অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাওয়ার পূর্বে আমাদের অবশ্যই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। কারণ একজন অভিবাসী শ্রমিক কয়েক বছরের চুক্তিতে বিদেশে অভিবাসন করে থাকেন। ফলে তাকে তার পরিবার-স্বজন, নিজস্ব ও পরিচিত সংস্কৃতি, দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ধর্মীয় অনুশীলন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশিরভাগ অভিবাসী কর্মী এসবের প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না।
বিদেশ-বিভুঁইয়ে ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস, অধিক পরিশ্রম, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, মানসিক চাপ ইত্যাদি কারণে অনেক অভিবাসী শ্রমিকই স্বল্প সময়ের মধ্যে নানান ধরণের অসুখ-বিসুখে ভুগতে শুরু করেন। ফলে নিশ্চিতভাবে ব্যাহত হয় অভিবাসনের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা।
কেন প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা?
আমাদের দেশ থেকে সাধারণত স্বল্প দক্ষ (প্রায় ৬০%) শ্রমিকই বিদেশে যায়, যাদের বেশিভাগের বয়সসীমা ২৫ হতে ৪৫ বছর। দেশে বেকার, কৃষি কাজ, বা অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই সাধারণত বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে দ্রুত অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় হিসেবে ভেবে থাকেন ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করে দালালদের প্রলোভনে পড়ে বিদেশে চলে যান।
বিদেশ ভ্রমণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই গন্তব্য দেশের নিয়োগকর্তার ও কর্তৃপক্ষের নিয়মানুসারে কাজ করতে গিয়ে শারীরিকভাবে ব্যাপক চাপে থাকেন তারা। অনেকে আবার বিদেশে আসার জন্য ভিসা ক্রয় ও বিনিয়োগের টাকা দ্রুত উত্তোলনের জন্য অতিরিক্ত কাজ বা ওভার টাইম করে থাকেন- যা তার শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আরো পড়ুন: অভিবাসনে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও নিয়ন্ত্রণের কথকতা
এছাড়া, বিদেশে-বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য, খাদ্যাভাস, দেশে ফেলে আসা স্বজনদের জন্য দুশ্চিন্তাও তাদের শরীর এবং মনে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করে। ফলে, অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
অবস্থা চরমে পৌঁছলে, বা অবহেলা করলে অনেক অভিবাসী কর্মীই বিভিন্ন ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, এমনকি মারা যান। তাই অভিবাসনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একজন অভিবাসী কর্মীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অপরিহার্য। কারণ, একজন অভিবাসী কর্মী শুধু নিজের জন্য নয়, বরং তার পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষার জন্যও লড়াইয়ে করে থাকেন।
শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা অবহেলার প্রভাব কি?
প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের সূত্র মতে, চলতি বছর বছর গড়ে প্রতিদিন ১০ জন অভিবাসী কর্মীর মৃতদেহ দেশে এসেছে এবং আট মাসে চার হাজারের অধিক মৃতদেহ সংস্থাটি গ্রহণ করে স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করেছে।
প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের ২০০২-২০২১ এর পরিসংখ্যান বলছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৪১ হাজারের অধিক অভিবাসীর মৃতদেহ দেশে নিয়ে আসা হয়েছে যাদের গড় বয়স ছিল ৩০-৩৫ বছর এবং বেশিরভাগ এসেছিলো সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে।
অভিবাসীদের বিদেশে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ওই দেশের ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিলো, অস্বাভাবিক মৃত্যু (৬৮.২৩%), সড়ক দুর্ঘটনা (১০.৫%), স্ট্রোক (২.৬%) ও হৃদরোগে (১.১৭%)- যা অনেক অভিবাসী শ্রমিকদের স্বজনদের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এছাড়া পারিবারিক বিবাদ, স্বামী / স্ত্রীর পরকীয়া, ঋণ ও কিস্তি পরিশোধের জন্য চাপে থাকাসহ নানা প্রভাবে পড়ে আত্মহত্যাও অন্যতম কারণ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অবৈধ ও নির্দিষ্ট সময়ে ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ বৃদ্ধি না করতে পারার দরুন অনেক অভিবাসী কর্মী অসুস্থ হলেও নিয়োগকর্তা বা কর্তৃপক্ষের কাছ হতে কোনো ধরণের চিকিৎসা সহায়তা পাননি ও বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়াতে অনেকে বিনা চিকিৎসায়ও মারা গিয়েছিলেন।
যদিও কোনো গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত নয়, কিন্তু কিছু বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কেস পর্যালোচনায় জানা গিয়েছে, অনেক অভিবাসী কর্মীই তাদের হৃদরোগ, জন্ডিস, যক্ষ্মা বা ডায়বেটিসের মতো অসুখ গোপন করে কিছু দালাল ও অসৎ মেডিকেল সেন্টারের সহায়তায় ভুয়া মেডিকেল সনদ নিয়ে বিদেশে যান এবং সেখানে গিয়ে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, যার দায়ভার কেউ নিতে চায় না।
আরো পড়ুন: অভিবাসীদের সামাজিক সুরক্ষায় নিরাপত্তা মডেল: সুযোগ ও সম্ভাবনা
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস ‘বিলস (BILS)’-এর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বিদেশ ফেরত নারী শ্রমিকদের প্রায় ৫৫% শারীরিকভাবে ও প্রায় ২৯% মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন দেশে ফেরত আসার পর।
অন্যদিকে, ২০২১ সালের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ব্র্যাকের (BRAC)’ একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরের প্রথম তিন মাসে ৯৩৩ জনের অধিক নারী অভিবাসী কর্মী বিভিন্ন ধরণের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা নিয়ে দেশে ফেরত এসেছিলেন।
সুস্থ ও যোগ্য শ্রম অভিবাসনে করণীয় কি?
শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতিমালা অনুসারে একজন অভিবাসী কর্মীকে অবশ্যই শারীরিকভাবে সুস্থ ও ফিট হতে হয়। এটা প্রমাণের জন্য প্রয়োজন হয় মেডিকেল সনদের।
বিএমইটির নিয়মানুসারে, দক্ষতা প্রশিক্ষণ সনদ ও অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টার হতে ফিটনেস সনদ জমা দিলেই বিদেশ গমনের জন্য ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স কার্ড বা স্মার্ট কার্ড দেয়া হয়। যদিও সরকারি নির্দেশনা ও গন্তব্য দেশের চাহিদা অনুসারে অভিবাসীদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা যেমন: এইচআইভি (HIV/AIDS) টেস্ট, যক্ষ্মা (TB), ডোপ (DOPE) টেস্ট, স্বাভাবিক দৃষ্টি, কিংবা নারীদের জন্য প্রেগন্যান্সি (Pregnancy) টেস্ট করতে হয় ও তার সনদ বিএমটিতে জমা দিতে হয়, কিন্তু কর্মীর মানসিক বা প্রতিবন্ধীতা পরীক্ষা করার কোনো সুযোগ বা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
সরকার যদিও অভিবাসী ও বিদেশগামী কর্মীদের প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে টিটিসি (TTC) বা ডেমো (DEMO) থেকে, কিন্তু ওই তিন দিনের প্রশিক্ষণে আসলে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়ে খুব একটা জোর আলোচনা হয় না। নারী গৃহকর্মীর একমাস ব্যাপী প্রশিক্ষণেও নেই শারীরিক শিক্ষার কোনো চর্চা বা অধিবেশন। শারীরিক যোগ্যতা ও সুস্থতা পরিমাপের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড, ফলে অসাধু দালালদের জন্য সুযোগ হয় জালিয়াতির- যার ফল ভোগ করতে হয় অভিবাসী কর্মীর।
বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও অভিবাসী সংগঠনের প্রতিবেদন ও কার্যক্রম পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. অভিবাসনের প্রাক-সিদ্ধান্ত প্রশিক্ষণ (Pre-Employment Training) ও প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণে (Pre-Departure Training/ Orientation) গুরুত্ব সহকারে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রয়োজনীয়তা ও প্রস্তুতির দিকনির্দেশনা সংক্রান্ত অধিবেশন অন্তর্ভুক্তকরণ।
২. শারীরিক সক্ষমতা ও ফিটনেসের জন্য আন্তর্জাতিক বা গন্তব্য দেশের সঙ্গে যৌথভাবে মানদণ্ড (Standard) নির্ধারণ।
৩. মেডিকেল সেন্টারের জালিয়াতি ও প্রতারণা প্রতিরোধে নিয়মিত কার্যক্রম তদারকি করা ও টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা।
৪. মানসিক কাউন্সেলিং, টেস্ট – এর জন্য সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর সঙ্গে কাজ করা।
৫. বিদেশে অবস্থিত ও বিদেশ ফেরত অসুস্থ কর্মীদের স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সহায়তা দেবার জন্য কল্যাণ বোর্ডের ও দূতাবাসগুলোর সক্ষমতা ও বাজেট (অর্থ বরাদ্দ) বৃদ্ধি করা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুসারে সরকার ২০২০ -২১ অর্থ বছরে মাত্র ২০৭ জন বিদেশফেরত অভিবাসী কর্মীর স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়েছিলো, যা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, অভিবাসী কর্মীরা কল্যাণ বোর্ডের এই সব সেবা বা সহায়তা সম্পর্কে অবগত নন। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা।
কর্মী যদি শারীরিক ও মানসিভাবে সুস্থ না থাকে-শুধু আত্মীয় বা স্বজন বিদেশে আছেন তার ভরসায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ভিসা ক্রয় করে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া বিদেশে পাঠিয়ে ওই কর্মীর জীবনের ঝুঁকি নেয়া হতে বিরত থাকতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ ও অংশীদারিত্বমূলক কার্যক্রম।
লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী