বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসনের বার্তা
৫০ বছর আগে এই দিনে (ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। ‘ব্রিট-বাংলা বন্ধন’-এর নতুন যুগের এই ঐতিহাসিক বার্ষিকীতে যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে আমি গর্বিত যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গল্পে যুক্তরাজ্যের অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীন মাতৃভূমিতে পা রাখার আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে ঐতিহাসিক সফর করেন। এই সফরের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন) এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক বঙ্গবন্ধু একটি নতুন বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। যা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ত্বরান্বিত করে।
ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটি বাংলাদেশকে কমনওয়েলথভূক্ত দেশগুলোকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও পরবর্তীতে একটি উদীয়মান বাংলাদেশে মহামান্য সরকারের মানবিক সহযোগিতার কথাও স্মরণ করি। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাজ্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের জন্য মানবিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বৃহত্তম দাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিল, যা এদেশের মুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের জোরালো জনসমর্থন প্রতিফলিত করে। মূলত এসবই যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি অনন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে।
ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব স্যার অ্যালেক ডগলাস-হোম ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। তখন থেকে যুক্তরাজ্য গবেষণা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার উন্নতি, নারী ও শিশুদের আয়ু বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়নে এই দেশের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অংশীদার। এবং এই সবই গত ৫০ বছরে দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশ ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বেড়ে উঠতে শুরু করলে যুক্তরাজ্য তার দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতায় বৈচিত্র্য আনতে শুরু করে। আমরা বাংলাদেশের সামরিক কর্মী, পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছি। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্য সাভারে একটি মিলিটারি স্টাফ কলেজ স্থাপনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিল। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালাগান বাংলাদেশ সফর করেন। অনেক বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যকে তাদের আবাস বানিয়েছে এবং পাঁচ দশক পর প্রায় ৬ লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ যুক্তরাজ্যে বসবাস করছে। ব্রিটিশ এবং বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও গভীর এবং শক্তিশালী।
মহামতি রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এসময় তিনি ঢাকা থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণে একটি মডেল গ্রাম পরিদর্শনের জন্য ট্রেনে ভ্রমণ করেছিলেন। সেই ঘটনার পর থেকে এইচআরএইচ দ্য প্রিন্স অব ওয়েলস, এইচআরএইচ দ্য প্রিন্সেস রয়্যালসহ রাজপরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য এবং জন মেজর, টনি ব্লেয়ার এবং ডেভিড ক্যামেরনের মতো প্রধানমন্ত্রীরা একটি উদীয়মান দেশ দেখতে বাংলাদেশ সফর করেছেন। এই সময়ের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে, যুক্তরাজ্যের আগ্রহকে প্রতিফলিত করে। কারণ বাংলাদেশ দারিদ্র্য, বন্যা এবং বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। একটি প্রাণবন্ত, ইতিবাচক রূপান্তরের রোল মডেল হয়ে স্বাধীন জাতি হিসেবে রাজনৈতিক ও শাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশ এগিয়ে গেছে।
আমি ‘বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ’ থেকে ‘বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি’-তে বাংলাদেশের রূপান্তর এবং সেই গল্পে যুক্তরাজ্যের অংশ রয়েছে বলে আনন্দিত। বাংলাদেশ তার প্রথম অর্ধশতকে যা অর্জন করেছে, তা আজ বিশ্ব প্রশংসার সঙ্গে গুরুত্ব দেয়: একটি আরএমজি পাওয়ার হাউস; শান্তি ও নিরাপত্তার একটি নেতৃস্থানীয় অবদানকারী, বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য প্রদানকারী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উপর সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্ব কণ্ঠস্বরগুলির মধ্যে একটি, যেমনটি আমরা গ্লাসগোতে কপ-২৬ এ দেখেছি। আর এ এসব কিছুর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের বন্ধু হতে পেরে গর্বিত।
যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্যে আধুনিক সংযোগের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রিকেট এবং রান্নায়ও ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের অবদান রয়েছে! আমরা দৃঢ় ঐতিহাসিক বন্ধনে আবদ্ধ আধুনিক একুশ শতকের অংশীদারিত্বের একটি পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারা বজায় রাখি। আমরা আগামী ৫০ বছর এবং তারপরও আমাদের দৃঢ় জনগণের সঙ্গে এদেশের জনগণের সংযোগের গতিশীলতার মাধ্যমে আত্মীয়তা এবং সংস্কৃতির এই বন্ধনগুলিকে শক্তিশালী করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।