১৯৭৫ সালে সাইগেনের পতনের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ঠিকই, কিন্তু এর মাধ্যমে ইতিহাসের বৃহত্তম এবং দীর্ঘতম উদ্বাস্তু সংঙ্কটের সূচনা ঘটে
১৯৭৫ সালের ২৯ এপ্রিল, কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনামী সৈন্যরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগেনের কাছে পরাজিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কর্মী এবং কয়েক হাজার দক্ষিণ ভিয়েতনামী সামরিক ও কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের অবিলম্বে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়। তখন প্রতিটা টিভি চ্যানেল বিশৃঙ্খল এয়ারলিফটের বীভৎস ছবি সম্প্রচার করে। যেখানে দেখা গেছে, দক্ষিণ ভিয়েতনামী নাগরিকরা মরিয়া হয়ে সাইগেনের আমেরিকান দূতাবাসের গেটে ভিড় করেছে। যাতে করে শীঘ্রই বিজয়ী কমিউনিস্টরা সিটির নতুন নাম হো চি মিন সিটি করতে পারে।
১৯৭৫ সালে সাইগেনের দ্রুত পতন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যর্থ সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এটি ইতিহাসের বৃহত্তম এবং দীর্ঘতম শরণার্থী সংঙ্কটগুলির মধ্যে অন্যতম একটি সূচনা হয়ে ওঠে।
পরবর্তী দুই দশকে, ১৯৭৫-১৯৯৫ তিন মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া থেকে পালিয়ে যায়। সেসময় হাজার হাজার মানুষ সাগরে ডুবে মারা যায়। অগণিত মানুষ জলদস্যুর কবলে পড়ে। আবার অনেকেই অস্থায়ী নৌকায় ভিড়ের মধ্য দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। যাদের কপাল ভালো ছিলো, তারা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কিংবা ফিলিপাইনের শরণার্থী শিবিরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি উদ্বাস্তু অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং এক মিলিয়রেও বেশি উদ্বাস্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসিত হয়েছিলো।
আরো পড়ুন:
যেখানে শরণার্থীদের জন্য খাবারের চেয়ে মাদক সস্তা
সাইগেনের পতনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড এবং কংগ্রেস দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়া থেকে আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার শরণার্থীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেওয়া এবং পুনর্বাসনের অনুমোদন দেয়। বিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামী সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য এবং তাদের পরিবারসহ আরো কয়েক লক্ষ লোক ছিলো, যারা ক্ষমতাসীন উত্তর ভিয়েতনামের কাছ থেকে নির্যাতন ও প্রতিশোধের মুখোমুখি হয়েছিলো।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, মন্টেরি বে-এর ইতিহাসের অধ্যাপক এবং লেখক ফুয়ং ট্রান গুয়েন বলেছেন, ‘ যুদ্ধের শেষে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সৈন্যদের নিজেদের ইউনিফর্ম পোড়াতে দেখা একটি সাধারণ দৃশ্য ছিলো। যাতে তারা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক না রাখে।
