রাষ্ট্রহীনতার অসহায়ত্ব: পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিদের দুর্দশা আর কবে ঘুচবে?

0
763
পাকিস্তানে রাষ্ট্রহীন বাঙ্গালি
পাকিস্তানের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেও জাতিগত বাঙালিরা সরকারী স্বীকৃতি ও নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে

পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর করাচিতে বেড়ে ওঠা দুই তরুন জিমন্যাস্ট কিরান জাফার ও কুলসুম ইয়ামির দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গণে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য স্বপ্ন দেখছেন এবং সেভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারা দুজনই জানেন যে, তাদের এই স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা খুৃবই ক্ষীণ। কারণ তারা পাকিস্তানে বসবাসরত রাষ্ট্রহীন বাঙালি। পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করলেও তারা রাষ্ট্রহীন পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে। মোটকথা, সরকারিভাবে কোনো স্বীকৃতি বা পরিচয়পত্র না থাকায় তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এগোতে পারছেন না।

১৫ বছর বয়সী জাফার ও ১৪ বছর বয়সী ইয়ামির বাঙ্গালি অধ্যুষিত মাচার কলোনিতে বসবাস করেন। এটি করাচির অন্যতম বড় বস্তি হিসেবে পরিচিত। এখানে ৭ লাখ মানুষের বসবাস। জাফার ও ইয়ামির তাদের পরিবারের সঙ্গে জরার্জীণ ছোটো ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন। এখানকার রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এরকম পরিবেশেই তারা নিত্যদিনের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রশিক্ষণরত জাফার ও ইয়ামির । ছবি: আল জাজিরা

‘ইমকান ওয়েলফেয়ার অরগ্যানাইজেশন’ নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও আইনজীবী তাহেরা হাসান জানান, মাচার কলোনিতে বসবাসরত মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ জাতিগতভাবে বাঙালি। এদের অর্ধেকের বেশির নাগরিকত্ব নেই অথবা নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার দোদুল্যমানতার মধ্যে রয়েছে।

জন্মগত অধিকার আইন থাকা স্বত্বেও তারা নাগরিকত্ব পায়নি। এটা বঞ্চনাকর এবং এই ইস্যুটির সুরাহা অবশ্যই করা হবে’-বলেছিলেন ইমরান খান। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর তিন বছর হতে চলছে, তার সেই বক্তব্যের কোনো বাস্তবতা এখনো অর্জিত হয়নি।

ইয়ামি নিজেকে একজন জিমন্যাস্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। সে ভবিষ্যতে নিজেকে একজন প্রশিক্ষক হিসেবেও দেখতে চায়। জাফারও মুচকি হেসে প্রায় একই ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেন, ‘বড় হয়ে আমি পেশাদার জিমন্যাস্ট হতে চাই, এমনকি প্রশিক্ষকও হতে চাই, খেলাধুলা বিষয়ে অন্যদের শেখাতে চাই। ‘কিন্তু আমাদের পরিবার পরিচয়পত্র পাওয়ার জন্য রীতিমত লড়াই করে যাচ্ছে। এছাড়া ভালো স্কুলে যাওয়া এমনকি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাও আমাদের জন্য অনেক কঠিন’-আল জাজিরাকে বলেন ইয়ামির।

চরম দারিদ্রতার মধ্যে বেড়ে ওঠা

বস্তির মধ্যে অবস্থিত ‘খেল’ নামের একটি প্রশিক্ষণ ও রিক্রিয়েশনাল সেন্টারে জাফার ও ইয়ামির প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। শিক্ষাকেন্দ্রটি ১৭০ টি ঝরেপড়া শিশুকে খেলাধুলাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এদের মধ্যে জাফার ও ইয়ামিরও রয়েছেন।
পাকিস্তানে প্রায় ২০ লাখ জাতিগত বাঙালি রয়েছে, যারা কিনা সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠী।

ছবি: সংগৃহীত

বিপুল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে থেকে এখানে বসবাস করে আসছে। অনেকে পাকিস্তানেই জন্মগ্রহণ করেছে। এই বাঙালি জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি ও নাগরিকত্ব পায়নি। তাদের ভোট দেয়া, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার অধিকার নেই, তারা সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পর্যন্ত পারে না।

‘তাদের কাছে আমরা যেন ভিনগ্রহের প্রাণী, শরণার্থী, বিদেশি, তারা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে’-বলেন পাকিস্তান বাঙালি অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুহাম্মদ সিরাজ। তিনি ১৯৯৩ সাল থেকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষদের অধিকার নিয়ে লড়াই করছেন।

‘আমরা এই দেশে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমাদের কমিউনিটির অনেক মানুষের কোনো পরিচয়পত্র নেই, তারা সবাই রাষ্ট্রহীন। অথচ তাদের অনেকেই এই ভূমিতে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই বসবাস করছে। আমরা বাঙালি কিন্তু পাকিস্তানি বাঙালি।’

ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া

প্রথম পর্যায়ে যেসব বাঙালি যুদ্ধের পরও পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের ম্যানুয়াল পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছিল। এগুলো ইস্যু করা হয়েছিল ১৯৭৩ সাল ও এর পরবর্তী সময়ে। কিন্তু নাগরিকত্বের মূল ঝামেলা বাধে আইডি কার্ড ডিজিটালাইজেশন এবং ২০০০ সালে ন্যাশনাল ডেটাবেজ অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি (এনএডিআরএ) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। এর ফলে কাগজপত্র সংক্রান্ত নানাধরনের সঙ্কট শুরু হয়।

ডিজিটাইজেশনের পর একই বছর ন্যাশনাল এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন অথরিটি (এনএআরএ) প্রতিষ্ঠা করা হয় অভিবাসী ও বিদেশি বাসিন্দাদের নিবন্ধন করার জন্য। যদিও বাঙালিরা পাকিস্তানে বসবাস করলেও ভিনগ্রহের শ্রেণিতে পড়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে।

ছবি: আল জাজিরা

এনএআরএর পদক্ষেপসমুহ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর কৌশলে বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। ‘এখানে অনেক বাঙালির পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র ছিল। কিন্তু পরে তাদের সবাইকে এনএআরএ কার্ড গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এছাড়া বায়োমেট্রিকসও করা হয় বাধ্যতামূলকভাবে। এর ফলে স্বয়ংক্রিভাবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়।

সিরাজ এর মতে, ‘২০০২ সাল থেকে তাদের পরিচয়পত্র বাতিল হতে থাকে এবং তারা বিদেশি ইস্যু হিসেবে অ্যাখ্যায়িত হন।
২০১৫ সালে এনএআরএ ও এনএডিআরএ একীভূত হলেও বাঙালি নাগরিকদের পরিচয়পত্র ইস্যু নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারেনি পাকিস্তান সরকার।

এ ধরনের আচরণকে মানবাধিকার লঙ্ঘণ বলে অ্যাখ্যা দিচ্ছেন স্থানীয় নেতারা। সিরাজ বলেন, ‘অসংখ্য বাঙালি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে থেকেই পাকিস্তানে বসবাস করছে। আমাদের ভোটের অধিকার আছে এবং এই দেশের বৈধ নাগরিক আমরা।’

এ বিষয়ে মতামত নিতে এনএডিআরএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আল জাজিরা যোগাযোগ করলে তাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘ওয়াদা রক্ষা করেননি’

২০১৮ সালে, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে ইমরান খান বাঙালিদের পাকিস্তানি জাতীয় পরিচয়পত্র ও নাগরিকত্ব দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। ‘এখানে (বাঙালি) শিশু রয়েছে, যারা কিনা পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছে। এমনকি তাদের পূর্বপুরুষেরা দশকের পর দশক ধরে এই দেশে বসবাস করে আসছে। জন্মগত অধিকার আইন থাকা স্বত্বেও তারা নাগরিকত্ব পায়নি। এটা বঞ্চনাকর এবং এই ইস্যুটির সুরাহা অবশ্যই করা হবে’-বলেছিলেন খান।

দায়িত্ব গ্রহণের পর তিন বছর হতে চলছে, কিন্তু তার সেই বক্তব্যের কোনো বাস্তবতা এখনো অর্জিত হয়নি। সিরাজ বলেন, ‘খান প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, যদি তার দল পিটিআই জয়লাভ করে তাহলে বাঙালিরা পরিচয়পত্র পাবে। তিনি করাচিতে গভর্নর হাউজে বসে এমনকি জাতীয় পরিষদেও এসব কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেননি।’

পিটিআই এর জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক ও মানবাধিকার বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিরিন মাজারি আল জাজিরাকে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়

জাফার ও ইয়ামির তাদের বাবা মার মতোই পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছেন। পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫১ অনুসারে পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী যেকোনো ব্যক্তির নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু জাফার ও ইয়ামিরের পরিবারের কোনো সদস্যেরই পরিচয়পত্র নেই। তাদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করা বা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করা অসম্ভব।

আইনজীবী তাহেরা হাসান বলেন, ‘পাকিস্তানে জন্মগত অধিকারের অন্যতম প্রগতিশীল একটি আইন রয়েছে। তারা মোটেও বৈষম্যমূলক নয়। কিন্তু মূল সমস্যাটি ঘটে বাস্তবায়ন স্তরে।’ এর ফলে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে তারা সরকারি স্কুলগুলোতেও ভর্তি হতে পারে না।

মাচার কলোনির শিশুরা। ছবি: আল জাজিরা

জাফার ও ইয়ামির অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী। তারা সুশৃঙ্খলভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে অবিচল। তারা ভোর থেকে তাদের কাজ শুরু করেন। প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গিয়ে জিমন্যাস্ট হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তারা । শুধু তাই নয়, তারা পরিবারের কাজে বাবা-মাকে সহায়তা করেন। বিকাল হলে স্থানীয় মাদ্রাসায় যোগ দেন।

জাফার এর মায়ের নাম খালিদা। ৪০ বছর বয়সী এ নারী মাত্র ৫ বছর বয়সে পিতামাতা হারিয়েছেন। ‘শৈশব থেকে আমি মাচার কলোনিতে আছি। আমার বাবা-মাও এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারপরও আমি এখন পর্যন্ত পরিচয়পত্র পাইনি’-বলেন খালিদা।

খালিদার স্বামী প্রহরী হিসেবে কাজ করেন। সন্তানের ভবিষ্যত যেন উজ্জ্বল হয় সেজন্য তিনি প্রতিনিয়ত দোয়া করেন। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো ছেলে সন্তান নেই। কিন্তু তা নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত নই। আমার মেয়ে জিমন্যাস্টে সত্যিই দক্ষ। আমরা তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করি এবং তার খেলাধুলা ও ভবিষ্যত জীবনের জন্য সবসময় তার সাফল্য কামনা করি।’

সামাজিক কর্মী ও আইনজীবী রানা আসিফ হাবিব বলেন, ‘পাকিস্তানে বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতি সংঘঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো আপত্তি বা কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। এমনকি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এই ইস্যুটিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।’

আসিফ হাবিব মনে করেন, ‘মানবাধিকার বিষয়ক বৈশ্বিক সনদে স্বাক্ষর করা দেশ হওয়া স্বত্বেও পাকিস্তান বাঙালিদের বিষয়ে এখনো গাছাড়া মনোভাব দেখিয়ে আসছে। ফলে প্রতিনিয়ত এ জনগোষ্ঠীকে লড়াই করে যেতে হচ্ছে এবং চরম শঙ্কার মধ্যে দিনানিপাত করতে হচ্ছে। অনেকে দাবি করেছেন, জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে সহজতর করা বা এমন একটি পথ খোলা রাখা প্রয়োজন, যাতে করে পাকিস্তানে জন্ম নেয়া শিশুরা মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।’

সূত্র: সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন তুষার ফারুক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here