চীনে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা শ্রমজীবীরা

0
552
চীনের শ্রমজীবীরা
চীনের শ্রমজীবীরা

২০১১ সাল। আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগে পাহাড়ের কোলঘেঁষে গ্রামীণ জনপদে বেড়ে ওঠা তান চুনমিয়াও নিজের বসতবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন চীনের গুয়ানঝুর পার্ল রিভার মেগাসিটিতে, একটি কারখানায় কাজের উদ্দেশ্যে।

দশ বছর যাবৎ জনাব তান চুনমিয়াও এখানে রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যদিও এখনো তার অর্থনৈতিক অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি; যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। বর্তমানে তিনি জাপানি একটি রেস্তোরাঁয় শেফ হিসেবে কাজ করছেন। স্ত্রী ও সন্তানের মুখে দু’বেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেয়ার প্রাণপণ প্রচেষ্টায় দিনের একটা বড় সময় তাকে শ্রম দিতে হয়।

তান চুনমিয়াও চীনের ২৮০ মিলিয়নেরও বেশি গ্রামীণ অভিবাসী মানুষদের একজন; যিনি চীনের বৃহৎ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, শহরের বাসিন্দাদের দেওয়া সরকার প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা, অধিকার এবং সামাজিক পরিষেবাগুলির মতো তিনি তেমন কোনো কিছুই ভোগ করতে পারেন না। নাগরিক হিসেবে তার ন্যায্য পাওনা থেকে তিনি বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি তিনি তার সন্তানদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার প্রাপ্তি থেকেও অনেক পিছিয়ে আছেন।

‘এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, চীনে ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত উন্নয়নের সমস্যা এখনও প্রকট, যেখানে শহর ও গ্রামীণ আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং আয় বণ্টনের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান রয়েছে’-

শি জিনপিং

‘আমাকে অবশ্যই শুধু আমার নিজের ওপর নির্ভর করতে হয়। মনে হয়, গুয়ানঝুতে আমার কোনো ‘গ্রিন কার্ড’ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়মিত অভিবাসীদের মতো নিজেকে নিজের জন্মভূমিতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের সঙ্গে তুলনা করে বিমর্ষ মুখে হাসি জুড়ে দিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তান চুনমিয়াও।

ছবি: সংগৃহীত

চীনের ১৯৫০ সালের পারিবারিক নিবন্ধন বা হুকু আইন অনুযায়ী, দেশটির নাগরিকদের জন্মের সময় গ্রামীণ বা শহুরে হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। মূলত পিতামাতার নিবন্ধিত স্থানের ভিত্তিতে নাগরিকদের এ শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুং যৌথ কৃষির জন্য কৃষকদের ভূমির সঙ্গে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৮০ এর দশকে গ্রামীণ কমিউনগুলি ভেঙে ফেলার পর গ্রাম থেকে অভিবাসীরা শহরে চলে আসতে থাকে এবং একটি বিশাল নিম্নশ্রেণীতে পরিণত হয় তারা। এর ফলে ব্যবসায়ীদের দ্বারা তাদের শোষণের ভিতও মজবুত হওয়ার সোপান রচিত হয়।

চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের ‘সাধারণ সমৃদ্ধি’ প্রচারাভিযান মধ্যবিত্তকে প্রসারিত করতে এবং আয় বৈষম্য কমাতে চায়। যা তুলনামুলক কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনেও প্রবল।

কিছু গবেষণায় সামনে এসেছে যে, অভিবাসী জীবনের নিরাপত্তাহীনতা স্বীয় ভোগ ও অর্থনৈতিক দক্ষতাকে হ্রাস করে। শুধু তাই নয় পরিবারগুলিকে আরও সন্তান ধারণ থেকে নিরুৎসাহিত করে।

