ইতালি ও লিবিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কমিটিতে দুই নারীর মামলা

0
478
ইতালি ও লিবিয়ার বিরুদ্ধে
ইতালি ও লিবিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কমিটিতে মামলা

ইতালি ও লিবিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের একটি কমিটিতে মামলা করলো দুই নাইজেরিয়ান অভিবাসী নারী। ইতালির একটি আইনি অধিকার বিষয়ক সংগঠনের সহযোগিতায় এই দুই নারী অভিযোগ তুলেছেন যে, নারী হিসেবে তাদের নূন্যতম মানবাধিকার সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে ইতালি ও লিবিয়া।

তাদের সরাসরি অভিযোগ, দেশ দুটি তাদেরকে মানব পাচার, শোষণ ও নিপীড়নের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

প্রিন্সেস ও ডোরিস (ছদ্মনাম) যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে নাইজেরিয়া থেকে লিবিয়া আসেন। তাদের অভিযোগ, একটি অপরাধী চক্র পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে তাদেরকে নাইজেরিয়া থেকে লিবিয়ায় পাচার করেছিল। লিবিয়ায় আসার পথে চক্রটি তাদেরকে পতিতাবৃত্তি ও দাসত্বে বাধ্য করেছিল। এমনকি লিবিয়া সীমান্তে পৌাঁছানোর প্রাক্কালে তাদেরকে একাধিক অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রিও করা হয়েছিল।

গত ১৬ ডিসেম্বর এএসজিআই (দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর জুরিডিক্যাল স্টাডিজ অন ইমিগ্রেশন) কর্তৃক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডোরিস ও প্রিন্সেসের আইনজীবীরা তাদের সেই ভয়ংকর যাত্রা এবং তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বাজে আচরণের জন্য লিবিয়া ও ইতালির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। মামলাটি জাতিসংঘের সিইডিএডব্লিউ কমিটির (নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ কমিটি) সামনে আনা হচ্ছে।

ডোরিস এএসজিআই এর কাছে জানিয়েছেন, তার এক বন্ধুর মাধ্যমে নারী পাচারকারী চক্রের আরেক নারীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠে। তিনি স্বীকার করেছেন, এসময় পাচার সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। এমনকি পতিতাবৃত্তি বিষয়েও তার কোনো ধারণা ছিল না।

২০১৮ সালে মেয়েদের একটি দল ও একজন পুরুষ মানবপাচারকারীর সঙ্গে তিনি নাইজেরিয়া থেকে রওয়ানা দেন। এরপর লিবিয়ার সাবাহ ও আগাদেজে অঞ্চলে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়। সাবাহতে তিনি যে পুরুষের কাছে বিক্রি হয়েছিলেন, সে একটি অতালিকাভুক্ত ডিটেনশন সেন্টার পরিচালনা করতো।

সেই ব্যক্তির নিপীড়নের হাত থেকে তিনি তখনই নিস্তার পান, যখন কিনা ছদ্ববেশী অন্য আরেক নারী পাচারকারী তাকে ‘রক্ষা’ করতে কিনে নেন। কিন্তু ততক্ষণে ডরিসকে আবারো সাবাহার একটি পতিতালয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে যৌন কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

অবশেষে ডোরিস পালিয়ে যান। এরপর তিনি পুলিশের হাতে আটক হন এবং বানি ওয়ালিদে তাকে আটক করে রাখা হয়।

‘অমানবিক ও অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন’

বানি ওয়ালিদ থেকে ডোরিসকে কয়েক মাসের মধ্যে পঞ্চমবারের মতো কিনেছিলেন এক ব্যক্তি, যে তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যায় এবং বিনা বেতনে দাসী হিসাবে কাজ করতে বাধ্য করে।

এএসজিআইএর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এখান থেকে ডোরিস আবার পালিয়ে ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা তাকে বাধা দেয়। এরপর তাকে অন্য একটি কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ‘অমানবিক এবং অবমাননাকর’ অবস্থায় আটকে রাখা হয়।

প্রিন্সেস এর গল্পও প্রায় একই রকম। লিবিয়ার সীমান্ত পার হওয়ার ঠিক পরপরই প্রিন্সেস বলেছেন যে, তার দলকে ‘একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী থামিয়েছিল, তাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছিল ও তাদের সবকিছু ছিনতাই করেছিল।’ এই দলটি তাকে আগাদেজে নিয়ে যায়। এরপর তাকে এবং তার সঙ্গে থাকা মেয়েদেরকে একজন পাচারকারীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়; যারা তাদের সাবাহ নিয়ে যায়।

সাবাহেতে প্রিন্সেসকে এক নাইজেরিয়ান পাচারকারীর কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। যিনি তার পরিবারের কাছ থেকেও অর্থ আদায় করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একবার লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে তাকে অন্য একজন ব্যক্তি দ্বারা অপহরণ করা হয়েছিল। যিনি তাকে কোনও অর্থ না দিয়ে কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন।

একপর্যায়ে পরিবারের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের সাহায্যে প্রিন্সেস ইতালির দিকে একটি নৌকা নিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু তার নৌকাটিও লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা আটক করে এবং তাকে লিবিয়ার জানজোরের একটি আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘সেখানে তাকে তিন মাস আটকে রাখা হয়েছিল। পরে আরেকজন ব্যক্তি তাকে কিনে নেয় এবং একটি বাড়িতে আটকে রেখে তার মুক্তির মূল্য পরিশোধের জন্য তাকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে।’

‘যৌন নির্যাতন’

তিন মাস ধরে একটি বাড়িতে প্রিন্সেসকে ‘যৌন নির্যাতন’ করা হয়েছিল। সেখানে আরও প্রায় দুই শত নারী দাস হিসেবে অবস্থান করতো বলে উল্লেখ করা হয় এএসজিআইএর প্রেস নোটে।

লিবিয়ার পুলিশ সেই বাড়িতে অভিযান চালানোর পর প্রিন্সেসকে গ্রেপ্তার করে অন্য একটি আটক কেন্দ্রে নিয়ে যায়। এই কেন্দ্রে তাকে মারধর করা হয়েছিল, কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং নির্যাতন করা হয়েছিল।

মূলত এএসজিআই-এর আইনজীবীরা ব্যাখ্যা করেছেন যে, এই দুই নারী লিবিয়ার দাসত্বের একটি ব্যবস্থার শিকার হয়েছিলেন। যা কিনা ইতালি এবং ইইউ থেকে অর্থ দ্বারা সমর্থিত।

ইতালি এবং লিবিয়া বছরের পর বছর ধরে একাধিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে। এর মধ্যে ইতালি লিবিয়ার উপকূলরক্ষী এবং লিবিয়ান কর্তৃপক্ষকে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। মূলত অভিবাসীদের ইউরোপীয় উপকূলে পৌঁছানো থেকে বিরত রাখার কৌশল হিসেবেই এ ব্যবস্থাগুলো নেয়া হয়।

২০১৭ এবং ২০২০ সালের মধ্যে আইওএম প্রত্যাবাসন কর্মসূচির জন্য ইতালি লিবিয়াকে ১১ মিলিয়ন ইউরো তহবিল প্রদান করেছে। ইইউ লিবিয়ান কর্তৃপক্ষকে কয়েক বিলিয়ন অর্থ প্রদান করে এবং লিবিয়ার উপকূলরক্ষীকে একই কাজ করার জন্য তহবিল ও প্রশিক্ষণ দিয়ে এই চুক্তিতে যুক্ত করেছে।

ভূমধ্যসাগরে আটকানো

ডোরিস এবং প্রিন্সেস আসলে কখনো ইতালিতে পৌঁছাতে পারেননি। কারণ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে তাদের সমুদ্রে আটকানো হয়েছিল এবং লিবিয়ার উপকূলরক্ষী দ্বারা লিবিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। লিবিয়ার বিভিন্ন কারাগারে বেশ কয়েক মাস থাকার পর তাদেরকে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর ‘স্বেচ্ছায় মানবিক প্রত্যাবাসন’ কর্মসূচির মাধ্যমে নাইজেরিয়ায় প্রত্যাবাসন করা হয়।

যাহোক, এই নারীদের পক্ষে আইনজীবীরা যুক্তি দেন যে, প্রত্যাবাসন আসলেই স্বেচ্ছায় ছিল না, যেহেতু এ দুই নারীকে অন্য কোনও বিকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি এবং তারা এমন খারাপ পরিস্থিতিতে ছিল যে, এটিই তাদের দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তারা এই কর্মসূচিকে ‘ছদ্মবেশী’ বহিষ্কারের একটি রূপ বলে দাবি করেছেন।

নাইজেরিয়ায় ফেরার সময়, আইনজীবীরা বলেন, এই দুই নারী আরও একবার পাচার, শোষণ এবং দাসত্বের ঝুঁকিতে ছিলেন। এএসজিআই-এর মতে, ‘নারীরা সীমান্ত পেরিয়ে নাইজারে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে, তাদের বারবার বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা বিক্রি ও কেনা হয়েছে। তাদেরকে অপব্যবহার ও নির্যাতন করা হয়েছে।

তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের অর্থ আদায় করার জন্য আটকের অনানুষ্ঠানিক জায়গায় তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। যখন তাদের পরিবার টাকা দিতে ব্যর্থ হতো, তখন তাদের এমন ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, যারা তাদের দাসত্বে বাধ্য করেছিল এবং তাদের ‘মুক্তির’ খরচ বহন করতে তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেছিল।’

শোষণ ব্যবস্থা

এএসজিআই এবং জাতিসংঘসহ অনেক মানবাধিকার সংস্থার মতে লিবিয়ায় শোষণ শুধু যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত হয় তা নয় বরং এটি লিবিয়ার কর্তৃপক্ষ দ্বারাও সমর্থিত। এএসজিআই এর দাবি, দেশটির কর্তৃপক্ষ ইতালি এবং ইইউ থেকে বিলিয়ন ইউরো অর্থ সহায়তা পাচ্ছে এবং সেকারণে ইতালি এবং ইইউ এই পদ্ধতিগত শোষণের সঙ্গেও জড়িত। এএসজিআই লিবিয়ার এ ব্যবস্থাটিকে ‘ব্যবসায়িক মডেল’ বলে অভিহিত করে।

ডোরিস জানান, তিনি যখন নাইজেরিয়ায় ফিরে আসেন, তখন তিনি আইওএম এর দেওয়া পুনরেকত্রীকরণ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন। তাকে ‘একটি মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং সেশন’ দেওয়া হয়েছিল। তবে ডোরিস বলেছিলেন যে, তিনি যে সহিংসতা, অপব্যবহার এবং দুর্ব্যবহার সহ্য করেছেন’ সেই সংকট উত্তরণের জন্য তাকে কোনও সহায়তা দেওয়া হয়নি৷

ইউনিভার্সিটি লিগ্যাল এইড ইনস্টিটিউশন-এর নাইজেরিয়ান নেটওয়ার্কের ওডিনাকাওনি লাগির মতে, এইসব নারীদের অনেককে সহজেই নাইজেরিয়া থেকে ফেরত পাঠানোর পর পুনরায় পাচার করা হতে পারে। এর কারণ দেশের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি এবং নাইজেরিয়ার অপরাধী নেটওয়ার্কের শক্তিশালী উপস্থিতি, যা নাইজেরিয়া থেকে ইতালি, স্পেন এবং তার বাইরেও বিস্তৃত।

মানবাধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশনের অধীনে, মানব পাচারের শিকার হতে পারে এমন নারীদের চিহ্নিত করার এবং তাদের আবার এমন হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য একটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এএসজিআই বলছে যে, ডোরিস এবং প্রিন্সেসকে কর্তৃপক্ষের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়নি। এএসজিআই এর দাবি, ইতালি এবং লিবিয়া নারী অধিকারের কনভেনশনের ধারা ২ ও ৬ লঙ্ঘন করেছে। সিইডিএডব্লিউ এখনও এই আপিল সম্পর্কিত কোনো প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি।

সংবাদ সম্মেলনের শেষে এএসজিআই আইনজীবী এবং বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, এই মামলায় জয়ী হলে জাতিসংঘ এই ধরনের অন্যান্য মামলাগুলিতেও এরকম ফলাফল প্রয়োগ করতে শুরু করবে। তাদের প্রত্যাশা, জাতিসংঘের অনুসন্ধানে যদি প্রমাণিত হয় যে, ইতালি এবং লিবিয়া সত্যিই এই নারীসহ তাদের মতো অন্যদের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে তাহলে তারা উপলব্ধ নীতি এবং কর্মসূচিগুলি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে৷

সুনির্দিষ্ট ভাষায়, এর অর্থ হতে পারে যে, যখন কাউকে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন কর্মসূচিতে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তারা পাচারের শিকার হয়েছে কিনা। যদি তারা পাচারের শিকার হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি তাদেরকে সম্ভাব্য ইউরোপীয় কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার অধিকার প্রদান করতে পারে।

সূত্র: ইনফো মাইগ্রেন্টস (ইংরেজি থেকে অনূদিত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here