ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধেই বিপর্যয়ের কারণে ৯ দশমিক ৮ মিলিয়ন নতুন বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই ঝড়, বন্যা, খরা ইত্যাদির মতো আাবহাওয়াজনিত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এসব বিপর্যয়ের তীব্রতা এবং পুনরাবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এখনকার সময়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ মানবিক ও উন্নয়নমূলক চ্যালেজ্ঞগুলো রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতি অন্যতম।
যেহেতু আমরা একটি নতুন দশকে প্রবেশ করেছি, তাই সময়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার এবং সেই সঙ্গে এই অনুকূল সময়টি নতুন এবং উদ্ভাবনী সমাধানের উপায় হিসেবে ব্যবহার করার সময় এসেছে। পরবর্তী দশ বছরে দুর্যোগ এবং জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি মোকাবেলার জন্য সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়ক এমন দশটি কৌশলের কথা বলেছেন আইডিএমসি এর নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞ বারবারা অ্যাসেইজ এবং বিনা দেশাই।
ছোট পরিসরের বিপর্যয়ের দিকে নজর রাখুন
যখন দুর্যোগজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথা আসে, তখন আমাদের চোখের সামনে ভয়াবহ ঝড়, বিধ্বংসী ভূমিকম্প, মুষলধারে বৃষ্টিপাত বা বন্যার মতো প্রলয়ংকারী সব দুর্যোগের চিত্র ভেসে ওঠে কিংবা এগুলোই আমাদের সমস্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির জন্য এগুলো অবশ্যই উল্লেখযোগ্য কারণ, তবে স্থানীয় ও ক্ষুদ্র আকারের ঘটনাগুলি বেশিরভাগ সময় জনগণ এবং মিডিয়ার রাডারের বাইরে থাকে। আইডিএমসির দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতির ডাটাবেজের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমস্ত বাস্তুচ্যুত ঘটনার ৫৪ শতাংশ ঘটনা একশ জনেরও কম লোককে বাস্তুচ্যুত করেছিল। আমাদের এই দৃশ্যমানতার অভাব কেবল ক্ষতিগ্রস্থ জনগনের জন্য কম সমর্থনই নয়, ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র আকারের বিপর্যয় রোধের প্রচেষ্টাকে কম মনোনিবেশ করেছে।
উদ্ভাবনী ডেটা সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানে বিনিয়োগ করুন
ডেটা আমাদের জানতে সহায়তা করে যে কে, কোথায়, কতদিন ,কীভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং এই ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটছে। এটি সত্য যে, কোনো পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য ছাড়াই শুধুমাত্র বয়স, লিঙ্গ এরকম তথ্য দিয়ে সংখ্যাতাত্তিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তাই এই বৈসাদৃশ্য দূর করতে উদ্ভাবনী তথ্য পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। ফেসবুকের সহযোগিতায় আইডিএমসি ভারত ও বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ফণী এবং জাপানে টাইফুন হাগিবিসের পরে বাস্তুচ্যুত হওয়া নিদর্শনসমূহের তথ্য সংগ্রহের জন্য এমন ডেটা ব্যবহার করেছিল। স্যাটেলাইট ইমেজ এবং কমিউনিটি ম্যাপিং এর মতো প্রযুক্তি ক্ষতিগ্রস্থ দুর্গম এলাকায় সহজে পৌঁছানোর জন্য উপযোগী মাধ্যম হতে পারে।
কীভাবে ধীর-সূত্রপাত ঘটনার প্রভাব মোকাবেলা করতে হয় শিখুন
খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং হিমবাহের বরফ গলে যাওয়া সবই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এবং পরিবেশের উপর এই তথাকথিত ধীর-সূত্রপাত ঘটনার প্রভাব আগত বছরগুলোতে আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সোমালিয়ায় ২০১৮ সালে খরার কারণে দুই লাখ ৪৯ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। খরার প্রথম প্রভাব হিসেবে দেখা দেয় জীবিকার অভাব, তারপর দরিদ্রতা সবশেষে সংঘাতের ফলস্বরূপ মানুষ স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। তাই চূড়ান্ত পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির আগে সে বিষয়ে যথাযথ প্রতিরোধ ও প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
বিদেশী মডেলগুলোর সম্ভাবতা যাচাই করুন
যেহেতু ‘বেশিরভাগ বিপর্যয় যেগুলো ঘটতে পারে তা এখনও ঘটেনি’। তাই কোথায় এবং কখন বিপর্যয় ঘটার আশংকা রয়েছে এবং কত লোকের ক্ষতি হতে পারে, তা জেনে রাখা জরুরি। ঝুঁকি মূল্যায়ণ এবং পূর্বাভাসের মডেলগুলি ভবিষ্যতের বাস্তুচ্যুতকরণের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে সহায়তা করতে পারে। এসব মডেলের স্থানীয়করণের ফলাফলের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, কোথায় অবকাঠামোকে আরো শক্তিশালী করা দরকার বা কোন অঞ্চলে বসতি স্থাপনের আর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। এই পূর্বাভাস মডেলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা চালিত আন্তঃসীমান্ত অভিবাসনের মিথের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রয়োজনীয় প্রমাণ সরবরাহ করতে পারবে।
সংবেদনশীল ভবিষ্যৎবাণীর সঙ্গে ডেটা এবং প্রমাণ দিয়ে লড়াই করুন
জলবায়ু বাস্তুচ্যুতির বিষয়টি জনসমক্ষে আলোচিত হলে এটিকে প্রায়শই ‘জলবায়ু শরণার্থী ’আকারে আলোচনা করা হয় এবং বলা হয়ে থাকে এরা পুরো ইউরোপীয় অঞ্চলকে ছাড়িয়ে যাবে। এর বিপরীতে, ডেটা এবং প্রমাণগুলো দেখায় যে বেশিরভাগ বাস্তুচ্যুতি অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে হয়ে থাকে, খুব কম লোকই রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে। সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ার ডিসকোর্সের আদলে তৈরি কিছু প্রতিবেদনে ‘প্রশ্নবিদ্ধ পদ্ধতি’ ব্যবহার করে প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, আসন্ন দশকে অবিশ্বাস্যরূপে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে। এই বিতর্কটিকে জোরালো করার জন্য বিদ্যমান পূর্বানুমানগুলোতে সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা কিংবা অযৌক্তিক উপায়ে ফলাফল তৈরি করা হচ্ছে কিনা সেসব যাচাই করা উচিত।
ঝুঁকি হ্রাসকরণের উপর জোর দিন
প্রতিনিয়তই বিপর্যয় ‘প্রাকৃতিক’ হিসেবে বিবেচিত হয়; বিপর্যয় সম্পর্কে এমন হিসাব নিকাশ তৈরি করা হয় যে, এটাকে প্রতিরোধ করা যায় না। ঝড়, অতিবৃষ্টি বা ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়া থেকে রোধ করা অবশ্য কঠিন। যাইহোক, তাদের প্রভাব প্রতিরোধ ও প্রশমিত করা না গেলেও পরিবেশগত সম্পদের অবক্ষয়কে তো সীমাবদ্ধ করা যায়। জমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীলদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদান ইত্যাদি ঝুঁকির হারকে কমাতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্বচ্ছ পদ্ধতিতে পরিকল্পিত স্থানান্তর ঝুঁকি নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সংঘাত ও সহিংসতার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ককে উপলব্ধি করুন
কখনও কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সংঘাত একীভূত হয়ে যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি সংঘাত ও সহিংসতা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে সহিংসতা ভূমি এবং অবকাঠামো ধ্বংস করে এবং জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুতির দিকে ঠেলে দেয়। তাই এই আন্তঃসম্পর্কিত অনুঘটকগুলোকে সনাক্ত করে কীভাবে কার্যকরভাবে সমাধান করা যায় তার উপায় খুঁজতে হবে।
স্থানীয় সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দিন
বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর মানবিক সহায়তায়, বাস্তুচ্যুতি প্রতিরোধে প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ডে প্রায়ই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হয়। তাদের পরামর্শ অবশ্যই মূল্যবান, কিন্তু স্থানীয় অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে কাজে লাগানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ পরিস্থিতির ভিন্নতার জন্য এক স্থানে যেটা কার্যকর, অন্য স্থানের জন্য তার কার্যকারিতা নাও থাকতে পারে। স্থানীয় প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন সিদ্ধান্ত স্থানীয় সম্প্রদায়ের বিশেষজ্ঞরাই কার্যকরভাবে নিতে পারেন।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার জন্য সোচ্চার হউন
কোনো কিছু পরিবর্তন করতে চাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হলো সেটিকে পরিবর্তন করে ফেলা। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া উপর্যুক্ত কোনো বিষয়েরই সমাধান করা সম্ভব নয়। যেহেতু দুর্যোগ এবং জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি বেশিরভাগ দেশগুলোর নিজেদের সীমানার মধ্যে ঘটে, তাই এটি মোকাবেলা করা প্রতিটি দেশের সরকারের প্রথম দায়িত্ব।
অনিশ্চয়তাকে স্বাগত জানান এবং নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নিন
বিগত বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া অধিক সংখ্যক বাস্তুচ্যুতির ঘটনা প্রকাশ করছে যে বিদ্যমান ঝুঁকিগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ঘটে চলেছে। ভাগ্যক্রমে, আমরা জানি যে কয়েকটি কৌশল রয়েছে, যা এই ঝুঁকিগুলো হ্রাস করতে এবং আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে। এর মধ্যে অনেকগুলো কৌশল যেমন, পূর্বাভাস মডেলগুলো ব্যবহার করা, স্থানীয় সম্প্রদায়কে যুক্ত করার মতো বিষয়সমূহ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আমাদের চির-পরিবর্তিত জলবায়ু এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। তাই এই পরিবর্তনকে একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ হিসেবে দেখুন এবং এই অনিশ্চয়তাকে গ্রহণ করুন।
আইডিএমসি অবলম্বনে ভাষান্তর করেছেন মুর্শিদা টুম্পা