বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান ধারা স্থিতিশীল রাখতে বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং তার দ্বারা উপার্জিত রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে বিগত চার দশক ধরে। যদিও প্রথম দিকে শ্রম অভিবাসন শুধু কর্মসংস্থান ও দারিদ্রতা নিরসনের উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে ও ব্যাপক অভিবাসনের কারণে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, অধিকতর সম্পদ ও সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং উন্নত জীবনযাপনের নিশ্চয়তার জন্যও শ্রম অভিবাসন হতে থাকে।
ক্ষেত্র বিশেষে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ আবার অভিবাসনের জন্য মরিয়া হয়ে অবৈধ বা অনিরাপদ মাধ্যম বেছে নেন ও মানবপাচারের ঝুঁকিতে পড়েন। যদিও আমাদের দেশ থেকে শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করতে সরকারের নানা ধরণের উদ্যোগ রয়েছে, রয়েছে নিয়মিত, দক্ষ, ও শোভন শ্রম অভিবাসনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা (যেমন বিএমইটি), আইন ও বিধি। কিন্তু শ্রম অভিবাসনকে নিরাপদ ও লাভজনক করতে কি করা উচিত ও কি ধরণের কৌশল প্রয়োগ করা উচিত, তা এখনো অনেকে বিশ্লেষণ করেন না বা প্রয়োগ করেন না। যার ফলে যে উদ্দেশ্যে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী শ্রম অভিবাসন করে থাকেন, তা ব্যর্থ হয় বা উদ্দেশ্য অর্জন সময় সাপেক্ষ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশন ও নীতি অনুসারে শ্রম অভিবাসনের কয়েকটি ধাপ রয়েছে, যেমন: অভিবাসন পূর্ব বা প্রাক-সিদ্ধান্ত ধাপ (Pre-decision stage), অভিবাসন প্রস্তুতি ধাপ (Preparation stage), বিদেশ গমন বা ভ্রমণ ধাপ (Pre-departure and travelling), প্রবাস জীবনযাপন ধাপ (Employment and Life at destination country), এবং প্রত্যাবর্তন ও পুনরেকত্রীকরণ ধাপ (Repatriation and Reintegration stage)।
অভিবাসনের উদ্দেশ্য ও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য অভিবাসনের প্রতিটি ধাপ বা স্তরের রয়েছে গুরুত্ব। তাই অভিবাসনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া বা অভিবাসনের প্রস্তুতি গ্রহণের সময় প্রত্যেক অভিবাসন প্রত্যাশীর উচিত বাস্তবসম্মত কৌশল প্রয়োগ করা ও তদানুযায়ী কার্যক্রম ঠিক করা।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, শ্রম অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রায় ৭০% স্বল্প শিক্ষিত, ফলে তারা অভিবাসনের সিদ্ধান্তের জন্য অপর-এর ওপরে কিংবা দালালের ওপর নির্ভর করে থাকেন। ফলে তারা তাদের শ্রম অভিবাসন সিদ্ধান্ত অনেকটা ঝুঁকির মাধ্যমে নিয়ে থাকেন।
এসব ক্ষেত্রে তাই প্রয়োজন অভিবাসন কাউন্সেলিং (Migration Counseling)- যার দ্বারা শ্রম অভিবাসন প্রত্যাশীরা অভিবাসন সংক্রান্ত সঠিক দিক নির্দেশনা পান বা নিজ পরিস্থিতি বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
অভিবাসী শ্রমিক উৎস অনেক দেশ যেমন: ফিলিপিনস, শ্রীলংকা বা ভারত -অনেক দেশেই অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য রয়েছে কাউন্সেলিং সেবা। বাংলাদেশেও কিছু বেসরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী এজেন্সির সহায়তায় ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হয়েছে এই সেবা। যদিও তা শুধু বিদেশ ভ্রমণের পূর্বে প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ব্যাপক পরিসরে, অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে বা জেলা পর্যায় হতে এই সেবা এখনো দেয়া হচ্ছে না (কুমিল্লা ও ঢাকা জেলা ছাড়া), যার ফলে অভিবাসনের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া বা অভিবাসন পরবর্তী কাউন্সেলিং সেবা অভিবাসীরা পাচ্ছে না।