‘এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, চীনে ভারসাম্যহীন ও অপর্যাপ্ত উন্নয়নের সমস্যা এখনও প্রকট, যেখানে শহর ও গ্রামীণ আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং আয় বণ্টনের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান রয়েছে’- প্রেসিডেন্ট শি গত আগস্টে চীনের কেন্দ্রীয় আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ক এক ভাষণে বলেছিলেন।

ছোট শহরগুলিতে বসবাসের বিধিনিষেধ শিথিল করার অতীতের প্রচেষ্টাগুলিকে ব্যাপকভাবে প্রান্তিক লাভ হিসাবে দেখা হয়। যেহেতু অল্প কিছু সুবিধা অভিবাসীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রতিক্রিয়া হিসাবে, বেইজিং ২০২৫ সালের মধ্যে বেশিরভাগ শহরে হুকু বিধিনিষেধ তুলে দেয়ার জন্য নতুন টপ-ডাউন ব্যবস্থা জোরদার করছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কৌশলটি হল, ৩ মিলিয়নেরও কম লোকের শহরে হুকু বিধিনিষেধ বাতিল করা।

ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনের গ্রামীণ অর্থনৈতিক বিভাগের পরিচালক উ জিয়াও ডিসেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা গ্রামীণ অভিবাসী জনগোষ্ঠীর নগরায়ণকে ত্বরান্বিত করব।’

যত গর্জে তত বর্ষে না’

বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলেন যে, এই ধরনের পরিকল্পনাগুলি জনাব তান চুনমিয়াওর মতো অভিবাসীদের চীনের সবচেয়ে গতিশীল শহরগুলিতে পূর্ণ নাগরিক করে তুলবে কি না।

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক এবং চীনের হুকু পদ্ধতির বিশেষজ্ঞ কাম উইং চ্যান বলেছেন, ‘প্রচুর আওয়াজ তোলা হচ্ছে কিন্তু সত্যিই কি খুব বেশি ফল পাওয়া যাচ্ছে?’

তিনি ২০১৪ সাল থেকে অনেক ছোট এবং মাঝারি আকারের শহরগুলিতে হুকু বিধিনিষেধ শিথিল করার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সেখানে গ্রামীণ অভিবাসীদের আকৃষ্ট করার জন্য চাকুরি এবং সামাজিক পরিষেবাগুলির বহুলাংশে অভাব রয়েছে৷ ‘এটা শুধু নামে আছে, আদতে এর মাধ্যমে কোন লাভ হচ্ছে না। আমি এটাকে জাল হুকু বলে মনে করি।’

সর্বশেষ প্রস্তাবগুলির মতোই পূর্ববর্তী প্রোগ্রামটি সাংহাই এবং বেইজিংয়ের মতো বড় শহরগুলিকে বাদ দিয়েছিল। চীনের ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, যে শহরে হুকু নেই এমন শহরে বাসিন্দাদের অনুপাত ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১২ সালে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়েছে।

‘অধিকাংশ কৃষি কর্মী এখনও একটি ‘অদৃশ্য দেয়ালের’ সম্মুখীন, অর্থাৎ তারা পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা এবং জনসেবা পান না’- গত জুলাই মাসে এক বক্তৃতায় চাইনিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট কাই ফাং এমনটাই বলেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, এত বৃহৎ গোষ্ঠীর ভোটাধিকার বঞ্চিত হওয়া চীনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বীজও তৈরি করে, যেখানে একটি জরিপে, হুকু প্রথাকে শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় বাসিন্দাদের কাছে অজনপ্রিয় বলে দেখানো হয়েছে।

হার্ভার্ডের ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের সাম্প্রতিক সেমিনারে চীনের বিশেষজ্ঞ এবং সমাজবিজ্ঞানের প্রফেসর ইমেরিটাস মার্টিন হোয়াইট বলেন, ‘আপনি নিশ্চয় এমন একটি একটি আধুনিক সমাজ চালাতে চান না, যেখানে মানুষকে জন্মের সময় একটি নিম্ন মর্যাদার অবস্থানে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় এবং তাদেরকে সেই সুযোগগুলি থেকে বঞ্চিত করা হয় যা আপনি বাকি জনসংখ্যার জন্য বরাদ্দ রাখছেন।’