দক্ষিণ ভিয়েতনামের বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য সম্ভাব্য শত্রুদের রাইন্ড আপ করে ‘পুনঃশিক্ষা’ শিবির কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিলো। এটি ছিলো বাধ্যতামূলক শ্রম শিবির কেন্দ্র। যেগুলি দক্ষিণ ভিয়েতনামের ইচ্ছা ভঙ্গ করা, তাদের কমিউনিস্ট মতাদর্শদের প্ররোচিত করার জন্য তৈরি হয়েছিলো। সাবেক দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগনের অনেক বাসিন্দাকে গ্রামাঞ্চলে যৌথ খামারে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়েছিলো। প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়ায় খেমার রুজ ক্ষমতা দখল করার পর তার শত্রুদের কারাগারে পাঠায় এবং তাদের উপর নৃশংস গণহত্য চালায়।
ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের স্রোতের প্রবাহ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। পরিবারগুলো কোনো কিছুর পরোয়া না করে তাদের জিনিসপত্র সব স্যুটকেসে প্যাক করেছিলো এবং ‘যেকোনো উপায়ে’ তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো-বলছেন ‘রিটার্ন অব ওয়ার; সাউথ ভিয়েতনাম অ্যান্ড দ্য প্রাইজ অব ভিয়েতনাম মেমোরি’র লেখক এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক গবেষণার অধ্যাপক লং বুই।
বুই আরো বলেন, ‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ লাওস হয়ে থাইল্যান্ডের বনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই সমুদ্রপথে সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো জায়গায় পালিয়ে গিয়েছিলো। তারা প্রায়ই মালয়েশিয়ান এবং থাই জলদস্যুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছে। এরা নারীদের ধর্ষণ করে এবং তাদের কাছ থেকে সোনাদানা, টাকাপয়সা সব ছিনিয়ে নেয়। যেকারণে এটা এত কষ্টকর ছিলো’।
‘নৌকার এই মানুষগুলো’ শরণার্থী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। আশেপাশের বেশিরভাগ দেশই তাদের শরণার্থী হিসেবে স্বাগত জানায়নি কিংবা স্বীকৃত দেয়নি। উদাহরণস্বরুপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশই জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। বরং প্রকাশ্যেই হাজার হাজার ভিয়েতনামী এবং কিছু কম্বোডিয়ানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেছিলো। কারণ তারা সীমিত সম্পদকেও অধিষ্ঠিত করার হুমকি দিচ্ছিলো।
১৯৭৯ সাল নাগাদ, যখন প্রতি মাসে ৫০ হাজার এরও বেশি শরণার্থী নৌকায় করে আসছিলো, তখন মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলি শরণার্থীদের ভরা নৌকাগুলিকে সমুদ্রে ঠেলে দিতে শুরু করেছিলো।
নুগুয়েন বলেন, আনুমানিক ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার এর মতো শরণার্থী নৌকা ডুবে মারা গিয়েছিলো। তারা অনেক দিন পানি, খাবার না খেয়ে নৌকায় অবস্থান করছিলো। আবার অনেক নারী ও শিশু সাঁতার না জানায় পানিতে ডুবে মারা যায়।
উদ্বাস্তু সংঙ্কট মোকাবেলার জন্য ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ এক সম্মেলনের আয়োজন করে। যেখানে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে শরণার্থীদের নিরাপদ আবাসনের জন্য চুক্তি করা হয়েছিলো। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং কানাডার মতো দেশে শরণার্থীদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছিলো।
জুলাই ১৯৭৯ থেকে জুলাই ১৯৮২ পর্যন্ত ৬ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি শরণার্থীকে ২০টিরও বেশি দেশে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিলো। তারপরও অনেক পরিবার প্রায়শই শরণার্থী শিবিরে অপেক্ষা করে বছরের পর বছর কাটিয়েছে।
আরো পড়ুন:
শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া একটি লাভজনক খেলা!
মালয়েশিয়ার পুলাউ বিডং শরণার্থী শিবিরটি নির্মাণ করা হয়েছিলো শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে। মাত্র এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় সাড়ে চার হাজার লোকের থাকার জন্য ক্যাম্পটি ডিজাইন করা হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৭৯ সালের জুন মাসে এটি ৪০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। ফলে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনবহুল স্থান হয়ে ওঠে। দাতব্য সংস্থা এবং এনজিওগুলি উদ্বাস্তুদের পোশাক এবং শিশুদের জন্য খেলনার ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু এতো মানুষের ভিড়ে স্যানিটেশন ব্যবস্থা শক্তিশালী এবং উন্নত করা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিলো।
বেশিরভাগ শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য নির্ধারিত হওয়ার আগে মাস এমনকি কয়েক বছর ক্যাম্পে থাকতে পারে। এরপর তাদের নতুন জীবনের জন্য নতুন জায়গার কিছু রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত করাবে, ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা করবে। এই শিবিরগুলির মধ্যে কয়েকটি ১৯৮০ এর দশকে এবং ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শরণার্থীদের একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের আশ্রয় দেওয়া ও সেবা করার জন্য চালু ছিলো।
বুই বলেন, ‘২০০০ সালের গোড়ার দিকে এসেও ফিলিপাইনের কিছু শিবির চালু ছিলো। এর মানে একাধিক প্রজন্ম শরণার্থী শিবিরের ভেতরে জন্মগ্রহণ করেছিলো। ২০০৫ সালের দিকে আবার এটি ছিলো না। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম থেকে মালয়েশিয়ায় আসা ২ লাখ ৫০ হাজার নথিভুক্ত ‘নৌকা যাত্রী’দের শেষ পর্যন্ত সাইগেনের পতনের প্রায় ৩০ বছর পর পুনর্বাসনের সুযোগ পেয়েছিলো।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উদ্বাস্তুরা ঢেউয়ের প্রবাহের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসিত হয়েছিলো। রাষ্ট্রপতি ফোর্ডের সময়ে ১৯৭৫ সালে প্রথম প্রাথমিকভাবে এক লাখ ৪০ হাজার শরণার্থী আসে সেখানে। এই শরণার্থীদের বেশিরভাগই শিক্ষিত এবং কিছু ইংরেজি বলতে পারতেন। তারা দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সমারিক বাহিনীর আকস্মিক প্রস্থানের সময়, তাদের অপরাধ করা থেকে বাঁচানোর কারণে, একজন আমেরিকান জনতার কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন।
উদ্বাস্তুদের দ্বিতীয় ঢেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা শুরু করেছিলো ১৯৭৮ সালে। তারা একটি ‘শীতল অভ্যর্থনা’ পেয়েছিলো। এরা ছিলো ‘নৌকা যাত্রী’। সাধারণত দরিদ্র এবং কম শিক্ষিত একক পুরুষের একটি বিশাল দল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বদেশ থেকে পালানো, সমুদ্র পাড়ি দেয়া ও শরণার্থী শিবিরে বেঁচে থাকার ট্রমাগুলির কারণে তারা অনেকেই আমেরিকার নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছিলো। ১৯৭৮ সালের দিকে আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে, উদ্বাস্তুদের প্রতি আমেরিকান জনসাধারণের সমর্থন কমে গিয়েছিলো।
‘আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছি। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের উদ্বাস্তু অভিজ্ঞতা এখনও আমাকে তাড়া করে। আমি কেজি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ১৬টি স্কুল পরিবর্তন করেছি। এখনও আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় রয়েছি। এটার জন্য দায়ী যুদ্ধ। আমার গল্পটি হয়তো দ্বিতীয় প্রজন্মের, কিন্তু এটি উদ্বাস্তু ইতিহাস বহন করে’-বলেছেন লুই।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের আকস্মিক সমাপ্তির পর বড় আকারের উদ্বাস্তু সংঙ্কটের জন্য বিশ্ব একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। সংঙ্কট এত ভয়ঙ্কর হয়ে গিয়েছিলো যে, জাতিসংঘ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মতো সদস্য দেশগুলিকে বাধ্য করেছিলো, শরণার্থী হিসেবে যোগ্যদের খুঁজে বের করতে এবং সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে। কিন্তু নুগুয়েনের মতো আরো অনেক ইতিহাসবিদদের মতামত, ভিয়েতনামের আসল পাঠ কখনোই পুরোপুরি শেখা হয়নি।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই বিবেচনা করে না যে, কীভাবে উদ্বাস্তু অভিবাসন এবং বাস্তুচ্যূতি আমাদের সমস্ত বৈদেশিক নীতি হস্তক্ষেপের একটি অংশ। যে কোনো ধরনের যুদ্ধই সমস্যার দিকে নিয়ে যাবে। ফলে আমাদের মানবিক সংঙ্কট কিংবা যে কোনো ধরনের সঙ্কটকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে’ বলে মনে করেন নুগুয়েন।
সূত্র: আর্কাইভ অব ভিয়েতনাম