বাংলাদেশ যেহেতু জাতিসংঘের ১৯৯০ এর অভিবাসন ও অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা সনদ ‘International Convention on the Protection of the Rights of All Migrant Workers and Members of Their Families’ এর একটি অনুস্বাক্ষরকারী বা অনুসমর্থনকারী দেশ, তাই উৎস/ শ্রমিক রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে অভিবাসী ও তার পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত সরকারের দায়িত্ব
শ্রম অভিবাসনের প্রক্রিয়া ও ধাপ:
সাধারণত উচ্চশিক্ষার্থে, ভ্রমণ, স্থায়ী বা পারিবারিকভাবে বসবাসের জন্য বিদেশে অভিবাসনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে শ্রম অভিবাসনের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেমন: বিএমইটি’র নিয়মানুসারে, শ্রম অভিবাসন হতে হয় চাহিদা ভিত্তিক। যেমন: সরকারের সঙ্গে যেসব দেশের কূটনৈতিকভাবে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক রয়েছে, তাদের দেশের চাহিদা অনুসারে, অনুমোদিত রিত্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে, ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স ও নির্দিষ্ট বিমানবন্দর দিয়ে শ্রম অভিবাসন করতে হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে বা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কাগজপত্র যেমন: মেডিকেল ফিটনেস সনদ, দক্ষতা প্রশিক্ষণ সনদ বা প্রাক-বহির্গমন ওরিয়েন্টেশন সনদ, ভিসা, জব কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি না থাকলে তা অবৈধ বা অনিয়মিত অভিবাসন হিসেবে গণ্য করা হয়।
আরো পড়ুন: শ্রম অভিবাসন কী এবং কেন: মৌলিক ধারণা (প্রথম পর্ব)
বিগত দুই দশকে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সরকার শ্রম অভিবাসনে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বেশ কিছু নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে অনেকাংশেই শ্রম অভিবাসনকে নিরাপদ ও নিয়মিত করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়া মূলত শুরু হয় একজন কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সুযোগ খোঁজার ভিতর দিয়ে, আর শেষ হয় অভিবাসনের উদ্দেশ্য অর্জনের পর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে।
যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকের অভিবাসন সফল হয় না, বা লক্ষ্য অধরাই থেকে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে এই শ্রম অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় ধাপ রয়েছে কয়েকটি। প্রথম ধাপে রয়েছে: সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্ভাব্যতা ও সক্ষমতা যাচাই, প্রস্তুতি (পাসপোর্ট তৈরী, প্রশিক্ষণ নেয়া, মেডিকেল ফিটনেস সনদ গ্রহণ), কর্ম জোগাড় (ভিসা ও জব কন্ট্রাক্ট), প্রাক-বহির্গমন ওরিয়েন্টেশন গ্রহণ এবং ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স পাওয়া ইত্যাদি।
দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে: নির্ধারিত বা অনুমোদিত স্থান দিয়ে (এয়ারপোর্ট) বিদেশ গমন, কর্মস্থলে যোগদান, গন্তব্য দেশের আইন ও নীতি অনুসারে প্রবাস জীবনযাপন (বৈধভাবে), চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করে সফলভাবে দেশে প্রত্যাবর্তন। আর তৃতীয় ধাপে রয়েছে: সফল প্রত্যাবর্তনের পর অর্জিত জ্ঞান, অর্থ ও সম্পদ নিয়ে নিজ দেশে মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া। মধ্যম ধাপে বা প্রবাস জীবনযাপনকালে অভিবাসীদের অবশ্য অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতে হয়, যেমন: নিজের ও পরিবারের অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য নিয়মিত রেমিটেন্স প্রেরণ, পরিবার ও সন্তানদের দেখভাল ও তাদের সুন্দর ভবিৎষতের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত প্রদান, এবং সর্বোপরি পারিবারিক মিলনের জন্য ছুটিতে দেশ ভ্রমণ।
আরো পড়ুন: অভিবাসনে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও নিয়ন্ত্রণের কথকতা
নিরাপদ অভিবাসনের পূর্বশর্তসমূহ:
আমাদের দেশে একসময়ে ‘আদম ব্যবসা’ নামে ব্যাপক পরিচিত ক্ষেত্রটিতে অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোর বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও শর্তারোপের জন্য সরকার প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শ্রম অভিবাসনে বেশ কিছু নীতিগত ও সেবা প্রদানে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, যার বেশিরভাগই করা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।
বাংলাদেশ যেহেতু জাতিসংঘের ১৯৯০ এর অভিবাসন ও অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা সনদ ‘International Convention on the Protection of the Rights of All Migrant Workers and Members of Their Families’ এর একটি অনুস্বাক্ষরকারী বা অনুসমর্থনকারী দেশ, তাই উৎস/ শ্রমিক রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে অভিবাসী ও তার পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত সরকারের দায়িত্ব।
এছাড়াও রাষ্ট্র যেহেতু অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স দ্বারা সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়, তাই তাদের কল্যাণের জন্যও কাজ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয় দায়বদ্ধ। শ্রম অভিবাসনকে সুশৃঙ্খল, নিয়মিত ও চাহিদাভিত্তিককরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিগত এক দশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু নীতিগত উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩, প্রবাসী কল্যাণ নীতি ২০১৬, রিত্রুটিং এজেন্সি বিধিমালা ২০২০, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন ২০১৮, মানব পাচার দমন আইন ২০১২ ইত্যাদি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্লোবাল কম্প্যাক্ট অন মাইগ্রেশন, কলম্বো প্রসেস ইত্যাদি প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ।
আরো পড়ুন: অভিবাসীদের সামাজিক সুরক্ষায় নিরাপত্তা মডেল: সুযোগ ও সম্ভাবনা
এছাড়া শ্রম অভিবাসনকে নিরাপদ ও লাভজনক করতে বাংলাদেশ সরকার যেসব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দক্ষ শ্রমিক গড়তে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও সুলভে প্রশিক্ষণ প্রদান, অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য জীবন ও দুর্ঘটনা বীমা সেবা, বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রেরণকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা প্রদান, কার্যকর পুনঃএকত্রীকরণ জন্য সহজ শর্তে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক হতে ঋণ প্রদান, কল্যাণার্থে ক্ষতিপূরণ ও অনুদান প্রদান, সেবা সহজীকরণের জন্য ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার স্থাপন ও বিমান বন্দরে কল্যাণ ডেস্ক স্থাপন, অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য অনলাইন, জেলা পর্যায়ে, ও বিএমইটির কার্যালয়ে বিশেষ টিম গঠন ও শুনানীর ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক খাতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সি.আই.পি. সম্মাননা প্রদান ইত্যাদি।
সুতরাং সরকারের এসব উদ্যোগ ও নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অভিবাসী কর্মীদের বিদেশ গমনের পূর্বে, বিদেশে অবস্থানের সময় ও প্রত্যাবর্তনের সময় যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, তাহলো: ১. সরকার অনুমোদিত রিত্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, ২. জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসের ডাটাবেসে নাম অন্তর্ভুক্তিকরণ, ৩. দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃত সনদ গ্রহণ, ৪. ভাষা শিক্ষা ও প্রাক বহির্গমন প্রশিক্ষণ গ্রহণ, ৫. মেডিকেল ক্লিয়ারেন্স ও ফিটনেস সনদ গ্রহণ, ৬. ভিসা ও চাকুরীর চুক্তিনামা বুঝে নেয়া, ৭. বীমা করা ও বৈধ উপায়ে রেমিটেন্স প্রেরণের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ৮. অনুমোদিত সীমান্ত বা বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশ যাওয়া, ৯. বিদেশে ওয়ার্ক পারমিট বা কাজের অনুমোদন নেয়া, ১০. গন্তব্য বা অবস্থানকালীন দেশের আইন, সংস্কৃতির চর্চা অনুসারে জীবন যাপন, এবং ১১. চুক্তির মেয়াদ উত্তরণের পর অবৈধভাবে না থেকে সঠিন নিয়মে দেশে প্রত্যাবর্তন।
যদিও আমাদের দেশে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা রিত্রুটিং এজেন্সির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও বৈধ অভিবাসন সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। কিন্তু অভিবাসনে ইচ্ছুক বা বিদেশগামী কর্মীদের অসচেতনতা বা মানসিকতার জন্য অনেক অবৈধ, অনিরাপদ অভিবাসন ও মানব পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে।
আরো পড়ুন: গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নে রেমিট্যান্সের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের সুযোগ
বাংলাদেশে সামাজিকভাবে শ্রম অভিবাসন বা বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে পরিবারের ও ব্যক্তির অর্থনৈতিক সুরক্ষার উপায় হিসেবে দেখা হয়। তাই এর গ্রহণযোগ্যতা গ্রামাঞ্চলে ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে সব চেয়ে বেশি। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে নিরাপদ অভিবাসন সংক্রান্ত সেবা বা তথ্য সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে এখনো অনেক অনিরাপদ শ্রম অভিবাসন হয়ে থাকে ও অভিবাসী শ্রমিকরা নানা ধরণের শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হন।
তাই আমাদের প্রয়োজন তৃণমূল পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকে অধিক সচেতন করা ও শ্রম অভিবাসনের বিভিন্ন ধাপ ও শর্তগুলো পূরণে বিনামূল্যে সেবা প্রদান করা। আর এজন্য সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সমন্বয়ের সঙ্গে ভারসম্যপূর্ণভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক: উপদেষ্টা, বমসা, শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী