ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ অভিযান’ এর কবল থেকে বাঁচতে যেসব শরণার্থী জার্মানিতে আসছে, তাদের মধ্যে থাকা অনেক অল্প বয়সী নারী মানব পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ছে বলে জানিয়েছে জার্মানিতে শরণার্থীদের সহায়তায় নিয়োজিত স্থানীয় পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা
যুদ্ধ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা ইউরোপের যে দেশগুলোতে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছে, সেগুলোর মধ্যে জার্মানি অন্যতম। জার্মানির পুলিশ থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবকরা বিমর্ষ এ সাধারণ মানুষদের স্বাগত জানাতে উদারচিত্তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম পরিস্থিতির মধ্যে শঙ্কার খবর হলো, চরম অসহায়ত্বের শিকার এসব সাধারণ মানুষদের, বিশেষ করে পরিবারহীন অল্প বয়সী নারীরা নানাভাবে মানব পাচারকারীদের দ্বারা হেনস্তার শিকার হচ্ছে।
বার্লিনের কেন্দ্রীয় স্টেশনে কর্মরত স্থানীয় পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক উভয় পক্ষই নিশ্চিত করে বলছে, খারাপ উদ্দেশ্য ব্যবহারের জন্য কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ইউক্রেনীয় নারী ও শিশুদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।
তাদের ভাষ্য, স্টেশনে আগত হাজার হাজার শরণার্থীদের ভিড়ের মধ্যে অনেক ব্যক্তি নারীদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়া বা থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।
যদিও ফেডারেল পুলিশের মুখপাত্র ডয়েচেভেলেকে বলেছেন যে, ভাগ্যবশত ‘তারা [খারাপ উদ্দেশ্যে যারা তৎপর] এতটাই সুস্পষ্ট যে, তারা অবিলম্বে স্বেচ্ছাসেবক ও আমাদের নিজস্ব কর্মীদের নজরদারির মধ্যে আছে।’ এসময় তিনি আরো যোগ করে বলেন, এসময় ‘হয়রানির মাত্রা নিম্মমুখী ছিল এবং তাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই যে, যৌন নিপীড়ন, অপহরণ বা মানব পাচারের কোনো অপরাধ ঘটেছে।
‘একজন নারী আমাদের কাছে এসেছিলেন, যার সঙ্গে এমনটি ঘটেছিল। তার ভাষ্যমতে, একজন লোক তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিল। ‘আমাদের তাকে স্টেশন থেকে সরিয়ে দিতে হয়েছিল। এ মুহূর্তে আমাদের প্রচুর মানুষ রয়েছে, যারা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সাহায্য করতে চায়। অন্যদিকে কিছু লোক থাকেই যারা কিনা এই রকম পরিস্থিতিকে তাদের নিজস্ব চরিতার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে থাকে ।’
স্বেচ্ছাসেবকরা কড়া নজর রাখছে
স্টেশনে দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয় মাধ্যমগুলোকে বলেছেন যে, সন্দেহভাজন পাচারকারীদের অনুসরণ করতে হবে যতক্ষণ না তারা নিঃসঙ্গ নারীদের অনুসরণ করা থামিয়ে দেয়। অন্যদিকে ইউক্রেনীয়, রাশিয়ান ও ইংরেজিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে সতর্কবার্তা পোস্ট করছে পুলিশ। শরণার্থী দলের সঙ্গে স্টেশনে সকালের বৈঠকের সময় শ্রমিকদেরও এখন এ বিষয় সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে।
মনিকা সিসেক-ইভান্স বলেন, ‘যারা ইউক্রেনীয় নারী বা পরিবারে আশ্রয় দেয়, তাদের নিবন্ধন করলে ভালো হবে। ‘দুভার্গ্যবশত এখানে কিছুসংখ্যক লোক অন্যদের শোষণ করার চেষ্টাও করছে। শুধু পুরুষ নয়, যেসব নারী এসব আশ্রয়প্রার্থীদের কাছে যায় তাদেরও অন্ধভাবে বিশ্বাস করা যাবে না।’
সিসেক ইভান্স ২০ বছর ধরে মানব পাচারের শিকারদের জন্য পরিচালিত একটি কাউন্সেলিং সেন্টার ‘জাদউইগা’ চালাচ্ছেন। তিনি যাদের সঙ্গে দেখা করেন, তাদের অনেকেই পূর্ব ইউরোপের নারী। তার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ট্রেন স্টেশনগুলিতে পোস্ট করার জন্য একটি ফ্লাইয়ার নিয়ে কাজ করছে।
তারা ইউক্রেনীয় ভাষায় নিম্নলিখিত পরামর্শসহ লেখা প্রচার করছে: ‘আপনার পাসপোর্টটি ফেলে যাবেন না। আপনার ফোনটি সবসময় আপনার কাছে রাখুন। গাড়িতে ওঠার আগে গাড়ির নাম্বার প্লেটের একটি ছবি তুলে নিন। আপনাকে যখন অ্যাপার্টমেন্ট বা রুম অফার করা হয় তখন আইডি দেখাতে বলুন এবং নাম এবং ঠিকানা লিখে রাখুন। কেউ যদি আপনাকে দ্রæত অনেক টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে সতর্ক থাকুন।’
পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার হুমকি
এখন পর্যন্ত বার্লিনের কেন্দ্রীয় স্টেশনে ইউক্রেনীয় নারীদের মানব পাচারের শিকার প্রসঙ্গে তেমন কোনো তথ্য উপাত্ত জার্মানির প্রতিষ্ঠান বা ইউরোপীয় উৎস থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু হুসকে মাউ নামের একজন লেখক ও যৌন কর্মীদের নিয়ে কাজ করা একজন আইনজীবী বলেছেন এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিৎ। ‘প্রতিদিন ১ লাখ ২০ হাজার পুরষ এখানে পতিতাদের কাছে যায়। জার্মানি ইইউব্যাপী মানব পাচারের জন্য এক নম্বর গন্তব্য দেশ।’ তিনি বলেন পাচারকারী এবং দালালরা ‘জানেন যে, শরণার্থীরা তাদের প্রচুর অর্থ কামানোর মাধ্যম হতে পারে।’
শরণার্থীদের সুরক্ষায় জার্মান সরকারের নতুন ঘোষণা
সম্প্রতি জার্মানির সরকার ইউক্রেন থেকে আসার শরণার্থীদের সুরক্ষা আরো বেশি করে মনোযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যাতে যুদ্ধ থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা এসব আশ্রয়প্রার্থী নিরাপদে দেশটিতে অবস্থান করতে পারে।
জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন অবকাশকালীন প্রতিষ্ঠান ভাড়া বিষয়ক সংস্থা ‘এয়ারবিএনবি’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, নতুন আগতদের জন্য জার্মানি জুড়ে ৩ লাখ ব্যক্তিগত বাসস্থান নির্মাণ করা হবে।
সূত্র: ডয়েচেভেলে ইংরেজি থেকে অনূদিত