মাত্র ১ হাজার দিরহাম বেতনে চাকুরি জীবন শুরু করা এই বাংলাদেশি যুবকের প্রতিষ্ঠানে এখন বিলাসবহুলসব গাড়ি মেরামত করা হয়
২০০৫ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ নামের একজন স্বপ্নবাজ বাংলাদেশি যুবক। শুরুতে হেল্পার হিসেবে একটি গাড়ি মেরামত কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। যেখানে তার মাসিক বেতন ছিল ১ হাজার দিরহাম বা বাংলাদেশি টাকায় ২৩ হাজার টাকার মতো।
দিন- রাত কঠোর পরিশ্রম করে অল্প বেতন পেলেও দমে যাননি আহসান উল্লাহ। ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতার ঝুলিকে পূর্ণ করতে থাকেন তিনি। এভাবে একদিন তিনি কারখানাটিতে মেকানিক হিসেবে পদোন্নতি পান।
জনাব আহসান উল্লাহর বাকি ইতিহাসটা এখন সবারই জানা। মেধা, প্রজ্ঞা, কঠোর পরিশ্রম আর মিতব্যয়িতার ভারসম্যপূর্ণ সমন্বয়ে তিনি নিজেই একদিন প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন বিলাসবহুলসব গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান। শারজাতে তার নিজের মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানে এখন সাতজন মেকানিক ও কর্মীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
আহসান উল্লাহর বাড়ি চট্টগ্রামে। বর্তমানে এ উদ্যোক্তার বয়স ৩৪ বছর। অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সে বিদেশে চাকরি জীবন শুরু করে ঠিক দ্বিগুণ বয়সে প্রবেশ করেছেন তিনি। যে স্বপ্ন নিয়ে আহসান উল্লাহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে পা রেখেছিলেন সেই স্বপ্ন তার হাতের মুঠোয় এসেছে। তবে রাতারাতিই এই সফলতার দেখা তিনি পাননি।
‘কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য্য, মিতব্যয়িতা, সততা ও ভালো সেবা দেয়ার মাধ্যমে ক্রেতার ও কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মতো বিষয়গুলো আমার সফলতায় ভূমিকা রেখেছে’-গালফ নিউজকে বলেন আহসান উল্লাহ।
সফলতার পথে যাত্রা
মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিগরী স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষ করার পরপরই আহসান উল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যাবার। আর এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে তার ভাই, যিনি ২০০৫ সাল থেকেই শারজায় বসবাস করছেন।
‘আমার ভাই মোজাম্মেল মেকানিক ছিলেন। তিনি যে গ্যারেজে কাজ করেন, সেখানে হেল্পার হিসেবে তিনিই আমাকে নিয়োগ পাইয়ে দিয়েছিলেন।’ স্মৃতিচারণ করে বলেন আহসান উল্লাহ। তিনি আরো যোগ করেন ‘আমি জেষ্ঠ্য মেকানিকদের কাজে সহায়তা, মেরামত, ইঞ্জিন টিউন-আপ, তেল ও টায়ার পরিবর্তন ও ব্রেক চেক, স্পার্ক প্লাগ স্থানান্তর ও ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমের মতো কাজগুলো করতাম। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাটারি, স্টাটার্স ও লাইট পরিবর্তন। এছাড়াও আমার ওপর অর্পিত দায়িত্বের মধ্যে ছিল দোকান পরিস্কার করা ও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি গুছিয়ে জায়গামতো রাখা।’
শুরুতে আহসান উল্লাহর বেতন ছিল ১ হাজার দিরহাম। তার ভাষ্যমতে, এই পরিমাণ অর্থ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিল। এছাড়া গ্যারেজেই বিনামুল্যে তার থাকার ব্যবস্থা ছিল। দেশে আহসান উল্লাহ তার পরিবারের কাছে প্রতি মাসে ৬০০ দিরহাম পাঠাতেন এবং বাকি টাকা তিনি নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করতেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই টাকার মধ্য থেকেও তিনি মাসে ২০০ দিরহাম সঞ্চয় করতেন।
তিন বছর পর তিনি তার কাজে আরো বেশি দক্ষ হয়ে ওঠেন। তার পদোন্নতি ঘটে এবং অর্থ রোজগারও বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবে। এর মধ্যে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে যান। এটি দিয়ে তিনি ডেলিভারি ও পারিবারিক কাজে খণ্ডকালীন ভিত্তিতে গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়ে যান। এই খণ্ডকালীন কাজের মাধ্যমেই তার মাসিক রোজগার ৪ হাজার দিরহামে উন্নীত হয়।
খেয়াল রাখার বিষয় হলো, তার রোজগার বেড়ে গেলেও নিজের জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন তিনি আনেননি অর্থাৎ খরচের নিয়ন্ত্রণ করেছেন খুব সতর্কতার সঙ্গে। তার ভাষ্যমতে, গ্যারেজে বিনামূল্যে পাওয়া কক্ষটি খুবই উপভোগ করতেন এবং তিনি তার অর্থনৈতিক বিষয়গুলো খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মাসে ৫০০ দিরহামের মতো খাবার ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কারণে খরচ করতেন। ১ হাজার দিরহাম নিয়মিত বাবা-মার কাছে পাঠাতেন এবং মাসে নিয়ম করে ২ হাজার দিরহাম সঞ্চয় করতেন।
২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই রুটিনই মেনে চলেছেন। এবং এরপরের পাঁচ বছর অত্যন্ত সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে অর্থ ব্যয় করেছেন। এভাবে করতে করতে একদিন তার সঞ্চয়ের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ দিরহামে।
ঝোপ বুঝে কোপ মারার উপযুক্ত সময়
পারিপার্শ্বিক ইতিবাচক পরিস্থিতি, মেধা, দক্ষতা ও সঞ্চিত অর্থ যখন তার এক হয়ে গিয়েছিল ঠিক তখনই আহসান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ২০১৪ সালে তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে ফেলেন, তাও আবার শারজা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার মতো জায়গায়। তিনি তার প্রতিষ্ঠানে ল্যান্ড রোভার, রেঞ্জ রোভার জিপ ও মার্সিডিস-এএমজির মতো বিলাসবহুলসব গাড়ি মেরামত শুরু করেন।
শুরুতে তার অল্প কয়েক ক্রেতার কাজ দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ভারত, যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানের মতো দেশের ক্রেতাদের কাজ করে সন্তুষ্টি ও বিশ্বাস অর্জন করেন এবং ব্যবসায়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।
একা পথে যাত্রা
২০১৯ সালে আহসান উল্লাহ একাই একটি রিপেয়ার শপ খোলার সিদ্ধান্ত নেন এবং অ্যাডভেঞ্চারার অটো মেইনটেনেন্স ওয়ার্কশপ নামে রিপেয়ার শপ চালু করেন শারজা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া ১২ তে। তিনি এখানে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা শুরু করেন এবং মেকানিক হিসেবে নিজেকে আরো বেশি দক্ষ করে গড়ে তোলেন। তিনি ইউকে-অ্যাফিলিয়েটেড টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট এর প্রতিষ্ঠান থেকেও দক্ষতা বিষয়খ সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন।
যাত্রাপথে থমকে যাওয়া
কোভিড ১৯ মহামারির কবলে পড়ে অন্যান্য অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো আহসান উল্লাহর ব্যবসাও থমকে গিয়েছিল এবং তার ব্যবসা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ আমার প্রতিষ্ঠানের ওপরও পড়ে এবং ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা গত বছরের শুরুর দিকে ধীরে ধীরে ধাক্কা সামলে উঠি এবং ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে গতি বাড়িয়েছি। এখন আবার ব্যবসা সচল হচ্ছে।’
সফলতা আবারো ধরা দিয়েছে
‘আমরা মহামারি থেকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। কারণ আমরা আমাদের বিশ্বাস ও সামনে উল্লিখিত মন্ত্রগুলোর প্রতি সততা বজায় রেখেছি-প্রতারণা করবেন না, গ্রাহকের প্রতি অনুগত থাকুন ও সবসময় উত্তম পরিষেবা প্রদান করুন’-বলেন আহসান উল্লাহ।
আহসান উল্লাহ বিবাহিত এবং যথাক্রমে ছয় ও দুই বছর বয়সী দুই ছেলে সন্তানের জনক। তার বর্তমান মাসিক রোজগার চল্লিশ হাজার দিরহামের ওপর।
একইসঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাতজন কর্মীর সুরক্ষার পেছনে অবদান রাখছেন তিনি। তবে এত স্বচ্ছলতার পরও আহসান উল্লাহ এখনো মিতব্যয়ী জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তিনি ২০০৮ মডেলের একটি রেঞ্জ রোভার ব্যবহার করেন; যা মাত্র ১৫ হাজার দিরহাম দিয়ে ২০১৯ সালে ক্রয় করেছিলেন।
গাড়িটি কেনার পর তিনি এটি মেরামতের জন্য আরো প্রায় ১০ হাজার দিরহাম খরচ করেছিলেন। পুরোনো এই গাড়িতে চড়েই আহসান উল্লাহ স্বপ্ন দেখেন আরো ভালো কিছু করার এবং নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার।
সূত্র:গালফ নিউজ