এ যেন আশ্রয় শিবিরের লাইলী-মজনুর পুনর্মিলন

0
728
নাইজেরিয়ার অভিবাসী যুগল, আশ্রয় শিবির

নাইজেরিয়ার তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাবার এক বুক স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়ায় ছুঁটে এসেছিলেন ২৩ বছর বয়সী এক মুসলিম নারী হালিমা বেগম (ছদ্মনাম)। কিন্তু জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর যে স্বপ্ন নিয়ে ঘরছাড়া হয়েছিলেন হালিমা, সেই স্বপ্ন ফিঁকে হয়ে যেতে সময় নেয়নি খুব বেশি; হালিমা দুর্ভাগ্যের ফেরে পড়েন।

জীবনে যা কখনোই কল্পনা করেননি, তাই তাকে ছোবল দেয় চোখের পলকে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় তার। পতিতাবৃত্তির মতো কাজেও তাকে বাধ্য করা হয় দিনের পর দিন। তীব্র যন্ত্রণার সেই জীবন থেকে বের হয়ে আসার শত চেষ্টা একদিন সফল হয় তার। পালিয়ে এসে হালিমা শরণার্থী হিসেবে ঠাঁই পান একটি আশ্রয় শিবিরে।

হালিমার মতো এমন হাজারো মানুষ প্রতিনিয়ত নিপীড়নের মুখোমুখি হন, পতিত হন মৃত্যুর মুখেও। এই মানুষগুলোর একটাই মাত্র স্বপ্ন পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়ে সুন্দর ও সার্থক এক জীবন আলিঙ্গন করার। অভিবাসীদের এই গল্প, এই স্বপ্ন দেখা এখন নিত্যদিনের সাদামাটা কথায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই মানুষগুলো স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। শত কষ্টের মধ্যেও যে ভালোলাগাটুকু তাদের স্পর্শ করে তারা তা বেঁধে রাখেন স্মৃতির মনিকোঠায়।

প্রতীকী ছবি, সংগৃহীত

হালিমার গল্প বিষাদে ভরপুর হলেও লিবিয়ায় আসার পর বানি ওয়ালিদের আশ্রয় শিবিরে রঙ্গিন এক রোমন্থন তাকে আলিঙ্গন করেছিল। হালিমা কি কল্পনা করেছিলেন এই আশ্রয় শিবিরেই তার স্বামী আবদুল্লাহর (ছদ্মনাম) সঙ্গে তার আবার দেখা হবে! হয়তো না, কিন্তু এটাই জীবনের চিত্রনাট্য। দীর্ঘ যাতনার পর অবিশ্বাস্যভাবে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাতের দুর্লভ মুহূর্ত তিনি উপভোগ করতে পেরেছিলেন।

২৭ বছর বয়সী আবদুল্লাহ নাইজেরিয়া ছেড়েছিলেন পায়ে হেঁটে। ২০১৬ সালে ত্রিপোলিতে পৌঁছানোর জন্য একটি গাড়িতে করে মরুভূমির সীমান্তের ভেতর দিয়ে লিবিয়ায় অনুপ্রবেশ করেন তিনি। রাজধানী থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর বানি ওয়ালিদে আসার পর সশস্ত্র একটি দল তাকে আটক করে।

২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অসংখ্য সশস্ত্র গোষ্ঠী লিবিয়ার ভূখন্ড ও অথনৈতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করেছিল। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অভিবাসীদের পাচারের রুটের নিয়ন্ত্রণও এ গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছিল।

জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম এর তথ্যমতে, লিবিয়ায় ৫ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত অভিবাসী রয়েছে। চলতি বছর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে যাবার এ সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। আবদুল্লাহ চার মাস ধরে বন্দী ছিলেন সেখানে। সশস্ত্র ব্যক্তিরা তার কাছে অর্থ দাবি করেছিল। আবদুল্লাহ অর্থের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছিলেন। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে তিনি বানি ওয়ালিদ এ চাকরি পেয়েছিলেন। এসময় তিনি মাঝেমধ্যে হালিমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ পেতেন এবং তাকে নিয়ে একসঙ্গে স্বপ্নের দেশে পাড়ি দেয়ার কথা বলতেন।

দুই বছর পর একই পথ ধরে হালিমা রওয়ানা দেন লিবিয়ার উদ্দেশে। যখন হালিমা ত্রিপোলি পৌাঁছান, তখন বানি ওয়ালিদে ঘটনাক্রমে তার এক বন্ধুর প্রতারণার শিকার হন। তার সেই বন্ধু তাকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেন। সেখানে কোনো ফোন না থাকায় তিনি কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।

চার মাস বন্দী জীবন কাটানোর পর হালিমা সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং বানি ওয়ালিদের একটি আশ্রয় শিবিরে চলে আসেন। যেখানে অভিবাসীদের খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় শহরের মানুষজন ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অর্থায়নে। ২০১৫ সাল থেকে এটি চলে আসছে। ১২ জন অভিবাসী নাগরিক এখানে কাজও করছেন। যাদের বেশিরভাগই এসেছেন সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে। আশ্রয় শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা আল হুসেইন বিন ঘারসা বলেন, ‘লিবিয়াকে ঘিরে যেসব নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত আছে, তার মাঝে এই সত্যটুকু প্রতিষ্ঠিত হোক যে, বানি ওয়ালিদ আতিথেয়তারও শহর।’ যেখানে অভিবাসীরা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারে।

মানবিক বানি ওয়ালিদের এই আশ্রয় শিবিরেই হালিমার স্বপ্নপ্রদীপ জ্বেলে ওঠে। ঘটনাক্রমে এখানেই তিনি তার স্বামীকে পেয়ে যান। ‘আমি তাকে চুমু খেলাম এবং কান্না শুরু করে দিলাম। আমি অনেক কেঁদেছিলাম। আমি বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম, কারণ আমি জানতাম না যে তার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে’- এভাবেই তিনি তাদের পুনরায় দেখা হওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করেন। এই আশ্রয় শিবিরে তারা নিরাপদভাবে নতুন জীবনের স্বপ্ন খোঁজার চেষ্টা করতে পারছেন। এতকিছুর পরও তারা ইতালি যাবার স্বপ্ন জিঁইয়ে রেখেছেন।

সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here