বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

দুই কারণে ইউরোপ কখনোই অভিবাসন সমস্যার সমাধান করবে না

আন্দ্রেয়াস ক্লুথ

তারা আসতে থাকে – এবং ক্রমাগত মরতে থাকে। চলতি সপ্তাহে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে লিবিয়ার উপকূলে আরো ৫৫ অভিবাসন প্রত্যাশীর সলিল সমাধি হয়েছে। তাদের বহনকারী রাবারের নৌকাটি ডুবে গেলে এ ঘটনা ঘটে।

আজ থেকে দুই দিন আগে, ইতালীয় দ্বীপ ল্যাম্পেডুসার কাছে চারটি ভিন্ন দুর্ঘটনায় ৩৩ জনের জীবনাবসান হয়েছে। এরও কয়েকদিন আগে, ত্রিপোলির কাছে একটি সমুদ্র সৈকতে কয়েক ডজন লাশ ভেসে যেতে দেখা গেছে। আক্রান্ত এই পুরুষ, নারী অথবা শিশুরা প্রত্যেকেই অকল্পনীয় দুঃখের গল্প বলতে পারত।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর দেয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছর অভিবাসন প্রত্যাশীদের ডুবে যাওয়ার চলমান সংখ্যা ৬৬১। মূলত ২০১৪ সাল থেকে এই ধরনের প্রায় ২০ হাজারটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

আরো পড়ুন: মানবাধিকার রক্ষা নয়, অভিবাসী বন্টন নিয়েই বেশি চিন্তিত ইউরোপ

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বিশাল এ হতাহতের সংখ্যা এজিয়ান বা অন্যান্য সমস্ত জায়গায় মারা যাওয়া শরণার্থীদের মোট যোগফল নয়। এ সংখ্যা শুধুমাত্র মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুটে আফ্রিকা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মৃত্যুর সংখ্যা!

এমন মৃত্যুর ঘটনা যদি আরও বেশি ঘটতে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, এর কারণ আরও বেশি অভিবাসনের ঘটনা ঘটছে। স্থল বা সমুদ্রপথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে অবৈধ প্রবেশের সংখ্যা ২০২২ সালে আগের বছরের তুলনায় ৬৪ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০১৬ সালের শরণার্থী সংকটের পর সর্বোচ্চ।

আনুষ্ঠানিক আশ্রয়ের অনুরোধ ৫০ শতাংশ বেড়েছে, প্রায় ১০ লাখ আবেদন জমা পড়েছে। যদিও এই সংখ্যার মধ্যে গণনা করা হয়নি লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয়কে, যারা রাশিয়ার আক্রমণ থেকে পালিয়ে এসে এখন তথাকথিত অস্থায়ী সুরক্ষার অধীনে ইইউতে বসবাস করছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন লোকসানে আছে। তারা চায় না এত বেশি লোক তাদের ভূখণ্ডে আসুক। কিন্তু ইউরোপীয় উপকূলে অভিবাসন প্রত্যাশীরা পৌঁছে গেলে কীভাবে তাদের থামাতে হবে বা তাদের সঙ্গে কী করতে হবে, সেসম্পর্কেও জ্ঞাত নয় তারা।

আরো পড়ুন: একযুগে অবৈধপথে ইউরোপে গেছেন অন্তত ৬২ হাজার বাংলাদেশী

ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জর্জিয়া মেলোনি, যিনি অভিবাসী বিরোধী বক্তব্য দিয়ে অতি-ডান-পপুলিস্ট হিসাবে একজন প্রতিযোগী হিসেবে ক্ষমতার দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ইতালিতে উদ্বাস্তুদের পারাপার করার জন্য ডিঙ্গি-এমনকি উদ্ধারকারী জাহাজের চলাচল যতটা সম্ভব কঠিন করার চেষ্টা করছেন। তার ভাষ্য, তিনি আইন ভাঙতে পারবেন না, অথচ তিনি নাকি আরো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এড়াতে চান।

