হাইকারদের স্বপ্নভূমি হচ্ছে নরওয়ে। এদেশে হাইকিং করে যাবার মতো হাজারো জায়গা রয়েছে। এরই মধ্যে বিখ্যাত একটি হচ্ছে ট্রোলটুংগা। আমি শিক্ষাসুত্রে নরওয়েতে ছিলাম তিন বছর। ঘোরাঘুরির শখ থাকায় আর এই ট্রোলটুংগার সুন্দর সব ছবি দেখে এবছরই, অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন মাসে ঘুরে এসেছিলাম প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টির অনবদ্য জগৎ থেকে। সঙ্গী হয়েছিলো সেখানকারই তিনজন বন্ধু।
ট্রোলটুংগা, ট্রোল হচ্ছে নরওয়েজিয়ান উপকথার দত্যি দানো, আর টুংগা মানে জিভ। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১৮০ মিটার উঁচুতে ঝুলে থাকা এই পাথরটি দেখতে আদপেই বিশাল কোন দৈত্যের ভেংচি কাটা জিভের মতো। তবে এই জিহ্বা বাবাজির কাছে যাওয়াটাও সহজ কাজ নয়।
যাওয়ার আগেই গুগল থেকে জেনে নিয়েছিলাম যে, যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় ২৮ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা পেরোতে হবে এই হাইকে। তাতে সবমিলিয়ে সময় লাগবে প্রায় ১০/১২ ঘন্টা। নিজের স্ট্যামিনার উপর কোন কালেই ভরসা ছিলো না আমার। তারপরেও কোন সাহসে এমন কাজ করলাম কিংবা আমার ভ্রমণ সঙ্গীরাও কি বুঝে নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলো সে বড় ভাবনার বিষয়। আমিসহ দুইজন মেয়ে ও দুই জন ছেলের ছোট্ট দলটি অসলো থেকে বারগেন শহর হয়ে ওড্ডা নামের ছোট্ট একটি শহরের উদ্দ্যেশে রওনা দিয়েছিলাম জুনের ৭ তারিখ।
ওড্ডা পর্ব
যেহেতু অনেক লম্বা সময়ের হাঁটা পথ তাই যাত্রা শুরু করতে হয় সকাল সকাল। সেইজন্যেই সাধারণত ট্রেইলের আশেপাশে কোথাও রাত্রিযাপন করে থাকে হাইকাররা। আমাদের চারজনের ছোট্ট দলটাও আগের দিন দুপুরের মধ্যেই নিকটবর্তী ওড্ডা নামের শহরে চলে গেলাম। দুপুরের খাবার সেরেই শহরের কাছের লাতেফসেন নামের একটি বিখ্যাত জলপ্রপাত দেখতে রওনা দিলাম আমরা। সুবিশাল এই ঝর্ণার মাঝখান দিয়েই চলে গেছে পাঁকা রাস্তা। বামে ঝর্ণাধারা, ডানে বয়ে যাচ্ছে টলটলে নীল জলের পাহাড়ি নদী আর এর মাঝের হাইওয়ে দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি, ট্রাক, লরি।
অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্য। ঝর্ণা দেখে সবার পথের ক্লান্তি নিমিষেই দূর। আমরা সবাই হাল্কা পাতলা পানিতে ভিজে (কনকনে ঠান্ডা জল, এর বেশি ভেজার উপায় নেই), ছবি তুলে ভিডিও করে অস্থির। এভাবে ঘন্টা দেড়েক যাবার পর ফিরতি বাসের সন্ধান করতে গিয়েই টনক নড়লো। নরওয়েতে সাধারণত ছোট শহরগুলোতে বাস অনেক সময় পর পর আসে। এইখানেও সেই একই অবস্থা।
যাওয়ার সময় ঠিকঠাকমতো বাস পাওয়া গেলেও আসার সময়ের বাসের দেখা মিলবে প্রায় ৪/৫ ঘন্টা পর। অর্থাৎ শহরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। উপরোন্তু, যাওয়ার সময় বাস ড্রাইভার দয়ালু হওয়ায় স্টপেজ ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো আমাদের। মূলত ঝর্ণা থেকে স্টপেজ পর্যন্ত পুরোটাই গাড়ি চলার রাস্তা, এই রাস্তার পাঁশ দিয়ে মানুষ চলাচলের কোন আলাদা ব্যাবস্থা নেই। ফলে এখন স্টপেজ পর্যন্ত পৌছুঁতেও অনেকদূর রাস্তা আমাদের ঝুঁকি নিয়ে যেতে হবে।
রাস্তা দিয়ে বিশালাকার সব লরি ছুটে যাচ্ছে আর তার পাশ দিয়ে এক সারিতে আমরা চারজন প্রাণ হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি। এই ভাবে কোনমতে বাসস্টপ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। কিন্তু ফিরতি বাস আসতে তখনো অনেক দেরি। শুয়ে, বসে, উনো খেলে বহু কষ্টে সময় কাটিয়ে শেষমেষ যখন ওড্ডা ফেরত গেলাম তখন রাত নয়টা। ভেবেছিলাম সময় হাতে থাকলে শহরটা ঘুরে দেখবো। সফরসঙ্গীদের কেউ একজন বলেছিল ওড্ডা ক্যাম্পিং জায়গাটা খুব সুন্দর। সেখানে যাওয়ারও ইচ্ছা ছিলো। সেসব আর হলো না। এয়ারবিনএবিতে ব্যাগ রেখেই কাছের একটা দোকান থেকে কিছু বাজার করে এনে খেয়ে দেয়ে কিছুটা সকাল সকালই নিদ্রা গেলাম আমরা। কারণ পরদিন অনেক ভোরে উঠতে হবে।
চলবে…
লেখক: নরওয়ের নোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী