মঙ্গলবার, 30 এপ্রিল, 2024

‘একজন অভিবাসী নারীও নিপীড়িত হবে না, এটি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে’

রাফিজা শাহীন; প্রায় দেড় যুগ ধরে যুক্ত আছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এর সঙ্গে। বর্তমানে তিনি এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জেন্ডার বিষয়ে দেশ-বিদেশে তার রয়েছে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন (এসডিসি) এর অর্থায়নে ব্র্যাক ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর যৌথ অংশীদারিত্বে চলমান ‘রিইন্টিগ্রেশন অব রিটার্নি মাইগ্রেন্ট ওয়াকার্স ইন বাংলাদেশ প্রজেক্ট’টির অন্যতম গুরুত্বের জায়গা বিদেশফেরত নারী অভিবাসী শ্রমিকদের পুনরেকত্রীকরণ করা। এ নারীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নিপীড়ন ও নির্যাতন শিকার। সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে সমাজের মূল স্রোতধারার সঙ্গে কীভাবে এই নারীরা অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। অভিবাসী ডটকম এর মুখোমুখি হয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন রাফিজা শাহীন। তার দেয়া সাক্ষাৎকারটি আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অভিবাসী ডটকম এর নির্বাহী সম্পাদক রুবেল পারভেজ

সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন (এসডিসি) এর অর্থায়নে ব্র্যাক ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর যৌথ অংশীদারিত্বে চলমান ‘রিইন্টিগ্রেশন অব রিটার্নি মাইগ্রেন্ট ওয়াকার্স ইন বাংলাদেশ প্রজেক্ট’টি অন্যান্য প্রজেক্ট থেকে ঠিক কোন কোন জায়গায় আলাদা বলে আপনার মনে হয়?

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর পক্ষ থেকে আমরা যখন এ প্রকল্প ডিজাইন করি, তখন নারীকে মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই এগিয়েছি। কারণ আমাদের কাছে মনে হয়েছে, অভিবাসী শ্রমিক বলতে নারী-পুরুষ দুজনকে বোঝালেও বাস্তবতা ভিন্ন। অভিবাসী নারী শ্রমিকের যুদ্ধটা অনেক ক্ষেত্রে আলাদা। বিদেশে যাওয়া থেকে শুরু করে, সেখানে কাজ করা এবং ফিরে আসা-পুরো এই পথচলায় তাকে অনেকগুলো বাঁধা পেরোতে হয়।

প্রথমত, হাজার বছরের সংস্কৃতি, সমাজ ও পরিবারের প্রথাগত রীতিনীতিকে পেছনে ফেলে নারীকে বিদেশ যেতে হয়। ওখানে গিয়ে তাকে আরেকটা যুদ্ধের মুখে দাঁড়াতে হয়। তাহলো, নারীদের বেশিরভাগই যেহেতু গৃহশ্রমিক হিসেবে যায় সেহেতু তাকে আরেকটি নতুন পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে কাজ করতে হয়, থাকতে হয়, খেতে হয়, ঘুমাতে হয়। এতসব করার ক্ষেত্রে তাকে প্রথমত সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। তিনি প্রত্যাখাত হন, নিপীড়িত হন।

বিপরীতে পুরুষ শ্রমিকদের বেশিরভাগই বাইরের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, যত কষ্টই হোক না কেনো দিনশেষে ঘরে ফিরে নিজের মতো করে ছয় ঘণ্টা কাটাতে পারে। কারণ সে যদি মেস করেও থাকে, তাহলেও তার সহকর্মীরা তার ভাষার লোক না হলেও আবেগের বিনিময়টা করতে পারে। আবেগীয় জায়গাটা তাদের মরে যায় না। কিন্তু নারী শ্রমিকদের আবেগটাই মারা যায় আগে। যে গৃহকর্তার অধীনে এ নারী কাজ করেন, তিনি যদি মানবিক না হন, তাহলে তার যুদ্ধটা আরো ভয়ানক ও অবর্ণনীয় হয়ে ওঠে। এরকম পরিস্থিতিতে ভাগ্যক্রমে জীবন নিয়ে দেশে ফেরার পরও যেভাবে এই নারীদের নেতিবাচকতা আর সংগ্রামের মুখে পড়তে হয়, তা আরেক রকমের বাস্তবতা। দুঃসহ এসব পরিস্থিতি থেকে তাদেরকে টেনে তোলাই এ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

গৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া নারী শ্রমিকদের অবস্থাতো আরো করুণ…

হ্যাঁ। সমাজ, নিয়ম-নীতি দিয়ে নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রিত হয়। যৌনতার সঙ্গে নারীর নিজের ইচ্ছার কোনো সংযুক্তি থাকে না-না দেশে না বিদেশে। নারীর কনসেনচুয়াল সেক্স নিয়ে আমাদের কোনো আলাপ নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এমনকি সরকারও স্বীকার করে, ৩০ ভাগ নারী বিদেশে কাজ করতে গিয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। বিপরীতে আমরা যারা উন্নয়ন সেক্টর করি, তারা দেখেছি, এ হার ৭০ শতাংশের বেশি। তাদের অনেকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

আইনে বলা আছে, আমাদের দেশের নারীরা, যারা বিদেশে কাজ করতে যাবে, তাদের বয়স নূন্যতম ২৫ বছর হতে হবে। একারণে অনেকে বয়স বাড়িয়ে ২৫ দেখিয়ে যায়। সেই নারী যখন ফিরে আসে তখন তাদের হাতে কিছু টাকাপয়সা থাকলে তার ভাই-বাবা-স্বামী তা নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকে এসে দেখে তার স্বামী নতুন টিনের ঘর তুলেছে তারই টাকা পয়সা দিয়ে। কিন্তু ঘরে আরেকজন বউ এনে দিব্যি সংসার করছে। বাচ্চা দুটোর (প্রতীকী অর্থে) করুণ হাল, হয়তো তারা গরীব নানা নানির কাছেই কষ্টে বড় হচ্ছে।

এরকম একটা অবস্থায় সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দেশে ফিরে কাজ করতে গিয়ে তিনি কিছু সমস্যায় পড়েন। কারণ বিদেশে থাকাকালীন জীবন ব্যবস্থায় তার মানসিক পরিবর্তন এসে গেছে-হয়তো তিনি মাইক্রোওভেন চালাতে শিখে গেছেন, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় পরিষ্কার করছেন। এক্ষেত্রে তারা যাপিত জীবনের অভ্যস্ততার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। যারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন না, তারা আবারো তাড়াহুড়ো করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে, যা আরো বেশি অনিরাপদ হয়ে ওঠে তার জন্য।

অনেকগুলো প্রভাবের ফলস্বরূপ নারী মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে, বিপর্যস্ত হয়। এক্ষেত্রে তাদের বিধ্বস্ত মানসিক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য এই প্রকল্প কীভাবে কাজ করবে?

এই ধাক্কাগুলো থেকে কাটিয়ে তোলা এবং সুরক্ষা দেয়ার জন্য এ প্রকল্প মনোঃকাউন্সেলিং মডিউলকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রজেক্টটির মূল ফোকাসই হচ্ছে মানসিক কষ্ট থেকে বেরিয়ে এসে যেন নারীরা তাদের সঞ্চয় বা নতুন প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং তা ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

আমরা এ প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো পরিবারকে কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনবো। নারী যে পরিবার থেকে বিদেশে যায়, সেই পরিবার, তার কমিউনিটির মানুষদের আমরা বোঝাবো-এই মেয়ে আপনাদেরই স্বজন, আপনাদের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্যই সে বিদেশ গিয়েছিলো। তাদেরকে খারাপ না ভেবে তাদের প্রতি যেন সবাই সহমর্মী হয়, নারীর যুদ্ধটা অনুধাবন করে- সে বিষয়ে কথা বলবো।

বিদেশ ফেরত অভিবাসী শ্রমিকদের গোপন কথাগুলো যেন কোনোভাবেই বাইরে প্রকাশ না পায়, সেটা খেয়াল রাখা প্রয়োজন এবং এ গোপনীয়তা রক্ষা করাও জরুরী। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভিকটিমের পরিবার বা সমাজ এ বিষয়ে অজ্ঞ। তাদেরকে সচেতনার বিষয়ে যা ভাবছেন?

ব্যক্তি পর্যায়ে এই গোপনীয়তাকে আমরা অবশ্যই সমর্থন করি। কিন্তু সামষ্টিক দিক থেকে ছদ্মনামে হলেও কমিউনিটিকে বিদেশফেরত অভিবাসীদের পরিস্থিতিগুলো জানাতে হবে। কারণ এই নারী ধর্মীয় যে অনুভূতি নিয়ে বিদেশে যায়, সেটা ওখানে সবসময় সুরক্ষিত নাও হতে পারে, সে আশঙ্কার বিষয়টি সবার জেনে রাখা উচিৎ ও কর্তব্য। ব্যক্তিগতভাবে আমরা রহিমার (ছদ্মনাম) নাম নিয়ে বলতে বলছি না। কিন্তু এই কেস স্টাডিগুলো আসতে হবে। এগুলো যত বেশি জানানো যাবে, একজন নারী তত বেশি সুরক্ষা নিয়ে বিদেশে যেতে পারবে।

আরো পড়ুন:বিদেশ গমনেচ্ছুদের নিয়ে কাজ করে অন্যরকম তৃপ্তি পাই’

নিরাপদ অভিবাসনে তথ্যের সহজ প্রাপ্যতার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি যেভাবে দেখেন?

নিরাপদ অভিবাসনে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি প্রভাব রাখে তাহলো তথ্য। দালাল যে তথ্যগুলো দেয়, তা যে কি পরিমাণে ভুল! সে বিদেশ গমণেচ্ছুদের প্রলোভন দেয়, আরে সৌদি আরব তো রহমতের দেশ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ স. এর স্বদেশভূমি। ওখানে গিয়ে তুমি আরামে থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো আমাদের কথা হলো, ইনফরমড চয়েজ অর্থাৎ সে ইনফরমড হয়েই যাক যে, সেখানে তার বিপদ হতে পারে। এতে করে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করার সুযোগ সে পাবে, হুট করে সবকিছু এলোমেলো হতে দেখবে না। পরিস্থিতি সামাল দেয়াটা তার জন্য সহজ হবে।

আমরা এখন বলি, বিমান থেকে নামার পরপরই কিংবা আগেআগে সে যেন কিছু কাগজপত্র বা তথ্য পরিবার প্রিয়জনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কারণ বিমান থেকে নামার পর অনেকেরই মোবাইল পাসপোর্ট সব নিয়ে নেয়া হয়। এজন্য হস্তান্তরের আগেই সেসব কাগজপত্রের ছবি তুলে আপনজনদের কাছে দিয়ে রাখতে হবে। আর এখন তো সবাই স্মার্ট ফোন চালাতে জানে। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলে দরকার হলে কারো কাছ থেকে হটস্পট নিয়ে হলেও সে যেন তথ্যগুলো পাঠিয়ে দেয়। কারণ এয়ারপোর্ট থেকে নামার পরই তাদের অসুরক্ষিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিদেশে যাওয়া নারীদের এই সংকট নিয়ে সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

নিপীড়ন-হত্যাকাণ্ডের শিকার নারীদের নিয়ে কথা বলতে সরকারের কাছে গেলে আমাদের খুব কষ্ট লাগে। কারণ তাদের পক্ষ বলা হয়, এটা আর কয়টা? না, এটা কয়টার কথা না, একজন অভিবাসী নারীও নিপীড়িত হবে না, এটি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। দেশের উন্নয়নে যে নারীরা রেমিটেন্স পাঠান, তাদের লাশ ড্রেইনে পাওয়া যায়, এটা কাম্য হতে পারে না।

আবার ১৫ বছরের জেসমিন (উদাহরণ হিসেবে) বয়স বাড়িয়ে ২৫ বছর করে বিদেশ গেলে, যখন আমরা সরকারের কাছে এ নিয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাই, তখন তারা বলে এরকম ঘটনা তো বিচ্ছিন্ন। না, আপনারা শুধু জেসমিনের মায়ের কথা চিন্তা করেন যে, এই মা তিন বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে, মেয়েকে বুকে নিবে। কিন্তু সে বিমান বন্দরে গিয়ে লাশ পেলো, তাও ছিন্নভিন্ন অবস্থায়। এই মানুষটা যদি একজনও হয়, তাও হতে পারবে না। এক্ষেত্রে নারী অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারের অবস্থান থাকতে হবে জিরো টলারেন্স।
এসডি’র এ প্রকল্প যে আটটি জেলায় এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তার মধ্যে ভোলার মতো প্রত্যন্ত এলাকাও রয়েছে। এসব জায়গায় সামাজিক নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। বিশেষ করে পুরুষ প্রাধান্যশীলতাকে অতিক্রমের সেই চ্যালেঞ্জ কতোটা দেখছেন?

বিষয়টি অনেক চ্যালেঞ্জের। আমাদের অনেক ট্যাবু ভাঙতে হবে। তবে আমরা পারবো। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে অনেক কথা বলতে হবে। কারণ পুরুষের সঙ্গে নারী বিভিন্নভাবে সম্পর্কিত-মা-ছেলে, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মেয়ে। বিভিন্ন বয়সী পুরুষের সঙ্গে নারীকে বসিয়ে যদি আমরা কথাগুলো বলতে পারি, তাহলে সে আবেগীয় ব্যাপারটা উঠিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। পুরুষ কি তার মেয়ে, স্ত্রী, বোনকে ভালোবাসে না? অবশ্যই ভালোবাসে। শুধু তার কাছে নেই তথ্য, নেই পরিকল্পনা। এগুলো সরবরাহ করতে পারলে এ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

এর আগে এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতাগুলো কেমন?

এর আগে নারীদেরকে নিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্য সংযুক্ত পুনরেকত্রীকরণের কোনো প্রকল্প আসেনি। তাই বলা যেতে পারে, এটা একেবারেই নতুন। তবে আমরা আশাবাদী।

আরো পড়ুন: ইসলাম আমার সাংস্কৃতিক পটভূমি গঠন করেছে- আব্দুলরাজাক গুরনাহ

আপনার কী মনে হয়, বিদেশ ফেরত নারীদের পুনরেকত্রীকরণ করার মাধ্যমে একধরনের সামাজিক ভারসম্য তৈরী সম্ভব হবে এবং এর প্রভাব সমাজের অন্যান্য অংশে পড়বে?

অবশ্যই পড়বে। দেখুন, আমাদের সমাজে একটি নারী শ্রেণি তৈরী হয়েছে, যারা চাকরি-বাকরি করছে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এই শ্রেণির জন্য কিন্তু তাদের গৃহে সাহায্যের প্রয়োজন। অথচ এই প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি না জানা অথবা পরিবেশ তৈরি না হওয়ার কারণে আরেক শ্রেণির নারী দেশের বাইরে গৃহস্থালির কাজে চলে যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে যে অবস্থার মুখোমুখি হন, তা তো সবারই কমবেশি জানা। অথচ বিপুল সংখ্যক এই নারীদের জন্য যদি উপযুক্ত একটি পরিস্থিতি তৈরী করা যায়, তাহলে তারাই কিন্তু বিদেশে না গিয়ে দেশেই কাজ করবে। অর্থাৎ আমাদের দেশের মা-বোন আমাদের জন্যই ভাত রান্না করবে। পাশাপাশি তার মর্যাদাও থাকবে। অন্যদিকে তার ব্যাংকে কিছু সঞ্চয়ও থাকবে। এই পরিবেশটা তৈরি করতে হবে।