অভিবাসীদের কাউন্সেলিং: শ্রম অভিবাসী কর্মীদের জন্য ‘কাউন্সেলিং’ হলো বিশেষ ধরণের সাইকোথেরাপি, যার মাধ্যমে ব্যক্তি বা এক বিশেষ শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বা দলকে (এখানে শ্রম অভিবাসন প্রত্যাশী, বিদেশগামী কর্মী, বিদেশে অবস্থানরত কর্মী, অভিবাসীর পরিবার ও বিদেশফেতর কর্মীদের বোঝানো হয়েছে) নিজ সমস্যা বিশ্লেষণ, বাধা উত্তরণ ও সমাধানে উৎসাহিত ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে, এবং বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
‘কাউন্সেলিং’ অনেক সময় মানুষকে তার ব্যবহার, ও আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে সহায়তা করে থাকে। এর ফলে কাউন্সেলিং গ্রহণকারী ব্যক্তি নিজ থেকে অনেক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন।
অভিবাসন প্রত্যাশী শ্রমিকদের মূলত অভিবাসনের জন্য শারীরিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিশ্লেষণের পাশাপাশি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ ও প্রাপ্তির বিষয়টি বিশ্লেষণের মাধ্যমে অভিবাসনের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সঠিক মাধ্যম ও এজেন্সি নির্বাচন, ডকুমেন্টস যাচাই, অর্থের যোগান ও রেমিট্যান্সের উপরে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির জন্য কাউন্সেলিং প্রয়োজন হয়।
আরো পড়ুন: অভিবাসীদের সামাজিক সুরক্ষায় নিরাপত্তা মডেল: সুযোগ ও সম্ভাবনা
অন্যদিকে, প্রবাসে অবস্থানরত কর্মীদের রেমিট্যান্সের সঠিক ও কার্যকর ব্যবহার, পরিবার ও সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্তের জন্য ‘কাউন্সেলিং’ সেবার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সঠিকভাবে পুনরেকত্রীকরণের ও সঠিকভাবে সঞ্চয় বিনিয়োগের জন্যও ‘কাউন্সেলিং’ এর প্রয়োজন পরে।
কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের উপায়: শ্রম অভিবাসন বা বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রত্যাশীদের, অভিবাসীর পরিবারকে ও প্রত্যাবর্তিত অভিবাসী কর্মীদের ‘কাউন্সেলিং’ মূলত সঠিক পরামর্শ প্রদান বা প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রাপ্তির উপায় বাতলে দেয়ার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে স্বাধীনভাবে চিন্তা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক বা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি ও অনুশীলনে উৎসাহিত করার জন্য তথ্যভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও কাউন্সেলিং এর পর্যায়ে পরে। অনেক অভিবাসন সংস্থা, সিবিও, বা প্রতিষ্ঠান কাউন্সেলিং এর মূল ইথিক্স (নীতি) থেকে বিচ্যূত হয়ে শুধু পরামর্শই প্রদান করে, বা সরাসরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দিচ্ছে-যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিবাসী শ্রমিকদের বা তাদের পরিবারের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারছে না।
কার্যকরভাবে অভিবাসন প্রত্যাশী, বিদেশগামী কর্মী, প্রবাসী কর্মী, প্রত্যাবর্তনকারী কর্মী ও তাদের পরিবারের কাউন্সেলিং সেবা বিভিন্ন উপায়ে প্রদান করা যায়; যার ভিতর উল্লেখযোগ্য দুটি হলো: ব্যক্তি পর্যায়ে কাউন্সেলিং, এবং দলভিত্তিক কাউন্সেলিং।
ব্যক্তি পর্যায়ে কাউন্সেলিং: এই প্রকার কাউন্সেলিং সাধারণত প্রশিক্ষিত ও বিশেষজ্ঞ কাউন্সিলর দ্বারা প্রদান করতে হয়- যা নির্ধারিত কাউন্সেলিং কক্ষে এককভাবে প্রদান করা যায়, কিংবা ডোর-টু-ডোর ভিজিটের মাধ্যমে ব্যক্তির বাসায় গিয়ে প্রদান করা যায়।
এক্ষেত্রে ব্যক্তির তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা ও কাউন্সিলরের সঙ্গে ব্যক্তির আস্থা স্থাপনের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। মনে রাখতে হবে, এই প্রকার কাউন্সেলিংয়ে ব্যক্তিকে তার মনোবল দৃঢ় করা ও আত্মনির্ভরশীল করে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরী করে দেয়া হয়।
