তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান আরো সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া এবং সাদরে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি পরিস্কার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে, অতিরিক্ত শরণার্থী অবশ্যই তার দেশে আশ্রয় পাবে।
আরব-আশ্রয় প্রার্থীদের স্রোত কখনোই থামবে না। আরবে বসবাসরত মানুষের দুঃখ বারবার এই ঘটনারই সাক্ষী বহন করে। আরবের অনেক মানুষের কাছে আশ্রয়টাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হয়ে উঠেছে। এটি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, অনেকেই বাধ্য না হওয়া স্বত্ত্বেও আশ্রয় প্রার্থনার চর্চা শুরু করেছে। এটা মূলত নিজেদের জন্মভূমি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ডায়াসপোরা হিসেবে জন্ম নেওয়া প্রজন্মগুলিই হলো হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম। আর তারা হারিয়েই যাবে। কেননা তারা অন্যের ভূমিতে বাস করছে। তাদের প্রকৃত কোনো শিকড় নেই। অন্য দেশ তাদের দত্তক নিয়েছে এবং লালন-পালন করছে।
আরবদের অস্থায়ী বসবাসের জন্য মাতৃভূমি ত্যাগ করা ছাড়া আর অন্য কিছু করার নেই। তারা যতদিনই সেখানে বসবাস করুক না কেনো, সেটা তাদের নিজের বাড়ি হয়ে উঠবে না।
আর এটা এক ধরনের স্থায়ী প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। আরবরা তাদের নিজেদের সমাজ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যক্তিগত এই উদ্যোগগুলি একটি বিশাল বহিঃপ্রবাহ তৈরি করেছে। যার জন্যে সমাজগুলি তাদের রীতিনীতি পরিবর্তন করছে এবং তাদের ইতিহাসকেও পরিত্যাগ করছে।
জনগণের ভাগ্য নিয়ে এই জঘন্য খেলা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে শেষমেষ, সেটা আমরা কেউই বলতে পারবো না! ‘যারা আশ্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে দেশ থেকে পালিয়েছে, তাদের এটা করার তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না। আর যাদের প্রকৃতই সুরক্ষার দরকার তারাই বরং আসেনি’। সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপে আসা শরণার্থীদের নথিপত্র ভালোভাবে দেখলেই, এই কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। ইরাকিরা অতীতে যা করেছে, কুর্দিরা বর্তমানে সেই একই কাজ করছে।
এরদোগান খুব ভালোভাবেই জানেন যে, শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া একটি লাভজনক খেলা হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর আগে, সিরিয়ায় শরণার্থীদের ঢেউ থামানোর জন্য তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তিন বিলিয়ন ইউরো ঘুষ পেয়েছিলেন
এটা স্পষ্ট নয় কি, ইরাকের রাসায়নিক হামলা থেকে বাঁচতে এক মিলিয়নেরও বেশি সিরিয়ান, ইরাকি এবং ইরানি কুর্দি আশ্রয় পেয়েছে? এই প্রবণতার কারণে মানবাধিকার সংস্থাগুলি আশ্রয় প্রদানকারী দেশগুলিকে আশ্রয় আইন পরিত্যাগ করার কথা বলছে। ফলে এটা কোনো না কোনোভাবে ইউরোপের ডানপন্থী দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী কর্মসূচিতে মুসলিম শরণার্থীদের বহিষ্কার করতে উৎসাহিত করছে।
নিজেদের সুবিধার জন্য, পশ্চিমা রাজনৈতিক দলগুলো বেশকিছু দেশে উদ্বাস্তু বৃদ্ধিকে সমর্থন জানিয়েছে এবং এ বিষয়টি উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়াতে উৎসাহিত করেছে। সাদ্দাম হোসেনের অধীনে ইরাকের সঙ্গে এমনটাই ঘটেছিলো। সেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে চার মিলিয়ন নাগরিককে বহিষ্কার করা হয়েছিলো এবং তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছিলো। পাশাপাশি তাদের আক্রমণ এবং উৎখাত করা হয়েছিলো। জর্ডান এবং তুরস্কে শিবির স্থাপন করা হযেছিলো বলে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সিরিয়ার সঙ্গে এমনটা করা হয়েছিলো। সিরিয়রা বিশ্বাস স করতো যে, সেখানে থাকাটা ইউরোপের তুলনায় নিরাপদ। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবতা একেবারেই মেলেনি।
আরো পড়ুন
শরণার্থী ইস্যু : এখনো ইঁদুর-বিড়াল খেলায় মত্ত লিথুয়ানিয়া-বেলারুশ
জনসংখ্যার সীমানা দশ মিলিয়নে থেমে গেছে। সিরিয়ানরা তাদের দেশবাসীর পথটাকে অনুরণ করার প্রচেষ্টায় নিমজ্জিত হয়েছিলো। কিন্তু তাদের ভুল ভাঙ্গে যখন ইরাকিরা বেলারুশের সীমানা অতিক্রম করে পশ্চিম ইউরোপে যেতে না পেরে হতাশ হয়েছিলো। সেসময় যারা বেঁচে গিয়েছিলো তারা ভয়ংঙ্কর অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছিলো। কিন্ত তারা যা করেছিলো, তার জন্য কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না।
জীবনের জন্য উদ্বাস্তু হওয়ার অর্থ কেউ জানতো না। মূলত শরণার্থীদের সন্তান এবং নাতি-নাতনিরা উত্তরাধিকারসূত্রে সবসময়ই উদ্বাস্তু হবে। এটি এমন একটি অবমূল্যায়নকর প্রক্রিয়া। বিপর্যয় আরো বেড়ে যায়, যখন উদ্বাস্তুরা যে দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে, সেই দেশগুলো তাদের নিজেদের নাগরিকের ভবিষ্যত তেমন হবে সেটা নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায় না।
আরো পড়ুন
বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকট নিয়ে ১২টি মর্মান্তিক তথ্য…
সম্প্রতি আরবের এক নেতা স্পষ্টভাবে বলেছেন ‘যার এখানে থাকতে ভালো লাগে না, সে যেতে পারে’। যেনো মাতৃভূমি তাদের পিতামাতা দ্বারা এই নেতাদের কাছে দেওয়া ব্যক্তিগত বাড়ি বা সম্পত্তি।
একটি ধনী দেশ থেকে শরণার্থীর ধারণাটি কোনো স্বাগতিক দেশের পক্ষে গ্রহণ করা একটু কঠিন। বলা হয়, সোমালিয়ানরা একটি দরিদ্র দেশে জন্মগ্রহণ করেছে। যেখানে ইরাকিরা সর্বদা একটি ধনী দেশের সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে। এখানে সন্দেহ তাদের সবসময় তাড়া করবে। যদি তাদের অনেকেই ধনী অভিবাসীর জীবনযাপন করে থাকে, তাহলেও তাদের অগ্নিপরীক্ষা শেষ হবে না। কথা হলো, শরণার্থীর পরিচয় নিতে কেইবা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে?
আরো পড়ুন
যেখানে শরণার্থীদের জন্য খাবারের চেয়ে মাদক সস্তা
এরদোগান খুব ভালোভাবেই জানেন যে, আশ্রয় একটি লাভজনক খেলা হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর আগে, সিরিয়ায় শরণার্থীদের ঢেউ থামানোর জন্য তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তিন বিলিয়ন ইউরো ঘুষ পেয়েছিলেন। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল যখন এক মিলিয়ন সিরিয়ান শরণার্থী গ্রহণের জন্য তার প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন, এটা তখন নাগরিকদের তাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে উৎসাহিত করেছিলো।
কিছুই নয় উদ্বাস্তু, এটা সঠিক ধারণা নয়। প্রতিটি শরণার্থীই একটি আন্তর্জাতিক সমীকরণে একটি সংখ্যা। তাদেও পরিচয় স্বদেশ থেকে মুছে ফেলা হয়। যাতে আমরা সবাই স্বদেশবিহীন হয়ে যাই।
আরব উইকলিতে প্রকাশিত ইরাকি লেখক ফারুক ইউসেফ এর নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন রীতা জান্নাত