ইউরোপের অন্যান্য নেতারাও একই ধরনের বাঁধনে আবদ্ধ রয়েছেন। কেউ কেউ হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের মতো ভান করে আছেন যে, সমস্যাটি আসলে তাদের নয়। তারা এটিকে শুধুমাত্র অভিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।

পূর্বে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত ডেনমার্ক কার্যত তার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে,  এমনকি যুদ্ধ-আঘাতগ্রস্ত সিরিয়াতেও।

কিন্তু অভিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং নিজ দেশের সহযোগিতা ছাড়া  তাদের দেশে ফেরত পাঠানো কঠিন। অবশ্য ইইউ এখনও আইনের শাসন বাস্তবায়নের শপথ করে এবং নিজেকে শালীনতার দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখতে পছন্দ করে, বিশেষ করে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো ‘বর্বর’ শাসনের বিপরীতে।

শুধুমাত্র এ কারণগুলিই বিমানে লোকদের ঠেলে দেওয়া কঠিন করে তোলে। এটা জেনে যে, তারা তালেবান, বা বোকো হারাম, বা দুই জেনারেলের সৈন্যরা, যারা এখন সুদানকে ছিঁড়ে ফেলছে, বা অন্যদের দ্বারা স্বাগত হতে পারে। এই ধরনের জটিলতাগুলি ব্যাখ্যা করে যে, কেন প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ  অভিবাসীর মধ্যে মাত্র ২১ শতাংশ ইইউ ছেড়ে চলে যায়।

আরো পড়ুন: বেলারুশ-পোল্যান্ড অভিবাসী সংকট: ইউরোপীয় স্বপ্ন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ডলারে!

বাস্তবতা হলো, অভিবাসন প্রত্যাশীরা অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপে আসতে থাকবে – এবং তা অবশ্যই ক্রমবর্ধমান সংখ্যায়। ঠিক যেমন তারা দক্ষিণ এবং মধ্য আমেরিকা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রসর হতে থাকবে।

কারণ তারা এমন জায়গা থেকে এসেছে যা পৃথিবীতে নরকের মতো। বিপরীতে তারা ইউরোপ বা আমেরিকাকে আপেক্ষিক স্বর্গের মতো মনে করে। তারা বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলার দিকে পলায়নকারী জনগণ। তারা আশার সন্ধানে হতাশাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি হলেও যা করবো, তারা মূলত তাই করছে।

আসন্ন অভিবাসনের সম্ভাবনার আভাস পেতে, সাহেল এর দিকে একবার খেয়াল করুন: সাহারার ঠিক দক্ষিণে আফ্রিকার শুষ্ক প্রান্তর। এই অঞ্চলের সমস্যাগুলি খরা এবং দুর্ভিক্ষের সময় শুরু হয়, যা নৃতাত্ত্বিক জলবায়ু পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ বাড়িয়ে তুলেছে। ( এটা ‍যুক্ত করা উচিত যে, আফ্রিকানদের দ্বারা নয় বরং এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং অন্যত্র ধনী দেশগুলির দ্বারা সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত সমস্যার কারণে)

খরা হলো সাহেলের সমস্যার শুরু মাত্র। বুরকিনা ফাসোর অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সুদান বা মালিতে গৃহযুদ্ধ, সেইসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ‘ইসলামিক’ সন্ত্রাস এবং যত্রতত্র সহিংসতা, জাতিগত বিবাদ এবং অন্যান্য সংঘর্ষ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

একসঙ্গে, এই আঘাতগুলি রেকর্ড ৩৬ মিলিয়ন আফ্রিকানকে বাস্তুচ্যুত করেছে, যা এক দশক আগের সংখ্যার তিনগুণ। অর্থাৎ এখনও আফ্রিকায় এই শরণার্থীদের চারজনের মধ্যে তিনজনই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যূত।

এপর্যায়ে সবচেয়ে পৈশাচিক অংশ আসছে। প্রকৃতপক্ষে এই পৃথিবীতে এমন কিছু লোক আছে, যারা মানবিক কষ্টে আনন্দিত হয় এবং এটিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে চায়। কারণ তারা ব্যাপক অভিবাসন ঘটাতে চায়। যা ইইউকে ভেঙে ফেলবে বা আলাদা করে দেবে।

আরো পড়ুন: ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর অভিবাসী ফুটবলাররা…

ইয়েভজেনি প্রিগোজিন-কে দেখুন। পুতিনের আস্থাভাজন, যিনি ওয়াগনার গ্রুপ পরিচালনা করেন, একটি রাশিয়ান আধাসামরিক গোষ্ঠী, যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী সংস্থা ও ক্রেমলিনের প্রক্সি হিসাবে বিবেচনা করে।

সম্প্রতি রাশিয়ার কারাগার থেকে আসামীদের মুক্তি দিয়ে তাদেরকে ‘কামানের খাদ্য হিসাবে’ নিয়োগ দিয়ে বাখমুতের মতো জায়গায় ইউক্রেনীয় লাইনে আক্রমণ করার জন্য পাঠাচ্ছেন বলে খবরের শিরোনামে প্রিগোজিনের নাম উঠে এসেছে। ওদিকে ওয়াগনার অনেক দেশে কাজ করে, এবং আফ্রিকাতে তাদের বিশেষ একটি আগ্রহ তৈরী হয়েছে।

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া মার্কিন গোয়েন্দা নথি অনুসারে, ওয়াগনার-রাশিয়ান রাষ্ট্রের মতো-প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি, ফ্রান্স এবং পরাশক্তি, আমেরিকার দ্বারা এই অঞ্চলে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের সুবিধা নিতে সক্রিয়ভাবে সাহেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।  দ্বন্দ্বে জড়াতে ইচ্ছুক যেকোনো যুদ্ধবাজের কাছে সামরিক সেবা বিক্রি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য।

একটি টার্গেট হলো চাদ। এটি সমস্যায় জর্জরিত একটি দেশ – সরকারী বাহিনী অক্টোবরে অনেক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে। তবে ইসলামিক বিদ্রোহের বিরুদ্ধে লড়াইও করছে মার্কিন এবং পশ্চিমা মিত্রও।

ওয়াগনার স্পষ্টতই চাদিয়ান সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করার জন্য সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, চাদ এবং অন্যান্য জায়গা থেকে যোদ্ধাদের নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সম্ভবত এমনকি এর নেতা মহামত ইদ্রিস ডেবি ইটনোকেও হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে।

আরো পড়ুন: ইউরোপে অভিবাসীদের ঠেকাতে শব্দের বিস্ফোরণ!

এই অভ্যুত্থান প্রিগোজিনের পরিকল্পনার একটি অংশ হবে। এবং সেইজন্য সম্ভবত পুতিন অঞ্চলটিকে পশ্চিমের বিরুদ্ধে পরিণত করার জন্য এবং অবশ্যই ইউরোপের দিকে ব্যাপক অভিবাসন ঘটাতে সাহেলজুড়ে বিদ্রোহ ও বিবাদকে উস্কে দিবেন।

যেহেতু ইইউ-এর ২৭ জন নেতা এই বছর তাদের অকার্যকর আশ্রয়ন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার বিষয়ে ঝগড়া করছেন সেহেতু অভিবাসনের সমস্যাটি হয় সমাধান বা উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে-এ বিষয়ে তাদের কারোরই বিভ্রম কাটছে না।

ব্রাসেলসে এই ধরনের অস্পষ্ট মূল্যায়ন খুব কমই হয়। যদিওবা কিছু হয়, তাও কেবল অসততায় ঠাসা। দুঃখজনক হলো: ইউরোপীয় হওয়ার মূল্যের মধ্যে থাকবে “আমাদের সমুদ্র, ভূমধ্যসাগর থেকে মৃতদেহ টেনে আনা।”

লেখক: ব্লুমবার্গ ও দ্য ইকোনমিস্ট এর লেখক। হ্যান্ডেলসব্লাট গ্লোবাল এর প্রাক্তন সম্পাদক এবং ‘হ্যানিবল অ্যান্ড মি’ এর রচয়িতা।

ভাষান্তর করেছেন: রুবেল পারভেজ, নির্বাহী সম্পাদক, অভিবাসী ডটকম

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা