জীবনের গভীরতা কতোটা অতল, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝুলি কত পূর্ণ হতে পারে, তার অন্যতম উদাহরণ চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিনের মনোজগতে রহস্যের শেষ নেই। একটি ছোট রহস্যকে নিয়ে রীতিমত বড় প্রশ্ন তোলা যায়, অভিবাসী হয়ে জীবনের প্রায় চল্লিশটি বছর যুক্তরাষ্ট্রে পার করে দিলেও কেনো কখনোই দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি চ্যাপলিন? পুরোটা জীবনই কেনো ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক পরিচয়ে? অথচ এই যুক্তরাষ্ট্র তাকে কি না দিয়েছে? এখানেই নিজেকে নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র কুশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চ্যাপলিন নিজেকে। এখানকার দর্শকদের ভালোবাসার স্রোতে একদিন বিশ্বময় হয়েছিল, সবাই জেনে গিয়েছিল চার্লি চ্যাপলিন বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অনবদ্য প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব।
নিপীড়িত, লাঞ্চিত, বঞ্চনায় আবদ্ধ নিজের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিবিম্ব, দর্শন হাজির করেছিলেন চ্যাপলিন তার অসংখ্য চলচ্চিত্রে। এর মধ্য দিয়ে তিনি পুঁজিপতি ও দখলদারদের বিরুদ্ধে পরোক্ষ সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। হাসতে হাসতে করুণ রসের উদ্রেক করেছেন, হাসি আর অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেই ব্যঙ্গ করেছেন চলতি সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
অভিবাসীদের স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন বুকে বেঁধে উন্মাদ-উত্তাল সমুদ্রের পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত থাকে লাখো মানুষ। সেই পথ ধরে একদিন যুক্তরাষ্ট্রে চ্যাপলিনও এসেছিলেন; প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকে। তবে দেশটিতে আসার পথে যে দুঃখ, কষ্ট আর বঞ্চনার শিকার তিনি হয়েছিলেন, তা তিনি চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে আনতে ভুল করেননি এতটুকু।
চ্যাপলিন নির্মিত সেই বিখ্যাত ছবির নাম দ্য ইমিগ্রান্ট। ১৯১৭ সালে মুক্তি পায় রোমান্টিক কমেডিঘরাণার এ চলচ্চিত্র। আমেরিকান এ নির্বাক চলচ্চিত্রের স্রষ্টা চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন ছবিটিতে ট্রাম্প নামের এক অভিবাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। যিনি কিনা পালিয়ে আটলান্টিক সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন। উদ্বাস্তু জীবনে তিনি একসময় প্রেমে জড়িয়ে পড়েন এক নারীর সঙ্গে। ছবিটিতে আরো অভিনয় করেছিলেন এডনা পারভিয়েন্স ও এরিক ক্যাম্পবেল। পরিচালনা ও অভিনয়ের পাশাপাশি ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন স্বয়ং চ্যাপলিন।
ছবিটির দৃশ্য পরম্পরা ও কাহিনি এমন যে, মাঝারি আকারের একটি জাহাজ দুলছে সমুদ্রের মাঝে। ভেতরে শত আশ্রয়হীন মানুষ। যাদের স্বপ্ন ‘আইল্যান্ড অব লাইব্রেরি’খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়া। সিনেমাটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে দেখা যায়, সমুদ্রে প্রচণ্ড ঢেউ হচ্ছে, নৌকার একুল ওকুলজুড়ে দুলছে। কারো মুখে হাসি নেই, অস্থির, চিন্তিত, বিষন্ন, উসকোখুসকো, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত সবাই। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে জাহাজের মধ্যে চ্যাপলিন জুয়া খেলে জিতে যায় টাকা। হঠাৎ খাবারের ডাক আসে। ডাইনিং টেবিলেও দুলতে থাকে ঢেউয়ের তালে তালে। কেউই খেতে পারে না ঠিকঠাক। প্লেটগুলোও টেবিলের এপাশ ওপাশ করে। ভাসাভাসির এ চিত্র যেন স্বয়ং অভিবাসীদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। হয়তো এ দৃশ্য ফুঁটিয়ে তুলে চ্যাপলিন বোঝাতে চেয়েছেন, অভিবাসীদের জীবনের কোনো ছন্দ নেই অথচ ছন্দহীন ঢেউয়ে পরিপূর্ণ। প্রচণ্ড গতি আছে তাদের জীবনে অথচ সে গতি ছন্নছাড়া, নিয়ন্ত্রণহীন। ভেসে ভেসে, ডুবে ডুবে তবুও অভিবাসীরা স্বপ্ন বাঁধে শেকড় গড়ার। ছন্দের দেখা পাওয়া, সঙ্গে আরেকটু হাসিমুখে জীবনটা পার করে দেয়ার কী অন্তিম ইচ্ছাই না সবার মনে। কিছুক্ষণের মধ্যে অভিবাসীদের দল বন্দরে ভেড়ে, স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে দিয়ে যখন জাহাজ এগোয়, তা দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে পড়ে সবাই,এই তো চলে এসেছি স্বপ্নের দেশে, স্বপ্ন বোনার, স্বপ্ন সত্যি করার দেশে। যখন অভিবাসীরা প্রথমবারের মতো স্টাচু অব লিবার্টি দেখতে পায় তখনই অভিবাসন কর্মকর্তারা সব বিদেশিদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে একসাথে। এরপর এক এক করে যখন তাদের ছাড়া হয় তখন বোঝানো হয়, যেন তারা মুক্ত হয়েছেন দেশটিতে ঢুকতে পেরে। এসময় অফিসার যখন চার্লির সামনে থেকে হেঁটে যায় ঠিক তখনই চার্লি তার পেছনে লাথি মারে।
যাত্রাপথে মধ্যে ট্রাম্প টাকা রোজগার করে অসহায় দুই নারীকে বিলিয়ে দেয়। যাদের একজনের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার প্রেম। ঘাটে ভেড়ে জাহাজ; নেমে পড়ে সবাই। ক্ষুধার্ত ট্রাম্প, পকেটে এক সিঁকিও নেই। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি পয়সা পকেটে ভরে ঢুকে পড়ে হোটেলে। সেখানে অর্ডার করে খাবারের। ওয়েটার দুর্ব্যবহার করে, চ্যাপলিন তথা ট্রাম্পের মাথার হ্যাট নামিয়ে রাখতে বাধ্য করে।
এর মধ্যে সেই মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা। ট্রাম্প সিমের অর্ডার করে। ওদিকে দুজনার গল্প চলে। খাবার আসে, মজা করে তারা খাবার খায়। একপর্যায়ে বিল নিয়ে আসে ওয়েটার। চ্যাপলিন পকেটে হাত দিয়ে দেখে টাকা নেই। ঘটনা হলো, প্যান্টের যে পকেটে কয়েনটি রেখেছিলেন তিনি, তা ফুঁটো হওয়ায় পয়সাটি পড়ে গিয়েছিল। হোটেল ঢোকার আগে যা একদমই খেয়াল করেননি চ্যাপলিন। এরপর কৌশলী হয়ে নানা ছলে একটি কয়েন জোগাড় করে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় তারা। বোঝা যায়, অভিবাসীদের স্বপ্নের দেশে একটু কৌশলী হলে শুন্য পকেট নিয়েও টিকে থাকা যায়। এ পর্যায়ে এক স্থানীয় ব্যক্তির সহায়তা অবশ্য সে পায়। যা দিয়ে হয়তো চ্যাপলিন বোঝাতে চেয়েছেন, অনেক কিছুর পরও অভিবাসীদের ইতিবাচক চোখে দেখা মানুষ এই দেশে আছেন। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, প্রেমিকাকে বৃষ্টির ভেতর বিয়ের অফিসে নিয়ে যায় চ্যাপলিন। তারা স্বপ্ন দেখে নতুন করে বাঁচার, এগিয়ে যাবার।
অল্প সময়ের এমন দৃশ্যায়নে ছবিটির মাধ্যমে চ্যাপলিন ব্যঙ্গবিদ্রুপ, পরিহাস, ভালোবাসা ও চলচ্চিত্রের কাব্যময়তা ফুটিঁয়ে তুলেছিলেন, যা একুশ শতকের অন্যতম সেরা কমিক মাস্টারপিস হিসেবে বিশ্ব চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। ছবিটি চ্যাপলিনের মিউচুয়াল সিরিজের একাদশতম অংশ। এটি দুই রিলের একটি ছবি। দুই রিলে নির্মিত নিজের সব ছবির মধ্যে এটিই তার সবচেয়ে প্রিয় ছবি হিসেবে অভিহিত করেছেন চ্যাপলিন নিজেই।
ছবির পেছনের গল্প
কেভিন ব্রাউনলো ও ডেভিড গিলের প্রামাণ্যচিত্র সিরিজ ‘আননোন চ্যাপলিন’ এর উদ্ধৃত অনুসারে, ছবিটির প্রথম দৃশ্যের জন্য যা লেখা ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল, তা চলচ্চিত্রটির দ্বিতীয়ার্ধে দেখানো হয়েছিল। দৃশ্যটি হলো সহায়সম্বলহীন চ্যাপলিনের পকেটে একটি মুদ্রাও অবশিষ্ট ছিল না। ঘটনাক্রমে তিনি একটি কয়েন খুঁজে পান এবং তা নিয়ে খাবার হোটেলে খাবার খেতে যান। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, তার পকেট থেকে সেই কয়েনটি এরই মধ্যে পড়ে গেছে। এদিকে মজার ব্যাপার হলো: চিত্রনাট্য অনুযায়ী রেস্টুরেন্টের দৃশ্যে অভিনয় করার সময় পারভিয়েন্সকে অনেকগুলো প্লেটভর্তি সিম খেয়ে সাবাড় করতে হয়েছিল। কারণ দৃশ্যটি অনেকবার টেক করতে হয়েছিল। (এই চরিত্রে আরেকজন অভিবাসী যিনি কিনা চার্লির প্রেমে পড়েছিলেন)। এত বেশি খাওয়ার কারণে পারভিয়েন্স সত্যি সত্যিই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
একটি দৃশ্যে দেখা যায়, চার্লি যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেই চরিত্রটি আমেরিকান একজন অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তাকে লাথি মারে। পরে তিনি এই দৃশ্যটি রাখার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ১৯৫২ সালে যখন তাকে বাধ্য করা হয়েছিল আমেরিকা থেকে বের হওয়ার জন্য, সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার ভেতর গড়ে ওঠা ‘আমেরিকা-বিদ্বেষী’ মনোভাবকে ফুঁটিয়ে তোলার জন্য এই দৃশ্যটি তিনি ছবিটিতে রেখেছিলেন।
১৯৯৮ সালে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও নান্দনিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ অভিহিত করে দ্য ইমিগ্রান্ট চলচ্চিত্রটিকে লাইব্রেবি অব কংগ্রেস কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়।
ছবিটি নির্মাণে চ্যাপলিন প্রচÐ পরিশ্রম করেছিলেন। প্রায় বিশ মিনিটের এ ছবিটি নির্মাণে তিনি ৯০ হাজার ফিট রিল খরচ করেছিলেন। যদিও শেষপর্যন্ত কেটকুটে মাত্র ২ হাজার ফিট রেখেছিলেন। টানা চার দিন চার রাত জেগে ছবিটির চুড়ান্ত সম্পাদনার কাজ করেছিলেন তিনি।
ইমিগ্রান্ট নির্মাণের পেছনের গল্প…
দ্য ইমিগ্রান্ট-এ আমেরিকায় অভিবাসী হতে গিয়ে নিজে যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন সেসবই রূপক অর্থে তুলে ধরেছিলেন চ্যাপলিন। অভিবাসী জাহাজে আটলান্টিকের যাত্রাপথের কষ্টগুলি থেকে অনেক মজার ঠাট্টা জাগিয়ে তুলেছিলেন চ্যাপলিন ছবিটির গল্পে। প্রচণ্ড বেগে দুলতে থাকা মানুষ, নৌকার দৃশ্য হাস্যকরভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে গিয়ে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন চ্যাপলিন। তখন অত উন্নত মানের ট্রাইপড ছিল না। চ্যাপলিন ছবিটির নির্মাণ নিয়ে বলেন এভাবে, ‘শ্রোতা কী প্রত্যাশা করে তা নির্ধারণ করা এবং তারপর অন্যরকম কিছু করা আমার কাছে খুব আনন্দের। আমার একটি ছবি, অভিবাসী, একটি দৃশ্যে আমাকে জাহাজের পাশের দিকে ঝুঁকতে দেখানো হয়েছিল। কেবল আমার পিঠটিই দেখা যেত এবং আমার কাঁধের চূড়ান্ত কাঁপুনি থেকে মনে হচ্ছিল আমি সমুদ্র অবসাদে ভুগছি। …আমি যা করছিলাম তা ইচ্ছাকৃতভাবে দর্শকদের বিভ্রান্ত করছিল। কারণ, যখন আমি সোজা হয়ে গেলাম, তখন আমি একটি লাইনের শেষে একটি মাছ টেনে দেখলাম এবং শ্রোতারা দেখেছিলেন যে, সমুদ্র অবসাদে ভোগার পরিবর্তে আমি মাছটি ধরার জন্য পাশের দিকে ঝুঁকছি। মোদ্দাকথা এটি বিরাট চমক হিসাবে এসেছিল এবং হাসির গর্জন পেয়েছিল।’
কার্লাইল রবিনসন, যিনি চ্যাপলিনের প্রচার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন, তিনি লোন স্টার স্টুডিওতে এই সিকুয়েন্স যখন নেয়া হচ্ছিলো তখন সেখানে ছিলেন। চ্যাপলিন নাকি তখন তার নতুন এ কর্মীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন দৃশ্যটি সম্পর্কে তিনি কী বুঝেছেন? খুব মজার এবং খুবই বাস্তবসম্মত’-বলেন রবিনসন। এর মধ্যে কোনো খারাপ কিছু পেয়েছো কী? ‘তেমনটা নয় আমি বলেছিলাম।’ তবে চ্যাপলিনের আরেক সহকর্মীর মাধ্যমে এ নিয়ে সামাজিকভাবে সমালোচনার বিষয়টি উঠে এসেছিল। রবিনসনের উত্তরটি চ্যাপলিনের পছন্দ হয়েছিল এবং তিনি শেষ পর্যন্ত দৃশ্যটি ছবিটিতে রেখেছিলেন।
একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে চ্যাপলিনের অসাধারণ বিকাশের পেছনে দ্য ইমিগ্রান্ট ছবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া পূর্ণমাত্রায় এ ছবির মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো চ্যাপলিন রোমান্টিক সম্পর্ক উপস্থাপন করেছিলেন। চ্যাপলিন তার জীবনে যত ছবি তৈরি করে খ্যাতি পেয়েছেন তার মধ্যে তিনি বিশেষভাবে এই ছবিটিকে ভালোবেসেছেন, নিজের এ সৃষ্টি নিয়ে সবসময় কথা বলেছেন। তিনি তার ‘মাই লাইফ ইন পিকচারস’-এ লিখেছেন, ‘দ্য ইমিগ্রান্ট আমার নির্মিত অন্য যেকোনো ছবির চেয়ে আমাকে বেশি স্পর্শ করেছে।’