যুদ্ধ এমন একটি শব্দ, যা মুহূর্তে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। সম্ভবত যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিণতি এই যে, এতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ যা হারায়, তা আর ফিরে পায় না। গৃহযুদ্ধের দামামায় সিরিয়ার সর্বত্রই ধ্বংসের চিহ্ন। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষ পাশের দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।
এমনিতেই শরণার্থী জীবন নানাবিধ জটিলতায় পূর্ণ থাকে। তারপর আবার রমজান মাস এলে যেন সেই কষ্ট মুসলিম শরণার্থীদের জন্য আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। এবছরও যেন তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং আগের চেয়ে এ কষ্ট কয়েকগুণ বেড়ে গেছে লেবাননে আশ্রয় নেয়া মুসলিম শরণার্থীদের।
আল জাজিরার খবরে বলা হচ্ছে, লেবাননে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির কারণে অর্থকষ্টে থাকা শরণার্থীরা রমজান মাসে রোজা রাখতে গিয়েও বেকায়দায় পড়ছেন। বলা হচ্ছে, রমজানে যে ধরনের খাবার খাওয়া দরকার কিংবা এসময়ে যে ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে এসব শরণার্থীরা অভ্যস্ত, সে ধরনের খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
লেবাননে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির প্রভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এ ঘটনায়: দেশটির গ্রামীণ এলাকা বেকা উপত্যকার ছোট একটি সুইমিং কমপ্লেক্স। সেখান থেকে খানিকটা দূরে অস্থায়ীভাবে একটি রান্নাঘর বানানো হয়েছে। ঠিক এখানেই একটি ট্র্যাক এসে থামলো। ট্র্যাক থেকে নামানো শুরু হলো টমেটো, পেঁয়াজ, গাজর এবং মরিচের কয়েক ডজন বাক্স। এসময় লেবাননভিত্তিক এনজিও সাওয়া ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এইড-এর ওমর আবদুল্লাহ জিনিসপত্রের রসিদটি পড়ার সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘খাবারের দাম আরো বেশি হচ্ছে। সবজির দাম তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।’
আবদুল্লাহ এনজিওর ‘বাৎসরিক রমজান রান্নাঘর’ পরিচালনা করছেন। যেখানে লেবানিজ, সিরিয়ান ও ফিলিস্তিনি বাবুর্চি এবং স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল ১ হাজার ৫০০ জন সিরিয় উদ্বাস্তু এবং লেবানিজ পরিবারের জন্য গরম খাবার তৈরি করেন। আবদুল্লাহ বলেছেন, খাদ্য সরবরাহের সময় এসব খাবার দেখে হতবাক হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘রান্নাঘর চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ তিন বছরেরও কম সময়ে লেবাননে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪০০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, এছাড়া বিদ্যুতের জন্য ডিজেল এবং অটোমোবাইলের জন্য পেট্রোলের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে।’
স্থানীয়রা বলছেন, পাউরুটি এবং উদ্ভিজ্জ তেল-লেভানটাইন রন্ধনপ্রণালীর দুটি প্রধান প্রধান উপাদান। যা দেশটির অর্থনৈতিক সংকট এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে আরো ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
তবে এতকিছুর পরও শরণার্থীদের জন্য প্রত্যাশিত খাবার তৈরীর চেষ্টা করছেন ৬০ বছর বয়সী ওম মোহাম্মদ, যিনি পেশায় বাবুর্চি। তিনি বলছেন ‘আমরা আমাদের খাবারের মানের সঙ্গে আপস করতে চাই না, প্রয়োজনে আমরা এই বছর স্বাভাবিকের চেয়ে কম (খাবার) প্রস্তুত করবো।’ এসময় তিনি জানান, অনেক শরণার্থী পরিবার তীব্র খাদ্যকষ্টে পড়েছে, যা কিনা দিন দিন আরো গুরুতর হয়ে উঠেছে।
লেবাননের জনসংখ্যার তিন চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, দেশটির অর্থনৈতিক সংকট প্রায় এক মিলিয়ন সিরিয় শরণার্থীর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ চরম দারিদ্রসীমার মধ্যে বসবাস করছে।
আগের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সংখ্যক সিরিয় উদ্বাস্তু খাদ্য খরচ মেটাতে ঋণের মধ্যে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গত এক বছরে লেবাননজুড়ে দরিদ্র পরিবারগুলির মধ্যে খাদ্যের প্রবণতাগুলিতে বড় পরিবর্তন খুঁজে পেয়ে তা নথিভুক্ত করেছেন।
এদিকে আব্দুল্লাহ রান্নাঘর চালু রাখতে এবং পূর্ব বেকা উপত্যকা থেকে অনেক দূরে থাকা শরণার্থীদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। ‘রমজানে পরিবেশন করা খাবারের মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করবো। আমরা জনপ্রিয় এই খাবারগুলিকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে দিতে পারি না’-তিনি ব্যাখ্যা করেন।
সূত্র: আল জাজিরা