অস্তিত্বের বিশালতা নিয়ে পদ্মার গর্ববোধ আছে বৈকি। অহংকারের এই প্রকাশ যেন প্রতিনিয়তই করতে মরিয়া সে। তবু কোথায় যেন একটা দীর্ঘশ্বাস এ নদীর ভেতর নীরবে বেজে চলে সারাক্ষণ। বুকের ওপর থরে থরে জেগে ওঠা বালুচর এবং এই চর ছুঁয়ে ধেয়ে আসা তীব্র ধুলো-বাতাস যেন পদ্মার অপ্রকাশিত বেদনার ক্ষতই সামনে আনে।
পদ্মাপাড়ের অশীতিপর বাসিন্দা নওয়াব আলীর স্বভাবটাও যেন খানিকটা পদ্মার মতোন। স্বভাবে গম্ভীর ভাব, গলার স্বরে তীব্রতা, চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস, চাহনি আর আত্মবিশ্বাস-সবই যেন নওয়াব আলীকে একটু ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। রাস্তার পাশে চার হাত বাই পাঁচ হাতের ছোটো একটি পাটি বিছিয়ে তাবিজ-তবজি-পাথর বিক্রি করলেও চোখের ভাষায়, শরীরের অভিব্যক্তিতে যেন কোনো খেদ নেই তার।
উল্টো শক্ত করে বলেন, ‘‘রাজশাহীর এই শাহ মখদুম মাজারে বহু বছর আগে পা রেখেছি। বাবার (শাহ মখদুম মাজারে তিনি যাকে গুরু মানেন) উছিলাতে এখানে এসেছি। তিনিই আমাকে ইশারা করেছেন এখানে থাকতে। তিনি বলেছেন, ‘আর দৌঁড়ানো লাগবে না। অন্য কোনো মাজারেও যাস না, কোনো হাঁট বাজারেও যাওয়ার দরকার নেই।’ এক কথায় উনি আমাকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেটাই আমি করছি।’’
কীভাবে এ বার্তা পেলেন এমন প্রশ্নে তেঁতে ওঠেন নওয়াব আলী। ‘ওসব প্রশ্ন বাদ দেন, ওগুলো বলে লাভ নেই। ওগুলো বিধানের কথা, ওগুলো সবাই বুঝবে না। ওগুলো ফাটাফাটি। এ বলে কি পেয়েছো, ও বলে কী পেয়েছো? আমি বলেছি, যা পেয়েছি তা আমার সঙ্গে আছে। এসব গল্প আমি করতে রাজি না। আমাকে যা হুকুম দেয়া হয়েছে, ওটাই আমি করছি।’
তাবিজ-তবজি-পাথর বিক্রি করে আয় রোজগার কেমন হয় জানতে চাইলে নওয়াব আলীর উত্তর ‘এসব বেঁচাকেনা করে সংসার চালাই, নিজে চলি, দুটো নুন ভাত খাই। আল্লাহ চালিয়ে নেয়।’
রাজশাহী নগরীর শাহ মখদুম মাজারের পাশে ৪২ বছর ধরে তাবিজ-তবজি-পাথরসহ আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র বিক্রি করে আসছেন নওয়াব আলী। ব্যবসায়ের বয়স দীর্ঘ হলেও ভাসমান দোকানটিকে স্থায়ী গাঁথুনি দিতে পারেননি আজো। রাস্তার যে পাশটিতে বসে কেনাবেচা করেন, সেখান থেকেই ইশারা দিয়ে দেখালেন, পদ্মার এই চরে তার আয়ত্বে এক টুকরো জমি ছিল। কিন্তু সেখান থেকে বহু আগেই তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন তার জায়গা-জমি বলতে কিছুই নেই।
এখানে ঘর বেঁধেছিলেন কোথায়? ‘ওই ব্রিজের নিচে (পদ্মায় জেগে ওঠা চরের তীরে), ওখানে আমার ঘর ছিল। আমাদের ঘর উঠিয়ে দিয়ে পাবলিকের জন্য ব্রিজ করে দিয়েছে সরকার। এখন ভাড়া থাকি। মাস শেষে ২ হাজার টাকা ঘর ভাড়া গুনতে হয়।’
ছেলে-মেয়ে আর পরিবারের কথা উঠলে জানিয়ে দেন, তার নিজের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। ‘আমি যাকে বিয়ে করেছি, তার আগের সংসারের দুটো সন্তান আছে, ওদের লালন পালন করে বড় করেছি’-খানিকটা কোমলতা ঝরে নওয়াবের ঝাঁঝালো কণ্ঠ থেকে।
সকালের স্নিগ্ধতা উবে গেছে এরই মধ্যে, রোদের তীব্রতা শুরু হয়েছে। গল্প জমে উঠেছে নওয়াব আলীর সঙ্গে। বলা হলো, আপনাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, আপনার কোনো ঘর নেই, সরকারের কাছে কোনো আর্জি জানিয়েছিলেন? ‘কতবার বলেছি। কতবার লিখে নিয়ে গেলো। জন্ম নিবন্ধন কার্ড, ভোটার কার্ডের নম্বর, ছবি নিয়েছে। কোনো খোঁজ খবর নেই।’
এই যে নিজের স্থায়ী কোনো বাড়ি নেই, জমি নেই, এমনকি দোকানটিও ভাসমান। যেকোনো সময় উঠিয়ে দিতে পারে-এরকম পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলে খারাপ লাগে না? ‘এগুলো বলে কী লাভ বলেন! আল্লাহ না দিলে পাবো কই। জমি যখন পাইনি, তো পাইনি, আর দরকারও নেই। কয় দিন আর বাঁচবো। কেউ না কেউ অন্তত কবরের মাটিতে তো রেখে আসবে। দুঃখ করে লাভ নেই।’ কারো ওপর দোষ দেন? ‘কারে আর দোষ দেবো, ৮১ বছর বয়স ধরে তো শুধু দেখেই আসছি। কত জমিদারি, তালুকদারি দেখেছি। কত মানুষের হামকি-ধুমকি দেখেছি। এগুলো বলে কোনো লাভ হবে?’
সোজাসাপ্টা কথার ফাঁকে আক্ষেপের দেখা মিলল নওয়াব আলীর কথায়। কিন্তু তাই বলে বিন্দুমাত্র ভেঙে পড়ার পাত্র তিনি নন। এই যেমন অনেকেই তাকে সরকারের খাস জমি দেয়ার প্রলোভন দেখায়। কিন্তু তাতে তিনি মোটেও কর্ণপাত করেন না। আত্মবিশ্বাসের ঝুলি তুঙ্গে তুলে বলে ফেলেন, ‘কতজন কত টাকা চাইলো, লোভ দেখালো। এক টাকাও দিইনি। এও বলেছে অন্তত একশো টাকা দেন, ঘর আগে পাইয়ে দিবো। সরাসরি বলেছি, ও আমার কাছে নেই, দেখো অন্য কেউ দেয় নাকি। সরকার আমাকে যদি সরাসরি ঘর দেয় পাবো, না হলে নাই। গাছতলায় বাস করবো, এই তো!’
নওয়াব আলীর সঙ্গে কথপোকথনের সময় খেয়াল করে দেখা গেল, তার ভাষায় রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষার চেয়ে বরিশাল অঞ্চলের ভাষার টান খানিকটা বেশি। কারণ খুঁজতে বেরিয়ে এলো, অন্য এক মর্মস্পর্শী গল্প। জানা গেল, নওয়াব আলীর আদি বাড়ি পটুয়াখালির গলাচিপায়। জন্মের সময় বাবাকে হারিয়েছেন। কিছুদিনের মাথায় ভিটেবাড়িটুকুও নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর মায়ের সঙ্গে চলে আসেন নারায়নগঞ্জে। একমাত্র সন্তান নওয়াব আলীকে অনেক কষ্ট করে বড় করে তুলেছিলেন তার মা। কাজের উদ্দেশ্যে ঢাকায়ও ছিলেন বেশ কিছুদিন। আর শেষমেশ সেখানেই মারা যান তিনি। কোথায় তার কবর? ‘মাকে রেখে আসছি জুরাইন (জুরাইন কবরস্থানে)’। ছোট এক বাক্যে কথা সারেন নওয়াব আলী।
নওয়াব আলী জানালেন, শৈশব থেকেই নিদারুণ কষ্টে বড় হয়েছেন তিনি। ‘আমরা কাজ করেছি তো ভাত পেয়েছি। কাজ বন্ধ ভাতও বন্ধ। এমনও দিন গেছে আটদিন কাজ করে ১ টাকা পেয়েছি। বন কাটতে কাটতে হা-পিত্যেশ উঠে যেত।’
জানালেন কাজের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন তিনি রাজশাহী চলে আসেন। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিয়েছেন এই শহরে, এই শাহ মখদুম মাজারে। বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিতে চান। এমন সময় নওয়াব আলীকে প্রশ্ন করা হলো: আপনার জন্ম আরেক জেলায়। এরপর এই রাজশাহীতেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। এই শহরকে কতোটা নিজের শহর মনে হয়? ‘নিজের শহর বললে কি আর হবে? আমি যদি বলি, এটা আমার শহর। বললে তো হবে না। কতজনতো কত রকমভাবে চোখ রাঙানি দিয়ে বলে আমি নাকি বিদেশি। এও বলে বিদেশি ছাড়া তোরা চলতে পারিস? জন্মস্থান এখানে না, তাই বিদেশি বলে গালি দেয় সবাই। দেখা গেল, দুটো চড় থাপ্পরও মেরে দিলো। এরকম বহুবার হয়েছে।’
জন্মস্থান, ভিটেবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে, আশ্রিত শহর গালাগাল দিতে পারে। কিন্তু নওয়াব আলীর একটাই শান্তনা তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। তার ভাষ্য, ‘আমার কিছু নেই হয়তো, আমার শেকড় হয়তো ভেসে গেছে। কিন্তু দেশটাতো আমার। বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়টি তো কেউ আর ছিনিয়ে নিতে পারবে না।’ কথার ফাঁকে প্রশ্ন করা হলো: তাহলে দেশ শব্দটির মানে কী আপনার কাছে? ‘আমার কাছে দেশ মানে বাংলাদেশ। এই দেশে আমার রক্ত, এই দেশে আমার জন্ম, এই দেশে বসবাস। দেশের হাওয়া ভালো, দেশের খাওয়া ভালো, দেশের পুঁটি মাছ ভালো, বিদেশের গজাল ভালো না, বিদেশের শোল মাছও ভালো না। অনেক জায়গা ঘুরেছি, দেখেছি। কিন্তু দিনশেষে এই দেশেই আমার শান্তি। হয়তো বাপের ভিটা, জায়গা জমি নেই। আমি উদ্বাস্তু। কিন্তু তাতেও দুঃখ-কষ্ট নেই, দেশ তো আর আমাকে তাড়িয়ে দেবে না!’