ব্যক্তি বা একক কাউন্সেলিংয়ের ভিতর রয়েছে: ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং (দেশে কর্মসংস্থানে বা বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পর্কিত), বিদেশগামী কর্মীদের প্রস্তুতি বিষয়ক কাউন্সেলিং, কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও পারফরম্যান্স মেজারমেন্ট কাউন্সেলিং, ট্রমা কাউন্সেলিং (বা মনোঃসামাজিক কাউন্সেলিং), বিনিয়োগ কাউন্সেলিং (বা ব্যবসায়িক উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা), ও আর্থিক সাক্ষরতা বা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কাউন্সেলিং।
দলভিত্তিক কাউন্সেলিং: এই প্রকার কাউন্সেলিং সাধারণত একের অধিক (কোনোক্রমেই ২৫ জনের অধিক নয়) অভিবাসী কর্মী, বা তাদের পরিবারের সদস্যদের; কিংবা অভিবাসন প্রত্যাশী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের (যারা অভিবাসন বিষয়ক সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত) প্রদান করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একইভাবে একজন প্রশিক্ষিত বা অভিজ্ঞ কাউন্সিলরের সহায়তায় কাউন্সেলিং প্রদান করতে হয়, যেখানে কাউন্সিলর তাদের সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান ও সেবা প্রাপ্তির বিষয়গুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাউন্সেলিং প্রদান করে থাকে।
আরো পড়ুন: অভিবাসনে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও নিয়ন্ত্রণের কথকতা
দলভিত্তিক কাউন্সেলিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো অন্যের মতামত ও সিদ্ধান্তকে সম্মান করে পরিবার ও সমাজের মঙ্গলের জন্য সম্মিলিতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া বা বাধা অতিক্রমের চেষ্টা করা। সাধারণত দলভিত্তিক কাউন্সেলিংয়ের আওতায় রয়েছে: নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ক তথ্য সরবরাহ সংক্রান্ত কাউন্সেলিং, সরকারি ও বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রাপ্তির (আর্থিক, আইনি, প্রশিক্ষণ, ও সামাজিক সুরক্ষা) কাউন্সেলিং, আর্থিক সাক্ষরতা ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাউন্সেলিং ইত্যাদি।
যেহেতু আমাদের সমাজে এখনো অভিবাসীর পরিবার অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন, কিংবা তাদের দিকভ্রান্ত করে অলাভজনক খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্ষতির সম্মুখীন করেন অনেকেই। তাই শুধু অভিবাসীর পরিবার বা কর্মীকেই নয়, বরং তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক গোষ্ঠী বা দলকে ও কাউন্সেলিং সেবার আওতায় আনতে হবে।
এক্ষেত্রে আমরা পারি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় দল বা নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক দল, ব্যবসায়িক অ্যাসোসিয়েশন, আইনজীবী, সাংবাদিক ইউনিয়ন বা প্রেস ক্লাব সদস্য, সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন আর্থিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলভিত্তিক কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করতে বা অভিবাসীর অধিকার সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিতে।
সর্বাবস্থায় আমাদের মনে রাখতে হবে, অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবার প্রতি অভিগম্যতা বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং নিরাপদ ও দক্ষ অভিবাসন নিশ্চিতে কাউন্সেলিং সেবার গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য সরকারিভাবে জেলাভিত্তিক (জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিস বা ডেমো, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক হতে) কাউন্সেলিং সেবা প্রদানে উদ্যোগ নিতে হবে ও ট্রমা কাউন্সেলিংয়ে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী