এথেন্সে একসময় মুসলিমদের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে শুরু হওয়া শরণার্থী সংকটের পর এ চিত্র বদলে যায়। এথেন্সে বর্তমানে পাঁচ লাখ মুসলিম বসবাস করছে
গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের একটি খ্রিস্টান সমাধিস্থলের দৃশ এটি: এসফানদিয়ার ফাগকিরি নামের একজন আফগান শরণার্থী তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তানের ছোট্ট সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছেন। সন্তানহারা এই পিতা তার কষ্টকে কোনোভাবেই সামলে রাখতে পারছেন না। তার আক্ষেপ সন্তানকে তিনি শুধু যে হারিয়েছেন তাই নয়, মুসলিম রীতি মেনে প্রিয় সন্তানের শেষকৃত্য পর্যন্ত করতে পারেনি! কারণ মুসলিম হওয়া স্বত্বেও তার সন্তানকে সমাহিত করা হয়েছে খ্রিস্টান সমাধিস্থলে।
এথেন্সের দক্ষিণাঞ্চলের মালাকাসা শরণার্থী ক্যাম্পের প্রবেশমুখে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এসফানদিয়ার ফাগকিরির ছেলে শিশু হাসিবুল্লাহ ফাগকিরি তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল। এসময় হঠাৎই তার ওপর একটি ট্র্যাক আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। এই শরণার্থী শিবিরেই হাসিবুল্লাহ তার বাবা এসফানদিয়ারের সঙ্গে ২০২০ সাল থেকে বসবাস করে আসছিল।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হাসিবুল্লাহর দুর্ঘটনার জন্য শরণার্থী শিবিরটির রুগ্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দায়ী করে এটিকে অবিলম্বে বন্ধ ঘোষণার দাবি তুলেছে।
হাসিবুল্লাহকে মাটি দেয়ার পর তার বাবা ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন এবং দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলেছিলেন তিন বছর পর ২০২৪ সালে তার সন্তানের দেহাবশেষ অবশ্যই সেখান থেকে তুলে ফেলা হবে। স্থান সংকুলানের কারণে গ্রিসের সমাধিস্থল রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ক নিয়ম অনুযায়ী এভাবে নতুন করে সমাধিস্থল তৈরী করা হয়। মূলত এথেন্সে দেশটির এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ এখানে এক কোটি মানুষ বসবাস করে। এর ফলে এখানকার সমাধিস্থলে বাড়তি চাপ পড়ে।
ফাগকিরির ভাষ্য, কোনো মুসলিম ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তার দেহাবশেষ উত্তোলন কিংবা দাহ করা সমর্থন করে না ইসলাম। মৃতদেহকে একবারই মাটি দেয়ার রীতি রয়েছে ইসলাম ধর্মে।
আরো পড়ুন:
পোলিশ সীমান্তে মায়ের গর্ভে মৃত শিশুকে মুসলিম কবরস্থানে দাফন
গ্রিস প্রধানত অর্থোডক্স খ্রিস্টান প্রধান দেশ। যে কারণে দেশটিতে মুসলমানের সমাধিস্থল খুব একটা দেখা যায় না। মুসলিমদের সমাধিস্থল শুধু দেখা যায়, দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় গ্রিস-তুরস্ক সীমান্তবর্তী থ্রেস এ। এথেন্স থেকে ৭৫০ কিলোমিটার দূরের অঞ্চল থ্রেস। সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য এ এলাকায় শতাব্দী প্রাচীন একটি স্থাপনা রয়েছে। এই অঞ্চলে একসময় অটোম্যান সাম্রাজ্যের সরব উপস্থিতি ছিল।
এথেন্সে একসময় মুসলিমদের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে শুরু হওয়া শরণার্থী সংকটের পর এ চিত্র বদলে যায়। এথেন্সে বর্তমানে পাঁচ লাখ মুসলিম বসবাস করছে। যুদ্ধ ও দারিদ্রতা থেকে বাঁচতে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট থেকে পরিবারসহ হাজার হাজার মানুষ গ্রিসে আশ্রয় নিয়েছে।
এথেন্স থেকে থ্রেসের দূরত্ব বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই যাতায়াত খরচ বেশি। তার ওপর কেউ মারা গেলে তাদের মরদেহ সেখানে নিয়ে যাওয়ার খরচ একেবারেই নাগালের বাইরে।
পাকিস্তানসহ বহু দেশের মুসলিমদের দাবী, এথেন্সে যেন একটি মুসলিম সমাধিস্থল তৈরী করা হয়। তবে এথেন্স নগর কর্তৃপক্ষ বলেছে, ২০১৬ সালে অর্থোডক্স চার্চ মুসলিমদের মরদেহ সৎকারের জন্য সিস্টো সমাধিস্থল থেকে ২০ হাজার স্কয়ার মিটার বা পাঁচ একর জমি দান করেছিল। কিন্তু প্রকল্পটি এখনো নানাবিধ জটিলতার কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে গ্রিসের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মুসলিমদের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান হস্তান্তর করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এগিয়ে চলছে, শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান করা হবে।
আরো পড়ুন:
ইতালিতে ১৬ লাখ মুসলিমের জন্য মাত্র আটটি মসজিদ!
এদিকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও দেশটির প্রধান বামপন্থী বিরোধী দল সিরিজা ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির অভিবাসন বিরোধী নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে। একইসঙ্গে তাদের অভিযোগ সরকার সীমান্ত দিয়ে অভিবাসীদের অবৈধ অ্যাখ্যা দিয়ে পুশব্যাক করছে।
এথেন্সে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মসজিদ চালু হয় ২০২০ সালে। তবে খুব সহজে যে, মসজিদটি চালু করা গেছে মোটেও তা নয়, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা অর্থোডক্স চার্চ ও কট্টর জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির তীব্র বিরোধিতার পর এথেন্সে প্রথমবারের মতো মসজিদ চালু হয়, যদিও তা প্রয়োজনের চেয়ে ছোটো।
সূত্র: ফ্রান্স২৪