আমরা যে পুনরেকত্রীকরণের কথা বলছি তাতে, যে নারীরা বিদেশ থেকে ফিরে আসে, তারা কিন্তু কোনো না কোনোভাবে দক্ষতা অর্জন করেই দেশে ফিরে আসে। ঢাকা শহরে যখন আপনি ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেয়ে বা নারীকে কাজে নিবেন, সে কিন্তু ওয়াশিং মেশিনটা চালাতে জানে না। ফ্রিজটা অফ করা জানে না। কিন্তু সৌদিতে যে মেয়েটা কাজ করেছে সেই মেয়েটাকে যদি আমরা পুনরেকত্রীকরণ করি, গৃহস্থালির কাজে যুক্ত করি সম্মানের সঙ্গে, তাহলে তারা স্বাবলম্বী হবে। এক্ষেত্রে আবারও বলছি, যদি তিনি এখানেও অসম্মানিতবোধ করেন, তাহলে সে ভাববে, যাহ, বিদেশেই চলে যাবো! আরো বেশি টাকার লোভ থেকেও হয়তো অনেকে চলে যাবে। সুতরাং ভেবেচিন্তে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে সফল হওয়া মোটেও অবাস্তব হবে না।

আরো পড়ুন: লড়াইটা অভিবাসীদের মর্যাদা রক্ষার: রায়হান কবির

শুধু গৃহকর্মী হয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর এই প্রবণতা ঠেকাতে কী করা যেতে পারে?

এক্ষেত্রে সরকারের প্রতি আমাদের চাপ বাড়াতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, শুধু গৃহস্থালি পেশায় আটকে থাকলে তো নারী সেই ঘরের মধ্যেই বন্দি থাকলো। ফলে আরো নানান পেশায় কীভাবে তাকে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তা ভাবতে হবে। তাছাড়া বিশেষ করে গলফ কান্ট্রিগুলোতে আমাদের দেশের নারীরা কাজ করতে যাওয়ার বড় কারণ ধর্ম। তারা যায় এটা ভেবে যে, তারা একই ধর্মের। কিন্তু গিয়ে দেখে ভাষা এক নয়, পোশাক এক নয়, খানাখাদ্য এক নয়, রুচি এক নয়। আমরা কেনো পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারলাম না! এসব কারণেই তো। সেই একই ধাক্কাটা ওরা ওখানে গিয়ে খায়। এসব নিয়ে অনেক কথা বলতে হবে সবপর্যায়ে। আমরা তৃণমূল পর্যায়ে শুরু করেছি। একইসঙ্গে নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে করতে হবে। সবমিলিয়ে আমরা আশাবাদী।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিয়ে একটি একটা কথা প্রচলিত যে, প্রকল্পের সময়সীমার মধ্যে অনেক ইতিবাচক উন্নয়ন হলেও সময়সীমা শেষ হওয়ার পর, তা আগের অবস্থাতেই ফিরে যায়…

এরকমটি যে ঘটে নাম তা নয়, ঘটে। তবে আমার বিশ্বাস, এসডি’র এ প্রকল্পটি টিকে যাবে। প্রকল্পটির অন্যতম লক্ষ্য কমিউনিটিকে এমপাওয়ার করা। কমিউনিটিকে একবার এমপাওয়ার করে যদি আমরা চলে আসি, তাহলেও তাদের কাছে তথ্যটা থেকে যাবে। আর এই তথ্যই তাদের পথচলার পরিধিকে প্রশস্ত করবে। আজকে যদি একশো নারী জানে নিরাপদে কীভাবে বিদেশ যেতে হবে, ৫০০ নারী যদি জানে বিদেশ যাওয়া সবসময় নিরাপদ নয়-এসব তথ্যই কিন্তু থেকে যাবে এবং তাদেরকে রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। এই নারী একসময় মা হবে, সে তার ছেলে মেয়ে উভয়কেই এই তথ্য দিবে। আমরা ভীষণ আশান্বিত এই প্রকল্প লক্ষ্য অর্জন করবে।

যেহেতু প্রকল্পটির মাধ্যমে বিদেশফেরত নারী অভিবাসী শ্রমিকদেরকে প্রাধান্য দেয়া হবে, এক্ষেত্রে তাদের সংবেদনশীলতা রক্ষার বিষয়টি খুব গুরুত্বের দাবি রাখে। বিষয়টি মোকাবিলায় এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত পুরুষ কর্মীদের মানসিকতা কতোটা প্রস্তুত বলে মনে করেন?

সংকট থাকলে উত্তরণেরও পথ আছে। সংকটটা খুব ভয়াবহ না। এই মানুষগুলো কিছুটা ডেডিকেটেড। আপনি মোটিভেশনটা কীভাবে দিচ্ছেন, সেটার ওপর সবকিছু নির্ভর করে। তারাও বিশ্বাস করে, নারীরা ওখানে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হন, তাদেরও মা বোন আছে। আমার সহকর্মীরা, যারা এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, তারা কিন্তু সচেতন। তারপরও অনেকের মনে এই ভয় থাকতে পারে যে, পরিবার ছেড়ে তারই স্ত্রী যদি বাইরে যায়, তাহলে তার কিছুটা সমস্যা হবে, স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে যাবে। আবার আমার সম্পদে হাত পড়বে কিনা! ভিন্নভাবে দেখলে কী হয়, এই লোকটিকেই কিন্তু তার স্ত্রী, বোন কিংবা মাকে দেখভাল করতে হয়। যা তার জন্য বাড়তি চাপ।

আরো পড়ুন: ইউরোপের জন্য লজ্জার

আমরা জেন্ডার বিষয়ক প্রশিক্ষণে বলি, দক্ষিণ এশিয়াতেই পুরুষের গড় আয়ু সবচেয়ে কম। এর কারণ কিন্তু ডাবল বারডেনড। হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক এই-সেই নানান রোগে সে ভোগে একারণেই। অথচ নারী কিন্তু কিছুটা হলেও এ চাপ থেকে মুক্ত থাকে। এর একটি উদাহরণ হলো: বোনের বিয়ের সময় ভাইয়ের ওপর যে দায়িত্বের ভার থাকে, সেটি কিন্তু অন্য বোনদের ক্ষেত্রে থাকে না। কারণ পরিবার সমাজ থেকে ধরেই নেয়া হয়, বোনের বিয়ে দেয়া ভাইয়ের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালন না করলে অভিযুক্ত হয়ে যায়। এর কারণ খুঁজতে অনেক গোড়ায় যেতে হবে। আমাদের সঙ্গে যারা ওয়েলট্রেইনড, তাদের চিন্তা চেতনায় ইতোমধ্যে ধাক্কা লাগাই আছে।

জেন্ডার সমতা বিধানে পাঠ্যপুস্তকে কোনো পরিবর্তন চোখ পড়ে?

হ্যাঁ, পাঠ্যপুস্তকে আমরা অনেক পরিবর্তন দেখেছি। আমি নিজেও সেখানে কাজ করেছি। ভাষাগত অনেক ব্যাপার আছে, যাতে পরিবর্তন আসছে। দেখা যায়, ডাক্তার আর শিক্ষকতা হচ্ছে নারীদের পেশা। কিন্তু ট্রাক ড্রাইভিং নারীদের পেশা নয়। অথচ ছবিতে যদি দেয়া যেতো একজন নারী ট্রাক চালাচ্ছেন, তাতে কিন্তু একটি শিশু ছোটোবেলা থেকেই নারী পুরুষের সমতার ব্যাপারটি দেখতো। এরকম বিষয়ের পরিবর্তন হতে আরো সময় লাগবে, কারণ এটা তো হাজার বছরের সংস্কৃতিকে পরিবর্তনের ব্যাপার।

অভিবাসী ডটকমকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
97SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা