ওমানে ভালো নেই বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা

0
1459

প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ওমানে যান শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই শ্রমিকদের অধিকাংশই নির্ধারিত পেশায় অদক্ষ। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এদের বেশিরভাগই কম বেতনের কাজ করেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে তারা অবর্ণনীয় ও হৃদয়বিদারক সংকটের মুখোমুখি হন। উন্নত জীবনের আশায় এই দিনমজুর শ্রমিকরা ওমানে আসলেও ধীরে ধীরে তাদের সে স্বপ্নগুলো ফিঁকে হয়ে যেতে থাকে।

নজরুল ইসলাম এমনই একজন বাংলাদেশি শ্রমিক। যিনি প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করে ওমান এসেছিলেন। এখানে এসে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ পান তিনি। প্রতি মাসে তাকে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২২ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। যদিও তিনি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনামূল্যে থাকার জায়গা পেয়েছেন।

বিবাহিত জীবনে নজরুল পাঁচ ও বারো বছর বয়সী দুই সন্তানের বাবা। নজরুলকে তার মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্বও পালন করতে হয়। তিনি যে ২২ হাজার টাকা বেতন পান, সেখান থেকে প্রায় পনেরো হাজার টাকা প্রতি মাসে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। ওমানে আসার ভিসা জোগাড় করতে তাকে এই ঋণ নিতে হয়েছিল। বাকি টাকা তিনি দেশে তার পরিবারের কাছে পাঠান। অফিসের নির্দিষ্ট কাজ শেষ করার পর তিনি খণ্ডকালীন আরো একটি কাজ করেন। এখান থেকে বাড়তি যে টাকা তিনি আয় করেন, তা দিয়ে নিজের খাবার ও ওষুধের সংস্থান করেন।

নজরুল ইসলাম একদিক থেকে ভাগ্যবান যে, তাকে কাজের ভিসা নবায়ন করতে বাড়তি কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। যদিও তার আরেক সহকর্মী শফিকুল আলমকে এই বাড়তি খরচ করতে হয়। তারা দুজন একই সুপার মার্কেটে কাজ করেন। কিন্তু তাদের ভিসা একেবারে ভিন্ন দুই কোম্পানির। প্রতি দুই বছর পর আলমকে ভিসা নবায়ন ও রেসিডেন্ট কার্ডের জন্য অর্থ খরচ করতে হয়। ‘কয়েক মাসের মধ্যে আমার ভিসা নবায়ন হতে যাচ্ছে এবং আমার কোম্পানির কাছে আমাকে এ বাবদ অর্থ দিতে হবে।’

ওমানে আসার উদ্দেশ্যে ভিসা নেয়ার জন্য আলম তার এক আত্মীয়ের কাছ কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তিনিও মাসে প্রায় ২২ হাজার টাকা রোজগার করেন। সেখান থেকে পনেরো হাজার টাকার মতো বাড়িতে পাঠান এবং বাকিটা দিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন। ‘বর্তমানে আমি যে কোম্পানিতে কাজ করি সেখানকার একজন ফোরম্যানের কাছ থেকে একটি ভিসা পেয়েছিলেন আমার এক আত্মীয়’-আলম জানান। পরিবারে তার ৭ ও ১৪ বছর বয়সী দুই মেয়ে সন্তান ও বৃদ্ধ মা রয়েছে।

ওমানের নতুন শ্রম আইন অনুযায়ী, চুক্তি শেষ হওয়ার পর মালিকপক্ষের নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) ছাড়াই শ্রমিকদের কাজ পরিবর্তন করার সুযোগ আছে। আলম আশা করছেন, এই আইনের মাধ্যমে অন্য একটি কোম্পানিতে বদলি হওয়ার, যেখানে ভিসা নবায়নের জন্য প্রতি দুই বছর পর তার কাছে টাকা চাইবে না।

বাংলাদেশ থেকে ওমানে কাজ করতে আসার জন্য আরেক বাংলাদেশি আবদুল হাকিমও কাজের ভিসা জোগাড় করেছেন। এই ভিসা পেতে তাকে গুণতে হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এছাড়া তার কোম্পানি ভিসা নবায়নের জন্য প্রায় ৮৮ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করেছে। যাহোক, বর্তমান ভিসায় মাসকটে একটি কোম্পানিতে পাঁচ মাস কাজ করার পর অন্য আরেকটি কোম্পানিতে তাকে বদলি করা হয়েছিল।

‘আমার নিয়োগকর্তা আমাকে বলেছিলেন, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে ঝামেলা ছিল। একারণে সেই পাঁচ মাসের জন্য আমাকে অর্থ দেয়া হয়নি।’ আবদুল হাকিম অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিনের পর দিন প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে করতে তার অবস্থা খুই শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। ‘তারা আমাকে অন্য একটি জায়গায় বদলি করে। যেখানে একটি কক্ষে বিশ জনকে একসঙ্গে থাকতে হতো। খুবই খারাপ অবস্থা ছিল সেখানে। এমনকি ঘুমাতেও সমস্যা হতো’-বলেন তিনি।

আব্দুল হাকিম চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে নিজের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। তবে আসার আগে তিনি একটি রেস্টুরেন্টে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন। তার নতুন প্রতিষ্ঠানের মালিক আগের কোম্পানির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তখন কোভিড মহামারির কারণে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এর প্রায় আট মাস পর তিনি ওমানে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আরেকজন বাংলাদেশি আরিফ বিল্লাহ তুলনামূলক বেশি অর্থ খরচ করে ওমানে কাজের ভিসা জোগাড় করেছিলেন। যদিও এটি নবায়নের জন্য কোনো অর্থ দিতে হয়নি তাকে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম দুই বছর শেষে ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসার পর তাকে একটি সিফুড প্রসেসিং কোম্পানিতে পাঠানো হয়েছিল। দীর্ঘসময় ঠাণ্ডার মধ্যে কাজ করার ফলে তার শারীরিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল।

একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে যান। তার কোনো স্বাস্থ্য বীমা করা ছিল না। শারীরিক এ অবস্থার কথা জানিয়ে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে বদলির জন্য নিয়োগকর্তার কাছে অনুরোধ করেছিলেন তিনি। কিন্তু এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। ‘তারা আমার `রেসিডেন্ট কার্ড’ ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং আমাকে কাজ থেকে বের করে দিয়েছিল। এছাড়া আমার জমানো বেতন থেকে প্রায় ৯১ হাজার টাকা কেটে রেখেছিল’- বলছিলেন আরিফ।

এবার ফিরে আসা যাক, ওমান প্রবাসী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গে। তিনি চার বছর ধরে দেশটিতে আছেন। কিন্তু এখনো তার পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া কিংবা ছুটি কাটানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। নজরুল ইসলাম বলেন- ‘বর্তমানে আমি কোনো সঞ্চয় করি না। আমার ঋণ পরিশোধ হয়ে গেলেই আমি ছুটি নেয়ার কথা ভাবতে পারবো। আমি খালি হাতে বাড়ি যেতে পারবো না।’

ছয় বছর আগে শেষবারের মতো শফিকুল আলম তার পরিবারের প্রিয়জনদের মুখ দেখেছিলেন। ‘বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবার আগে আমার আরো কয়েক বছর লাগতে পারে’-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছলছল চোখে বলেন আলম।

সূত্র: মাসকটডেইলি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here