শ্রম অভিবাসনের পূর্বে লাভ-ক্ষতির হিসাব যেকারণে জরুরি

0
915

অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য কম হওয়ায় বিশ্ব বাজারে আমাদের শ্রমিকদের চাহিদা স্বাভাবিকভাবে বেশি। দারিদ্রতা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা, পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ন ইত্যাদির পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সিসমূহের অধিকতর মুনাফাপ্রাপ্তির প্রলোভনের কারণে শ্রম অভিবাসন আজ জীবিকা নির্বাহনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আধুনিক উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন ও উন্নত দেশে স্থায়ী হওয়ার প্রলোভনে তো আজকাল অনেকে অবৈধ জেনেও ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে, অনেক সময় যার মূল্য পরিশোধ করতে হয়  জীবন দিয়ে। সমস্যা আসলে সেখানে নয়, সমস্যা হলো অসাধু দালাল শ্রেণী বা মানবপাচারকারীরা তো তাদের কৌশল অনুসরণ করবেই।

তারা যেভাবে যুবক, বেকার কিংবা উচ্চাভিলাষীদের স্বপ্ন দেখাবে -ঠিক সেভাবে সাধারণ মানুষও তা দেখবে ও অনুসরণ করবে। মূলত সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা হচ্ছে আমাদের সচেতনতার, সমস্যা হচ্ছে আমরা কোনো কিছু বিচার বিশ্লেষণ না করেই কতিপয় সাফল্য ও ক্ষনিকের মোহের জন্য সব জেনেবুঝেও ঝুঁকি নিই।

শ্রম অভিবাসনের পূর্বে একজন শ্রমিকের সাধারণত যে ধরণের পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তার অনুশীলন একেবারে নেই বললেই চলে। আমাদের দেশের শ্রমিকরা সাধারণত ভিসা প্রাপ্তির সম্ভাবনা ও সুযোগের উপরে নির্ভর করে অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

কেবল ভিসা প্রাপ্তি নিশ্চিত হলেই তারা বিদেশ গমনের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি যেমন: প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ গ্রহণ, মেডিকেল, বিমানের টিকেট ও যাত্রা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। তারা যে সরকারি অনুমোদিত দেশভিত্তিক অভিবাসন ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি খরচ করে বিদেশ যাচ্ছেন – তা নিজেরাই জানেন না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো তিনি কতদিনের জন্য ও মাসিক কত মজুরিতে যাচ্ছেন, যা তার অভিবাসন ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা -সেসবের বিশ্লেষণও তারা করেন না। আবার দেখা গেছে, অনেকে জব কন্ট্রাক্ট বা নিয়োগের চুক্তিপত্র পড়ে দেখেন না, বা চাকরির চুক্তিপত্রটি হাতে পান যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করার পর। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, অধিকাংশ শ্রমিক কোনো ধরণের দক্ষতা ছাড়াই বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। এক্ষেত্রে অধিকাংশের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, তারা বিদেশে গিয়ে কাজ করতে করতে শিখে নিবেন বা দক্ষ হবেন। যা আসলেই অবাস্তব ও চ্যালেঞ্জিং।

১৯৭৬ হতে ২০১৯ সালের বিএমইটির বিশ্লেষণ অনুসারে ৪৬.৫২% কর্মী ছিলেন স্বল্পদক্ষ, ১৫.৫৪% ছিলেন আধা-দক্ষ ও ৩৪.৫৪% ছিলেন দক্ষ শ্রমিক। যদিও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে দক্ষতা পরিমাপের অনুশীলন আমাদের দেশে খুব বেশিদিন হয়নি, সবে শুরু হয়েছে।

তাই বলা যেতে পারে, আমরা মূলত: কম দক্ষ শ্রমিকই বেশি প্রেরণ করেছি বা করছি। দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যদিও দেশে ৭১টি কারিগরি ও মেরিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে শুধু প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ ছাড়া, অভিবাসন ইচ্ছুক শ্রমিকরা খুব কমই এসকল কেন্দ্র হতে নির্দিষ্ট ট্রেডে প্রশিক্ষণ ও সনদ নিয়ে থাকেন।

এছাড়া সরকারি বা বেসরকারিভাবে অভিবাসনের লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণসহ প্রাক-সিদ্ধান্ত প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা অপ্রতুল। ফলে এসকল শ্রমিক দালাল, এজেন্সি কিংবা বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয়দের কথার উপরে ভরসা করেই অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

শ্রম অভিবাসনের সাফল্য নির্ভর করে মূলত: এর লাভ ক্ষতির বিশ্লেষণের উপরে। এর জন্য ৩ টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ:

  • সর্বমোট অভিবাসন ব্যয় (পাসপোর্ট তৈরী থেকে শুরু করে, প্রশিক্ষণ, মেডিকেল, বিমান টিকেট, ভিসা ক্রয় ও ওয়ার্ক পারমিট তৈরি বাবদ ব্যয় ইত্যাদি)
  • চুক্তিপত্র অনুসারে মাসিক মজুরি/ বেতন।
  • চুক্তিপত্র অনুসারে ভিসা বা কাজের মেয়াদকাল।

বিপরীতে আমরা স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে যেভাবে লাভ ক্ষতির বিশ্লেষণ করে থাকি তা হলো:-

অভিবাসনে লাভ/ ক্ষতি: উদ্বৃত অর্থ = কাজের মেয়াদ ( মাস) * মাসিক মজুরি ( টাকা) = মোট আয় (টাকায়) – সর্বমোট অভিবাসন ব্যয় বা বিনিয়োগ (টাকায়)।

কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা অন্য সব ঝুঁকি বা ব্যয় গণনায় নিয়ে আসি না, যেমন: পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধ (সুদসহ), পারিবারিক বা সাংসারিক ব্যয়, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, অভিবাসী কর্মীর বিদেশে জীবনযাপনের ব্যয়, সঞ্চয় ইত্যাদি।

এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি তো রয়েছেই, যা আমরা লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণের সময় বিবেচনায় নিই না।

অনেক অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, অভিবাসনের লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণের সময় সামাজিক ব্যয়কেও বিবেচনায় রাখা উচিত। একজন শ্রমিক দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবার থেকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকেন এবং অভিবাসনের কারণে তার পরিবারের উপরে কি ধরণের সামাজিক চাপ (যেমন: সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, নারী সদস্যদের প্রতি সহিংসতার আশঙ্কা, সন্তানদের শিক্ষার উপরে নেতিবাচক প্রভাব, সম্পত্তি বেদখল হওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদি) আসতে পারে তা অবশ্যই তার জন্য বিবেচ্য বিষয়।

কিন্তু, দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে আমরা তৃণমূল পর্যায়ে যারা মূলত সম্ভাব্য অভিবাসী কর্মী বা যারা এখন অভিবাসনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাদেরকে এই লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ করাতে পারছি না কিংবা তা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছি।

অভিবাসনের লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ যে শুধু একজন অভিবাসীকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে তা কিন্তু নয়। এ বিশ্লেষণের ফলে নিরাপদ অভিবাসনও নিশ্চিত হবে, কমে যাবে মানবপাচার বা অবৈধ উপায়ে অভিবাসনের প্রচেষ্টা।

যদিও কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সাম্প্রতিক সময়ে মাঠ পর্যায়ে কিংবা মোবাইল এপ্লিকেশনের মাধ্যমে অভিবাসী বা পরিবারকে প্রাক-সিদ্ধান্ত প্রশিক্ষণ বা লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বা শেখাচ্ছেন, কিন্তু ব্যক্তি বা পারিবারিক পর্যায়ে অভিবাসনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরকে এ বিষয়ে বিশেষ কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে না। অপরদিকে, সরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত এ ধরণের কোনো প্রশিক্ষণ, প্রচার-প্রচারণা লক্ষণীয় নয়, যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন: ডেমো, টিটিসি কিংবা ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র হতে এই সেবা অনায়াসে প্রদান করা সম্ভব।

অভিবাসনের লাভ-ক্ষতির বিষয়টি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিকও বটে, যেখানে অভিবাসনের সাফল্য নির্ভর করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের উপরে। অভিবাসীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয়ভাবে রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তারা যেন অসাধু ব্যবসায়ীদের ও পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত না নেন, তার জন্য সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে ও অভিবাসনের পূর্বে লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণসহ প্রাক-সিদ্ধান্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।  

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here