, যেটা অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় কিংবা স্বেচ্ছাচারীভাবে কাউকে আটক করাকে নিষিদ্ধ করেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলি আরো বলছে যে, আশ্রয়প্রার্থীদের আটক করার বিষয়টি-যারা অপরাধ করেনি, বেআইনিভাবে তাদের চলাফেরার স্বাধীনতার অধিকারকে লঙ্ঘন করে। ২০২০ সালের ২৩ মে এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কর্তৃপক্ষ করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া থেকে দেশকে রক্ষা করার প্রয়োজন উল্লেখ করে সীমান্তে আশ্রয়প্রার্থীদের বেশিরভাগকেই বহিষ্কার করার অনুমতি দিয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ‘শিরোনাম ৪২’ এর অধীনে ১.৮ মিলিয়নের বেশি আশ্রয়প্রার্থীদের বহিষ্কার করে মেক্সিকো কিংবা তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। জেন্ডেলম্যান বলেছেন, ‘যদিও বাইডেন প্রশাসন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং ‘শিরোনাম ৪২’ এর অধীনে অনেক আশ্রয়প্রার্থীকে বহিষ্কার করেছে।
দীর্ঘস্থায়ী আটক
মেক্সিকোর সঙ্গে একটি চুত্তির ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদর থেকে ‘শিরোনাম ৪২’ এর অধীনের আশ্রয়প্রার্থীদের বহিষ্কার করতে পারে। জেন্ডেলম্যান বলছেন, কারাগারে বন্দীদের মধ্যে অনেকেই আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন, যাদের যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকোতে বহিষ্কার করতে পারেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিউবা, হাইতি নিকারাগুয়া, ভেনেজুয়েলার পাশাপাশি আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের লোকজনদের দীর্ঘদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছে। বাইডেন দীর্ঘস্থায়ীভাবে আটক রাখা ও অভিবাসীদের আটক কেন্দ্রের ব্যবস্থা বন্ধ করা এবং আশ্রয় চাওয়ার আইনি অধিকার বজায় রাখার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন নিজের সুবিধার জন্য।
তবে বাইডেন তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেশকিছু বিধিনিষেধমূলক নীতিমালা বহাল রেখেছেন। বাইডেন প্রশাসন অভিবাসী আইনজীবী এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক নেতাদের কাছ থেকে ঘনঘন সমালোচনার মুখে পড়েছেন। যেটা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি প্রশাসনের দায়িত্ব বজায় রাখার জন্য প্রেসিডেন্টকে আরো বেশি সচেতন হওয়ার আহ্বান জানায়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারটি নিরুৎসাহিত করাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিতে পরিণত করেছিলেন। আশ্রয়প্রার্থীদের নিজের কার্যক্রমের সময়কালের জন্য আটকে রেখেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, যদি তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে বেশিরভাগই আদালদের শুনানিতে উপস্থিত হবে না। কিন্তু এই দাবিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এবং নিউ ইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা টিআরএসি ইমিগ্রেশনের মতে, ২০১৯ অর্থবছরে, ৯৮.৭ শতাংশ আশ্রয়প্রার্থী যাদের আটক করা হয়নি, তারা আদালতের প্রতিটি শুনানিতে হাজির হয়েছিলেন।
আরো পড়ুন
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তেই ১৯ লাখ অভিবাসন প্রত্যাশী গ্রেফতার
হিউম্যান রাইটস ফার্স্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আশ্রয়প্রার্থীদের গণহারে জেলে পাঠানো বাইডেন প্রশাসনের নীতির ফল। যেটা আশ্রয়প্রার্থীসহ ‘সীমান্ত অতিক্রমকারী ব্যক্তিদের জন্য হুমকি’।
‘আমরা বাইডেন প্রশাসনকে আশ্রয়প্রার্থীদের কারাগারে পাঠানো বন্ধ করার আহ্বান জানাই। কারণ এটি অবৈধ শিরোনাম নীতি ৪ কে সমর্থন করে। এর পরিবর্তে তাদের সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানানো উচিত এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রোগ্রাম চালু করা উচিত’-বলে জানান জেন্ডেলম্যান।
‘যেমন আমি অপরাধী ছিলাম’
উগান্ডার একজন মানবাধিকার কর্মী সালমা (ছদ্মনাম) বলেন, তিনি আটক ও নির্যাতনের পর ২০২১ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে অবতরণের পর আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তিনি এও জানান, তাকে বিমানবন্দরে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিলো এবং তারপর অ্যাডেলান্টো আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।
শুধু তাই নয়, তাকে তিন ঘণ্টা পর শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছিলো। ‘প্রথমত আমি ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত এবং তারপরও আমাকে আটক করা হয়েছিল’। তিনি জানান, তার আশ্রয়ের মামলা এখনও বিচারাধীন। ‘তারা আমার হাত, পা এবং কব্জি বেঁধে রেখেছিলো যেনো আমি একজন অপরাধী’ এমনটাই তিনি আল-জাজিরাকে জানান।
দুইদিন পর তার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, সবকিছুর বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করতে এবং তাতে তিনি সফল হন। তবু তাকে আটক কেন্দ্র থেকে বের হতে দেয়া হয়নি।
তাকে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার কোনো আত্মীয় নেই, যে তাকে সাহায্য করতে পারে। এত তাড়াতাড়ি তিনি কোনো আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেননি। ফলে তার ফোন, পাসপোর্টসহ সব জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হয় এবং তার চুল কেটে দেওয়া হয়েছিলো। আটক কেন্দ্রটি এত ঠাণ্ডা ছিল যে, সেখানে কিছু নারীর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। আবার খাবার এত নিম্নমানের ছিল যে, প্রায়শই তা ফেলে দেওয়া হতো। তিনি গর্ভবতী বুঝতে পেরেও তাকে দেড় মাস পর মেডিকেল প্যারোল দেওয়া হয়েছিলো। মুক্তি পাওয়ার দেড় মাস পর তার গর্ভপাত হয়েছিল। তিনি এও বলেন, ‘সঠিক খাবার না খেতে পেলে মানুষ কীভাবে বাঁচবে।’
টিআরএসি এর মতে, ২০২১ অর্থবছরে ২৩ হাজার আটশত ২৭ জনকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যার সংখ্যা আগের বছরে ছিল ৬০ হাজার ৬৯ জন। ২০২১ সালে আট হাজার তিনশত ৪৯ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিলো এবং অতিরিক্ত চারশত দুইজনকে অন্য ধরনের ত্রাণ দেওয়া হয়েছিলো।
আরো পড়ুন
‘গরিবি’ খাবারের একটি ছবি এবং যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়া ‘অকৃতজ্ঞ’ এক আফগান শরণার্থী…
ইউএস জাস্টিস বিভাগের তথ্য দেখায় যে, ২০২২ অর্থবছরে প্রথম তিন মাস অবধি ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থনার মামলা আদালতে বিচারাধীন ছিল। অন্যদিকে হিউম্যান রাইটস ফার্স্টেও প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গ আশ্রয়প্রার্থীদের গড়ে প্রায় ৪.৩ মাসব্যাপী আটকে রাখা হয়েছে। যারা কৃষ্ণাঙ্গ নয় এমন আশ্রয়প্রার্থীদের তুলনায় এর হার ২৭শতাংশ বেশি।
সাবরি, ছদ্মনামের একজন আশ্রয়প্রার্থী বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে সুদান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের সময় সব বিষয়ে প্রমাণ দেওয়ার পরও প্যারোলের জন্য তার অনুরোধ একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
কর্মকর্তারা তাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে তাকে তার স্ত্রীর থেকে আলাদা করে দেয়। তার স্ত্রীকে রাজ্যের অন্য একটি আটক কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়, তাকে পাঠানো হয়েছিলো লুইজিয়ানার উইন কারেকশনাল সেন্টারে। তিনি আরো বলেন ‘ভেবেছিলাম, আমি যা কিছু করছি তারপর মার্কিন সরকার আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করবে। কিন্তু তা তো করেইনি বরং তারা আমাকে সাড়ে পাঁচ মাস আটকে রেখেছিল।’
আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন রীতা জান্নাত