গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নে রেমিট্যান্সের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের সুযোগ

0
1431

আমিনুল হক তুষার

বিশ্বব্যাংকের মতে ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রায় ২০০ মিলিয়ন অভিবাসী শ্রমিক নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে ৫৪৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণ করেছেন। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রহণকারী দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ এই সব অভিবাসীদের বেশিরভাগ পরিবারই থাকেন গ্রামে। আইওএম-এর হিসাব মতে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অভিবাসী শ্রমিক প্রতি বছর তাদের উপরে প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল নিজ দেশে বসবাসরত প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষের ভরণপোষণের এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই বিশাল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। 

করোনা মহামারীতে লকডাউন ও বিশ্ববাণিজ্যে স্থবিরতা নামার জন্য অনেক অভিবাসী শ্রমিক হারিয়েছেন চাকুরী ও চুক্তিভিত্তিক কাজ, যার প্রভাব অবধারিতভাবে পড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। যদিও বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বিগত ২০২১ সালে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৈশ্বিকভাবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যাওয়ার কথা এবং এর প্রভাব বাংলাদেশের মতন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী দেশের বিরূপভাবে পড়ার কথা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ সেই পূর্বাভাস অনুযায়ী যে পরিমাণে কমার কথা ছিল তা কিন্তু কমেনি, বরং বিপরীতটাই ঘটেছে।


বিগত ২০২০ সালে, করোনা মহামারীর ক্রান্তিকালেও বাংলাদেশ পূর্বের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ২১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করেছে। (সূত্র: বিএমইটি, ডিসেম্বর ২০২০)অনেক অভিবাসন ও রেমিট্যান্স বিষেশজ্ঞ মনে করেন, করোনাকালে অবৈধ বা হুন্ডি মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণের সুযোগ অনেকাংশে কম থাকায় এবং সরকার প্রদত্ত ২% প্রণোদনার কারণে দেশে বেশি পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে।

বিএমইটির পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৯৯ জন শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন, যেখানে প্রতি বছর এ সংখ্যা গড়ে প্রায় ৬-৭ লক্ষ। বৈশ্বিক চলাচলে ও অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগে দেশভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা বা ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ হতে জনশক্তি প্রেরণ সীমিত হয়েছে, যার দরুন অভ্যন্তরীন শ্রম বাজারে সৃষ্টি হয়েছে চাপ। অন্যদিকে, অনেক অভিবাসী শ্রমিক বিদেশে চাকুরী হারিয়ে ফেরত এসেছেন এবং দেশে এসে চরম বিপাকে পড়েছেন। তারা না পারছেন বিদেশে পুনরায় যেতে, না পারছেন দেশে কিছু করতে। স্বল্পকালীন অবস্থানের পরে যারা এসেছেন তারাও পড়েছেন নানান অর্থনৈতিক সংকটে, হিমশিম খাচ্ছেন অভিবাসন ব্যয়ের টাকা বা ঋণ পরিশোধ করতে। যদিও সরকার এরই মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার সফট লোনের ব্যবস্থা করেছে বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীদের জন্য। কিন্তু সামষ্টিকভাবে আমাদের অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবার-যারা গ্রামে থাকে তাদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির (Financial Inclusion) হার দুর্বল ও রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের উপরও খুব একটা মনোযোগী থাকেন না । ফলে মুখোমুখি হতে হয় নানা ধরণের প্রতিকূলতার।

বর্তমান সরকার উন্নয়নের ধারা টেকসই ও অব্যাহত রাখতে প্রত্যেক নাগরিকের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিয়মিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদিও ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান মতে দেশের মোট জনগণের ৪৭% এখন পর্যন্ত এই অন্তর্ভুক্তির ভিতর রয়েছে, অর্থাৎ প্রায় ৫৩ শতাংশ জনসাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক বা স্বীকৃত ব্যাংকিং সেবার বাইরে। মূলত: প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং এর চেয়ে আমাদের দেশের জনসাধারণ মোবাইল ব্যাংকিং, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও নন-ব্যাংকিং ইনস্টিটিউটগুলোর সঙ্গে লেনদেন করতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে।

যদিও আমাদের প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবার রেমিট্যান্স আনয়নে বা প্রেরণে বৈধ ব্যাংকিং বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে বর্তমানে যথেষ্ট সচেতন হয়েছি বা হচ্ছি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকে সঞ্চয় বা ব্যবসা লগ্নিতে এখনো অসচেতন। তাদের বেশিরভাগ প্রেরিত অর্থই ব্যয় হয় অভিবাসন ঋণ শোধে, জীবনযাপন খরচে বা ভোগবিলাসে। গ্রামীণপর্যায়ে খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায় এর সঠিক লগ্নি। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থই ভূমি ক্রয় বা ঘর-বাড়ি নির্মাণের ভিতরই সীমাবদ্ধ থাকে।

আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে যাওয়ার পূর্বে সরকারি নির্দেশনা অনুসারে প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ (পিডিটি) গ্রহণ করে থাকেন, যেখানে তাদেরকে দুইটি ব্যাংক একাউন্ট খোলার ও রেমিট্যান্সের সঠিক বিনিয়োগের উপরে ধারণা দেয়া হয়ে থাকে । তারপরও দেখা যায় তারা রেমিট্যান্সের সঠিক বিনিয়োগের ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহী থাকে না, বরঞ্চ তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোগবিলাসিতার জন্য কিংবা বিদেশে কর্মসংস্থানের ভিসা ক্রয়ের জন্য অর্থ লগ্নি করে থাকে ।

বিদেশ ফেরত বা প্রত্যাবর্তিত অভিবাসী শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা দেশে এসেই তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত হতে পারেন না, কারণ তারা বিদেশে হয়তো ভিন্ন কোনো চাকুরীতে কর্মরত ছিলেন। আবার দেশে ফিরে নতুন কোনো উদ্যোগের সাথে যুক্ত হওয়ার মতন প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগের কথাও তাদের জানা থাকে না । পুনর্বাসন ঋণ নেয়াও অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায় । যেমন: প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে পুনর্বাসন ঋণ নিতে তাকে চলমান ব্যবসা, ট্রেড লাইসেন্স দেখতে হয়, যা একজন বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীর জন্য সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার উপরে দেখা যায় প্রান্তিক পর্যায়ে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সেবা প্রাপ্তিও দূরহ। ফলে অনেকে ব্যবসায় সুবিধা না করতে পেরে বা নিরুৎসাহিত হয়ে পুনরায় বিদেশে চলে যান । ফলে তাদের দীর্ঘদিনের শ্রমের দ্বারা সঞ্চিত রেমিট্যান্সের টাকার সঠিক বিনিয়োগ বা লগ্নি হয় না।

সরকার অন্যান্য কল্যাণমূলক সেবার পাশাপাশি বিদেশ হতে দক্ষতা নিয়ে আসা কর্মীদের জন্য চালু করেছে বিশেষ দক্ষতা স্বীকৃতি সনদ (Recognizing Prior Learning – RPL)। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও তা বেশিরভাগ অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জ্ঞানবহির্ভুত। গ্রামীণ পর্যায়ে অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডও খুবই অপ্রতুল। আবার গ্রামীণ পর্যায়ে দেখা যায় অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন: ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, সমবায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অভিবাসী পরিবারের সদস্যরা লেনদেন করে থাকে, কিন্তু এই সব প্রতিষ্ঠানও অভিবাসীদের জন্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন না। ফলে ব্যহত হয় সংযোগ সেবা ।

দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ জোগাতে সরকার প্রতিবছরই প্রবাসী দিচ্ছে সিআইপির মর্যাদা ও করমুক্ত আয়ের সুযোগ (যেমন: বিভিন্ন ইউএস বন্ড ক্রয়)। দুৰ্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই সব সুযোগ সুবিধা ও উদ্যোগ সম্পর্কে প্রবাসীরা বা অভিবাসী কর্মীরা খুব কমই জানেন। প্রকৃতপক্ষে বিদেশ গমনের পূর্বে এই বিষয়ে তাদের খুব একটা ওরিয়েন্ট বা প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না, ফলে তারা আর্থিক লগ্নি বা বিনিয়োগের জন্য দেশে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের উপরেই নির্ভর করে । 

এছাড়া জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ বা কর্মসূচিগুলোতেও (যেমন: টিটিসির কারিগরী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, সরকারের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প- সেইপ (সেইপ, স্টেপ, বি-সেইপ, বেসরকারি পর্যায়ে বি-স্কিলফুল, সুদক্ষ ইত্যাদি) অভিবাসীরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না বা জানেন না । ফলে তারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি বিশেষ ট্রেডে বা বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগও পাচ্ছে না।

এছাড়া বিদেশফেরত নারী অভিবাসী কর্মীরা যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন দক্ষতা ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও জয়িতা ফাউন্ডেশনের মতন উদ্যোক্তা প্লাটফর্মে অংশগ্রহণ করে সাবলম্বী হতে পারেন, কিন্তু সেই সুযোগে সম্পর্কেও তারা অতোটা জ্ঞাত নয়। এই বিষয়টাও আমাদের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। কারণ, শুধু প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপ বা বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রশিক্ষণ বা আর্থিক সহায়তার উপরে নির্ভরশীল না হয়ে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় দক্ষতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগে ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে যে সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে তার সঙ্গে অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে হবে।তাদেরকে নীতিমালাতে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে এবং তা প্রাক-বহির্গমন বা প্রাক-সিদ্ধান্তমূলক প্রশিক্ষণ সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ব্যাংকিংখাতসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বমূলক উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই আমরা রেমিট্যান্সের সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবো।     

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here