বৃহস্পতিবার, 21 নভেম্বর, 2024

শুরু হয়েছে গণ অভিবাসনের এক নতুন ঢেউ

২০১৬ সালে ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পক্ষে এবং তারপরে আমেরিকানরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। সেসময় এই দুই দেশের রাজনৈতিক ময়দানেই একটি শক্তিশালী অভিবাসী বিরোধী অবস্থান ছিল।

গত বছর ১২ লাখ মানুষ ব্রিটেনে পাড়ি জমিয়েছে—যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই রেকর্ড। অস্ট্রেলিয়ায় মোট অভিবাসন বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারীর আগের হারের দ্বিগুণ। একইভাবে স্পেনের পরিসংখ্যানও সম্প্রতি সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। প্রায় ১৪ লাখ মানুষ চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা কিনা মহামারীর আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি।

২০২২ সালে কানাডায় মোট অভিবাসন আগের রেকর্ডের দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। ২০১৫ সালের “অভিবাসন সংকটের” তুলনায় জার্মানিতে এ সংখ্যা আরও বেশি ছিল। সামগ্রিকভাবে ধনিক শ্রেণির বিশ্ব একটি অভূতপূর্ব অভিবাসনের ঢেউয়ের মাঝখানে অবস্থান করছে। যেখানে বিদেশী বংশোদ্ভূত জনসংখ্যা ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে। (চার্ট-১ দেখুন)

আদতে এসব লক্ষণ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কী বার্তা দিচ্ছে? খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, মনে হচ্ছিল অনেক ধনী দেশই গণ অভিবাসনের বিরুদ্ধে একটা কঠোর সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান তৈরী করতে পেরেছে। ২০১৬ সালে ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পক্ষে এবং তারপরে আমেরিকানরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। সেসময় এই দুই দেশের রাজনৈতিক ময়দানেই একটি শক্তিশালী অভিবাসী বিরোধী অবস্থান ছিল।

পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া থেকে হাঙ্গেরি পর্যন্ত রাজনীতিবিদরা অভিবাসন রোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তারপর কোভিডের কারণ দেখিয়ে সীমান্তও বন্ধ করে দেয়া হয়। অবস্থা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিলো যে, অভিবাসনের স্রোত কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে, এমনকি গতিধারা বিপরীত দিকেও চলে যেতে দেখা যায়। কারণ উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কড়াকড়ির চাপে তখন অভিবাসন প্রত্যাশীরা বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলো। যে দেশগুলি সাধারণত প্রচুর অভিবাসী গ্রহণ করে, সেই দেশগুলোর মধ্যে কুয়েত এবং সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা ২০১৯ এবং ২০২১ সালের মধ্যে চার শতাংশ হারে কমে গিয়েছিলো। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী অভিবাসীদের সংখ্যা ১৯৪০ এর দশকের পর প্রথমবারের মতো অভিবাসীদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য কিছু দেশে অভিবাসন বৃদ্ধি স্বাভাবিকতার অনুভূতি ফিরিয়ে এনেছে। সিঙ্গাপুরের বিদেশী কর্মী বাহিনী সম্প্রতি তার প্রাক-মহামারী স্তরে ফিরে এসেছে।

নিউফাউন্ডল্যান্ডে শত শত ইউক্রেনীয় এসেছেন। যা কিনা রাশিয়া আক্রমণ করার পর থেকে ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ লোকজনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। ভারতীয় এবং নাইজেরিয়ানদেরও প্রচুর সংখ্যায় অগ্রসর হতে দেখা যাচ্ছে। অনেকেই ইংরেজিতে কথা বলে এবং অনেকের ইতিমধ্যেই ধনী দেশগুলিতে বিশেষ করে ব্রিটেন এবং কানাডায় পারিবারিক সংযোগ রয়েছে।

আরো পড়ুন: ‘বয়স্ক’ অভিবাসীদের নির্মম বাস্তবতার গল্প আমরা কতটুকু জানি

মহামারী পরবর্তী অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যার একটি বড় অংশ। ধনী বিশ্বে বেকারত্বের হার চার দশমিক আট শতাংশ।  কয়েক দশক ধরে এ হার এত কম হয়নি। শুন্য পদে কর্মী নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলি মরিয়া। বিদেশ থেকে আসা মানুষদের এইভাবে ভ্রমণ করার উপযুক্ত কারণ রয়েছে।

মুদ্রার গতিবিধি অন্য কারণ হতে পারে। একটি ব্রিটিশ পাউন্ড দিয়ে ২০১৯ সালে যেখানে ৯০ ভারতীয় রুপী ক্রয় করা যেতো, সেখানে পরবর্তীতে তা ১০০ রুপীতে ঠেকে। ২০২১ এর শুরু থেকে গড় উদীয়মান-বাজার মুদ্রা ডলারের বিপরীতে প্রায় চার শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। অবশ্য এটি অভিবাসীদের আগের চেয়ে বেশি হারে টাকা বাড়িতে পাঠানোর পথ সুগম করে দেয়।

অনেক দেশের সরকার আরও অভিবাসী আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। ২০২৩-২০২৫ সালেরে মধ্যে ১৫ লাখ নতুন বাসিন্দাদের স্বাগত জানানোর একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে কানাডার। জার্মানি এবং ভারত সম্প্রতি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যাতে আরও বেশি ভারতীয়কে জার্মানিতে কাজ এবং পড়াশোনা করার অনুমতি দেওয়া হয়।

অস্ট্রেলিয়া দুই থেকে চার বছর স্নাতক হওয়ার পর কিছু শিক্ষার্থী কাজ করতে পারে, এমন সময়কাল বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্রিটেন চীনা নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা হংকংবাসীদের স্বাগত জানিয়েছে। অনেক দেশ ইউক্রেনীয়দের প্রবেশ সহজ করে দিয়েছে। এমনকি জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ অভিবাসনের জন্য প্রতিকূল দেশগুলিও বহিরাগতদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখাচ্ছে। কারণ তারা বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যার প্রভাবকে প্রতিহত করতে চায়।

আরো পড়ুন: মানবাধিকার রক্ষা নয়, অভিবাসী বন্টন নিয়েই বেশি চিন্তিত ইউরোপ

যে দেশের অর্থনীতি প্রচুর সংখ্যক অভিবাসীদের স্বাগত জানায়, তাদের দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়ার প্রবণতা বেশি। শুধু আমেরিকার দিকে তাকান: দেশটিতে বিদেশী লোক তাদের সঙ্গে নিত্য নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে আসে। ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির পিয়েরে আজৌলে এবং সহকর্মীদের করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকায় ফার্ম খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় বংশোদ্ভূত লোকদের তুলনায় অভিবাসীদের সম্ভাবনা প্রায় ৮০ শতাংশ বেশি। গবেষণাটি পরামর্শ দেয় যে, অভিবাসীরা তাদের নিজ দেশ এবং গ্রহণকারী দেশের মধ্যে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সংযোগ তৈরি করতেও সহায়তা করে। এছাড়া আরও কর-রাজস্ব তৈরি করতে সহায়তা করে অল্পবয়সী কর্মীরা।

তোমার নাগরিকেরা আমার নাগরিক হবে

কয়েকজন অর্থনীতিবিদ আশা করেন যে, অভিবাসনের তরঙ্গ আরও তাৎক্ষণিক সুবিধা পাবে। “উচ্চ অভিবাসন ফেডের জন্য সহায়ক। কারণ এটি শ্রম বাজারকে শীতল করার এবং মুদ্রাস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে”-এ্যাপোলো গ্লোবাল ম্যানেজমেন্টের সম্পদ ব্যবস্থাপক টরস্টেন স্লোক। এই ধরনের যুক্তি একটু বেশি আশাবাদী হতে পারে। বেশি লোক থাকার ফলে শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পায়, যা অন্য সব সমান মজুরি বৃদ্ধি হ্রাস করে। কিন্তু প্রভাব বেশ ছোট। সবচেয়ে বেশি অভিবাসী গ্রহণকারী দেশগুলোর শ্রমবাজার সবচেয়ে কম রয়েছে এমন লক্ষণ নেই। উদাহরণস্বরূপ কানাডায় বেতন এখনও বছরে প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। (চার্ট ২ দেখুন)

বিপরীতে অভিবাসীরা পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বাড়ায়, যা মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে। ব্রিটেনে নতুন আগতরা লন্ডনে ভাড়া বাড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যেখানে ইতিমধ্যে আবাসনের তীব্র সংকট ছিলো। অনুরূপ প্রভাব অস্ট্রেলিয়ায় লক্ষণীয়। গোল্ডম্যান স্যাকস এর প্রকাশিত অনুমান থেকে বোঝা যায় যে, অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান বার্ষিক মোট অভিবাসন হার পাঁচ লক্ষ লোকের ভাড়া প্রায় পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি করছে।

পরের বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অভিবাসন কিছুটা কমতে পারে। মহামারী পরবর্তী সংকটের হ্রাস কমবে; ধনী-বিশ্বের শ্রমবাজার ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে। তবুও বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, ঐতিহাসিকভাবে নবাগতদের উচ্চ মাত্রা কিছু সময়ের জন্য উত্থাপিত থাকবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আজকের অভিবাসন আগামীকালের অভিবাসনের জন্ম দেয়। কারণ এর মাধ্যমে নতুন শিশুর আগমন ঘটে এবং অংশীদার তৈরী হয়। ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে ধনী বিশ্বের অভিবাসী-বিরোধী পালা খুব শীঘ্রই একটি বিভ্রান্তির মতো মনে হবে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, ভাষান্তর করেছেন তুষার ফারুক

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা