ভিয়েতনামের ৫৩টি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ভিয়েতনামের নাগরিকদের মধ্যে যারা দুর্গম, পাহাড়ি অঞ্চল অথবা কম সুবিধাসমৃদ্ধ এলাকায় বসবাস করে থাকেন, তারা দেশটির মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৭৩ শতাংশ। কয়েক দশক ধরে, অনেকেই জীবিকার তাগিদে কাজের সন্ধানে ও অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তির আশায় বাড়িঘর ছেড়ে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে থিঁতু হয়েছেন। সাধারণত এখানে এসে তারা নিজেদের চেষ্টায়, পরিচিত সম্পর্ক ও যোগাযোগের মাধ্যমে নির্মাণ, পর্যটন, পরিবহনসহ অন্যান্য সেক্টরে কাজের জন্য যুক্ত হন।
২০২০ সালের শেষের দিকে, ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টার এর একদল অনুসন্ধানকারী রাজধানী হ্যানয়ে কর্মরত জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মজীবী মানুষদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারি যখন নিত্য নতুন ভেরিয়েন্ট নিয়ে হাজির হচ্ছিলো ও শত শত মানুষকে সংক্রমিত করছিল, তখন এসব শ্রমজীবী মানুষেরা কীভাবে উদ্বিগ্ন ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং কোভিড-১৯ কীভাবে তাদের অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর করে দেয়, সেসবের স্বরূপ-সন্ধান করাই ছিল ওই সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুসন্ধানের প্রধান উদ্দেশ্য।
জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মধ্য থেকে ছয়টি সম্প্রদায় যথাক্রমে তাই, নাং, হ’মঙ, মুং, খাং ও থাই অধিবাসীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল। বেশিরভাগ নারী সাক্ষাৎকারদাতার বয়স ছিল ১৮ থেকে ৫৩ বছরের মধ্যে। তারা প্রত্যেকেই তিন মাস থেকে শুরু করে ছয় বছর আগে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। প্রত্যেক সাক্ষাৎকারদাতা নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী অথবা কুলি ও ছোটো কফিশপের দোকানের ওয়েটার হিসেবে হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ভিয়েতনামে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ আঘাত হানে। এরপর দ্রুত প্রথমবারের মতো দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এরপর ১ এপ্রিল থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। জরুরী স্বাস্থ্যসেবা ও খাবারের দোকান ছাড়া যাবতীয় দোকানপাট ও কলকারখানা বন্ধ ছিল। উচ্চ ঝুঁকির রাজ্যগুলো ছাড়া দেশজুড়ে বিদ্যমান কঠোর লকডাউন তুলে নেয়া হয়। উচ্চ ঝুঁকিতে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই হ্যানয়ে লকডাউন জারি রেখে চলমান বিধিনিষেধের সময়সীমা আরো বাড়ানো হয়।
এর কয়েক মাস পর অর্থাৎ অক্টোবর ও নভেম্বরের দিকে সাক্ষাৎকারদাতাদের সঙ্গে কথা বলেন অনুসন্ধানকারীরা। মূলত যারা এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা জানার চেষ্টা করে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন অনুসন্ধানকারীরা।
জানা যায়, লকডাউন শুরুর প্রথম মাসেই অধিকাংশ সেক্টরের কর্মজীবীদের প্রথম মাসের বেতন বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু তাদের কোনো সঞ্চয় ছিল না অথবা নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতেন না সেহেতু তাদের প্রায় প্রত্যেকেই চরম আর্থিক সংকটে পড়ে যান। এমনকি দুবেলা দুমুঠো ভাতেরও সংস্থান করতে ব্যর্থ হন তারা। এর মধ্যে যাদের খাবার প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ সরবরাহ করতেন তারাই সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছিলেন।
অনুসন্ধানে এও দেখা গেছে, বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার পরও অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হতে পারেননি শ্রমজীবীদের কেউ। এমনকি সাক্ষাৎকাওর অংশগ্রহণকারী একজন নারী শ্রমজীবী জানিয়েছেন, মহামারি শুরুর আগে থেকে জমানো টাকার ৫০ শতাংশ খরচ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
শুধু অর্থনৈতিক সংকটই যে ভিয়েতনামের হ্যানয়ে বসবাসরত অভিবাসীদের জীবন সংকটাপন্ন করে দিয়েছিল তা নয়, একইসঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের মধ্যকার সম্পর্কও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। অর্থ রোজগার করতে না পারার কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুলের ফি, ঘরভাড়া ও প্রতিদিনকার খরচের জন্য সবার কাছ হাত পাততে হয়েছে তাদের। যদিও অনেকের ধার করারও সামর্থ্য ছিল না।
চরম অর্থনৈতিক সংকটের কারণে একপর্যায়ে শ্রমিকরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করেন। বেশিরভাগ সাক্ষাৎকারদাতা শ্রমজীবী নিজেদের হতাশা ও কষ্টের কথা স্বীকার করেছেন। সন্তানের খাবার, নতুন ভাইরাসের আবির্ভাবের শঙ্কা ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
একজন নারী নির্মাণ শ্রমিক বলছিলেন এভাবে, ‘যদি কোভিড (লকডাউন চলাকালে) আরো তিন থেকে চার মাস চলে, তাহলে আমি জানি না আমার জীবনের কী হবে।’ তার মতো আরো অসংখ্য নারী ঠিক এভাবেই তীব্র মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিনগুলো অতিবাহিত করছে।
হ্যানয়ে সর্বশেষ ঘোষিত লকডাউন তৃতীয় সপ্তাহে বৃদ্ধি করার পর অনুসন্ধানকারীরা সাক্ষাৎকারদাতাদের মধ্য থেকে তিনজনের সঙ্গে দেখা করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। এই শ্রমজীবীদের কেউই এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। সবমিলিয়ে তারা এখন তাদের ভবিষ্যত নিয়ে খুবই উদ্বিগ্নতার সঙ্গে দিন পার করছে।
ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকারগুলো লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবীদের জন্য কিছু সহায়তার ব্যবস্থা করেছিল। তবে প্রাদেশিক অঞ্চলগুলো দুর্গম এলাকায় জিনিসপত্র বহনের অপ্রতুলতা, নিবন্ধনের অসুবিধাসহ নানা কারণে এই সহায়তা প্রকৃত ভুক্তভোগীদের কাছে খুব কমই পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে।