১০ জুন। ৪৭ বছর বয়সী আফগান নাগরিক মোহাম্মদ ইলিয়াস সাফি মস্কোর বিমান ধরতে কাবুল এয়ারপোর্টে আসেন। রাশিয়ার রাজধানী পৌঁছে তিনি বেলারুশ-লিথুয়ানিয়া সীমান্তের উদ্দেশে যাত্রা করেন। খানিকটা সময় গাড়িতে চড়ে, খানিকটা সময় হেঁটে তিনি গন্তব্যের দৈর্ঘ্য কমাতে থাকেন। একপর্যায়ে ইলিয়াসের চেষ্টা সফল হয়; পৌঁছে যান সীমান্ত এলাকায়।
৫ জুলাই। ইলিয়াসসহ আরো কয়েকজন স্বপ্নবাজ শরণার্থী ও অভিবাসী বাল্টিক দেশসমূহে (উত্তর ইউরোপে বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত তিনটি দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া) ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা কঠিনতর করে ফেলে সীমান্তরক্ষী।

এই যাত্রায় খুব সহজে লিথুয়ানিয়া যাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপনে প্রলোভিত হয়ে ইলিয়াস দালালের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১৫ হাজার ডলার।
বর্তমানে লিথুয়ানিয়ার একটি অভিবাসী কেন্দ্রে নিদারুন কষ্টে অবস্থান করছেন ইলিয়াস। যেখানে তিনি তার ভবিষ্যত নিয়ে প্রতিনিয়ত শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে লিথুয়ানিয়ায় রেকর্ডমাত্রায় প্রবেশ করা ৪ হাজার মানুষের মধ্যে একজন ইলিয়াস। গত বছরের তুলনায় অভিবাসনের এই সংখ্যা ৫৫ গুণের বেশি। যাদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত। এর মধ্যে ইরাকিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, বাকিরা আফ্রিকা থেকে এসেছে।
লিথুয়ানিয়ার সরকার বলছে, ২৬ মে’র পর থেকে অনিয়মিত অভিবাসনের হার বেড়ে গেছে। দেশটির দাবি বেলারুশ সরকার পরিকল্পনা করেই তাদের সীমান্তের দিকে শরণার্থীদের ঠেলে দিচ্ছে। দেশটি বেলারুশের প্রেসিডেন্টের একটি উক্তিকে উপজীব্য সরাসরি বেলারুশকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করছে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো নাকি পার্শ্ববর্তী দেশে অভিবাসী ও মাদকের বন্যা বইয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। লিথুয়ানিয়া ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের কর্তাব্যক্তিরা এই অভিবাসনকে ‘হাইব্রিড’ আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছেন। অভিবাসীরা এই ফাঁদে আটকা পড়েছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রাশিয়া সমর্থিত বেলারুশ ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের মধ্যে অভিবাসী-শরণার্থীদের নিয়ে টানাটানি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যেখানে দেখা গেছে, গত বছরের বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর লুকাশেঙ্কোকে আরেকটি মেয়াদে ক্ষমতায় বসানোর পর উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা বেড়েছে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো ঘটনা ঘটেছে।
একপক্ষ আরেকপক্ষের দিকে যেভাবে অভিযোগের আঙুল তুলছে, তা দেখে বিশ্লেষকদের মন্তব্য, শরণার্থী প্রসঙ্গটি নিয়ে লিথুয়ানিয়া ও বেলারুশের মধ্যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলছে।
এদিকে লিথুয়ানিয়ায় অভিবাসীদের মানবাধিকার ‘পরিস্থিতি’কে উদ্বেগজনক বলে দাবি করেছেন ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র এলিজাবেথ হাসলান্ড।
বেলারুশ সীমান্তের নিকটবর্তী গ্রামের ছোট একটি অস্থায়ী বাড়িতে নারী ও শিশুসহ ১৩০ জন অভিবাসী ও শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। যেখানে একটি রুমে গাদাগাদি করে ২০-২৫ জন করে থাকছেন।
স্কুলের মাঠে সন্তানদের খেলার দৃশ্য উপভোগ করছিলেন ইরাক থেকে আগত ৪২ বছর বয়সী নারী বেখাল হামা সাইদ। সন্তানদের বয়স যথাক্রমে নয়, সাত ও ছয় বছর। এই পরিবারটি ২০ জনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটি রুমে থাকছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি এই পরিস্থিতি ‘খুব খারাপ’ উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘প্রতিদিনই কান্না করতে করতে আমার হৃদয় পাথর হয়ে যায়।’
এদিকে লিথুয়ানিয়ায় রেড ক্রসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইগল সামুচোভাইত জানান, এখানে ‘তথ্যগত শুণ্যতা’ তৈরী করে রাখা হয়েছে। অনেক শরণার্থী তাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছে না। এর ফলে তাদের মধ্যে দুঃশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ বেড়ে গেছে। ‘মনে হচ্ছে আমি জেলে বন্দি। তারা আমাকে মানসিকভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে। তারা আমাকে বাইরে বের হতে দেয় না। এমনকি তারা আমাকে কোনো তথ্য দেয় না’-বলেন আফগানিস্তান থেকে আগত খান ফারুক নামের একজন শরণার্থী।

এ শরণার্থী লিথুয়ানিয়া সরকারকে উদ্দেশ্যে করে রাগান্বিত স্বরে আরো বলেন, ‘তোমাদের আর বেলারুশের মধ্যে কী ঘটছে তা জেনে আমার কোনো কাজ নেই। আমি হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তান থেকে এসেছি। আমি একজন মানুষ। আমি ইউরোপ যেতে পারি, যেকোনো জায়গায় যেতে পারি। ইউরোপের এমন হওয়া উচিৎ নয়। আমরা আবারও প্রতারিত হয়েছি। আমরা আবারো বিক্রি হয়ে গেছি। ইতিহাস এমনই চলে আসছে।’
লিথুয়ানিয়ায় ২ আগস্ট থেকে অভিবাসীরা সীমান্ত পাড়ি দিতে পারছে। আগস্টের ২ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৮০ জন অভিবাসী লিথুয়ানিয়ায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। সবমিলিয়ে আগস্টের ২০ তারিখ পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষ দেশটিতে আশ্রয়ের জন্য নাম নিবন্ধন করেছেন।
সূত্র: আল জাজিরা