শিক্ষাক্ষেত্রে বঞ্চনা

চীনে গ্রামীণ অভিবাসীদের অনেক শিশুকে তাদের বাবা-মায়ের থেকে আলাদা থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ শহুরে পাবলিক স্কুল সেই শিশুদের ভর্তি করতে চায় না এবং অনেক অভিবাসী পরিবার বেসরকারি স্কুলে ফি বহন করতে পারে না।

গুয়াংজুতে একজন তরুণী মিসেস লু (ছদ্মনাম) স্মরণ করেছিলেন যে, প্রাথমিক ছাত্রী হিসাবে তাকে সাত বা আটবার প্রাইভেট স্কুল বদল করতে হয়েছিল। কারণ তার বাবা-মা অভিবাসী কৃষক ছিলেন, যারা শহরতলীর বিভিন্ন জায়গায় অন্যের জমিতে সবজি চাষ করতেন।

চীনের অভিবাসী শিশুদের একটি স্কুলে পড়াচ্ছেন শিক্ষক। ছবি: সংগৃহীত

মিসেস লু বলছিলেন,‘লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর৷’ তার বাবা-মা অভিবাসী শিশুদের জন্য চালু হওয়া প্রাইভেট মিডল স্কুলের খরচ বহন করতে পারতেন না, তাই তাকে পড়াশোনার জন্য তার দাদার কাছে গ্রামের বাড়িতে ফেরত পাঠায়। পরে মিসেস লু  গুয়াংজুতে একটি সয়া সস কারখানায় কাজ পান।

জনাব তানও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন, তিনি চিন্তিত কীভাবে তার দুই সন্তানকে শিক্ষিত করবেন, যারা অন্য শহরে তার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন।

জমিটুকুই সম্বল

অনেক চীনা গ্রামীণ অভিবাসীদের জন্য, শহরের বিদ্যমান হুকু প্রকল্পের আওতায় থাকা সুবিধাগুলি পাওয়ার জন্য চড়াই-উৎরাই মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একারণে তারা নিরাপত্তার জন্য নিজভূমিতে ফিরে যাওয়ার চিন্তা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

জনাব ফুও (ছদ্মনাম) ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গুয়াংজু এর স্যাটেলাইট শহর ফোশানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেছেন। এর আগে, তিনি নিজের শহরে তাদের ১ দশমিক ৬ একর খামারে তার মাকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি এখন তার কর্মস্থান থেকে ৩০০ মিটার দূরে একটি ভাড়া ঘরে একা থাকেন, যেখানে এখন সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করতে হয় তাকে।

 তিনি বলেন, ‘শহরে বসবাস করা সহজ নয়, তাই যদি পরিস্থিতি খুব ভালো না থাকে এবং আয় বেশি না হয়, তাহলে আমি বরং বাড়িতে গিয়ে মায়ের যত্ন নেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারি।

পরিবারের জমি ছেড়ে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই তান চুনমিয়াওর। তান আরো ১৫ বছর কাজ করার পরিকল্পনা করেছেন, যতক্ষণ না তার বাচ্চারা বড় হয় ও স্বাবলম্বী হয়। তার ইচ্ছা সবকিছু গুছিয়ে উঠে তিনি তার গ্রামে ফিরে অবসর গ্রহণ করবেন এবং সেখানে ধীরে ধীরে আরও ভাল সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করবেন।

তান স্বপ্ন দেখেন, ‘আমি যদি বাড়িতে ফিরে যেতে পারি এবং একটি ভিন্ন জীবন পাই, তাহলে সম্ভবত একজন পর্যটক হতে পারি।’ যদিও নিজের স্বপ্ন নিজেই থামিয়ে দেন ক্ষণিকের ব্যবধানে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকেন-‘কিন্তু এখন, আমি তা পারব না।’

সূত্র:দ্য নিউ ইয়র্কার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here