শুক্রবার, 19 এপ্রিল, 2024

‘নদী ভাঙতি ভাঙতি আমাদের জীবনও ভাঙ্গি গেছে’

ফজরের আজানের পর বাবা সেই যে মাঠে যান আর ফেরেন সন্ধ্যায়। সারাদিন খাঁটুনির পর মুখখানি তার ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা আর বিষন্নতায় ছেঁয়ে যায়। অনেক দিন হলো উবে গেছে বাবার মুখের হাসি-এত কষ্ট করার পরও যে ধান-সব্জির ভালো ফলন হয় না! ঠিকঠাক চাষ না করতে পেরে দেনায় দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ছিলেন বাবা।

একদিন ছোট্ট আসমা তার বাবার কাছ থেকে জানতে পারে, নোনা পানি একটু একটু করে গ্রাস করে ফেলছে ফসলের ক্ষেত, পুকুরসহ সবুজে আচ্ছাদিত তাদের পুরো গ্রাম। উপায় না পেয়ে প্রতিবেশী অনেকের মতো আসমার বাবাও একদিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন, কয়রায় নিজ বসতবাড়ি ছেড়ে দাকোপের চালনায় চলে আসার।

শুরু হয় আদি বসতবাড়ি ছেড়ে এসে নতুন এক জীবনের, সেই জীবনের নাম উদ্বাস্তু জীবন। নিজেদের কোনো জমিজমা না থাকায় পশুর নদীর পাড়ে খুপরি ঘর বানিয়ে সেখানেই শুরু হয় আসমাদের নতুন জীবন।

খুলনার দাকোপ উপজেলার চালনায় ঠাঁই হয়েছে আসমার পরিবারের। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অভিবাসীর সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন আজ থেকে প্রায় চার দশক আগের সেই ছোট্ট আসমা। এখন তার বয়স চল্লিশের বেশি; তার নাম এখন আসমা বেগম। আসমা বেগমের মুখে যেন তার বাবারই প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। যেন তিনিও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা আর বিষন্নতায় ঠাসা একখানি মলিন মুখ।

‘নোনা  পানির হাততে (হাত থেকে) বাঁচতি, দুমুঠো ভাতের জন্যি আব্বার সাথে ছোটকালে এই চালনায় আইসিলাম। কিন্তু গরীবের তো সুখ টেহে (টেকে) না। আমাগে কপালেও জুটলো না সেই সুখ। আব্বা ঘর বান্দার বছর খানিকের মধ্যি নদীতে চইলে গেলো আমাগে ঘর’-বলছিলেন আসমা বেগম।

প্রতি বছর ঝড় তুফানের সময় আসলি খালি ভাবি, কোন দিক যাবো। আর ঝড় থেমে গেলি ভাবি, কী করবো, কী খাবো, কীভাবে ঘর বানাবো।’

মূলত নোনা পানির গ্রাসে আদি বসত ছেড়ে চলে আসার পর আসমা বেগমদের পরিবার নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। এবার সেখান থেকে খানিকটা দূরে নদীর পাড়ে আবারও ঘর বানান তার বাবা, একসময় নদী সেই ঘরও গ্রাস করে। ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পরাজিত হয়ে এভাবেই একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন আসমা বেগমের বাবা।

রিলে রেসের মতো এবার শুরু হয় আসমা বেগমের সংগ্রামের পালা। আসমার বিয়ে হয়, পৃথিবীর মুখ দেখে তার সন্তানেরা; জীবনের অনেকগুলো পরিবর্তন আসে। কিন্তু অভাব আর নদী ভাঙন আসমার সঙ্গী হয়ে থাকে বারো মাস। এভাবেই কেটে যায় আসমার চার দশকের বেশি সময়ের জীবন।

এরই মাঝে আসমার ঘর নদীতে ভেসে গেছে কমপক্ষে ছয়বার। অভিবাসীকে আসমা বলেন ‘আইলা গেল, সিডর গেল, আম্ফান গেল… এই নদীডা আগে ছোটো ছেলো, এখন নদীডা ভাঙতি ভাঙতি অনেক বড় হয়ে গেছে।’

তিনি জানান, নদীর পাড়ে খাস জমি যতটুকু ছিল তার সবটুকুই ভেসে গেছে। উপায় না পেয়ে এখন আসমা ও তার পরিবার আকুতি জানিয়ে সংলগ্ন মালিকানা জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার দুঃশ্চিন্তা আসছে ঝড়-বন্যার মৌসুমে আশ্রয়ের এ জায়গাটুকুও কি নদী ভাঙনের মুখে পড়বে?

‘বেশি ভাঙে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে গিয়ে। সেই সময় পানি বাড়ে, ঝড় তুবোন (তুফান) বেশি হয়। ভয় বেশি লাগতিছে আমাগে, আবারা ঝড় আসতিছে, কোন জাগা যাবো। যখন ঝড় আসে তহন সাইক্লোন সেন্টারতে লোক আইসে আমাগে নিয়ে যায়। এর আগে ব্যবস্থা নিলি তো আমাগে এই ধহল পোহাতি হয় না’-জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, দুঃখ আর বিরক্তিতে ভর করা মুখে কথাগুলো বলে চলেন আসমা।

ততক্ষণে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তারাও সবাই আসমার মতো নদী ভাঙনের শিকার। সবারই গড়ে ছয়-সাতবার করে ঘরবাড়ি নদীতে গেছে। ষাটোর্ধ তাসলিমা, রুস্তম, মাঝবয়সী তানিয়া, ছয় বছরের রাবেয়া, তিন বছরের আলিফ-মোটামুটি সব প্রজন্মেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা । তাদের সবারই গল্পের সঙ্গে আসমার গল্পটা একই সুতায় বাধা, তারাও সবাই নদীভাঙনের শিকার।

২৫ বছর বয়সী তানিয়ার সঙ্গে এ পর্যায়ে কথা হয় অভিবাসীর। তানিয়া জানান, দুই বছর আগে ভাঙনে তার বসতভিটা নদীতে চলে যায়। এরপর নদীপাড়ের খাসজমিতে নতুন করে একটি ঘর বানান তিনি ও তার স্বামী। কিন্তু তাতেও কি তার দুঃশ্চিন্তা শেষ হয়েছে? গত সেপ্টেম্বরে হঠাৎ একদিন তানিয়া আঁচ করেন, তার এই ঘরও বুঝি নদীতে যাচ্ছে।

‘আমার স্বামী ভ্যান চালায়। ফিরে আসার পর তাকে বললাম, এত বছর আমার বারান্দা তো ফাঁটেনি, এখন ফাটতিছে কেনো? এখন আমি ঘাতুই (সজোরে ধাক্কা দেয়া) দিলাম। দেয়ার পরও ফাঁটল আস্তে আস্তে বাড়তি লাগলো।’

কথা চালিয়ে যান তানিয়া। ‘একদিন রান্না করার সময় দেখতে পাই, ঘরের সব জায়গায় ফাঁটল ধরিছে। আমার স্বামীকে বললাম, দ্যাখো, ভাঙন লাগিছে মনে হয়। দুই দিন পর আরো বেশি ফাটল ধরা করলো। রাতের বেলায় ঘরের মধ্যি কট কট শব্দ হতো। পরের দিন এক পাশে ঘর হেলে পড়লো। জিনিসপত্র বের করার চেষ্টা করলাম। জিনিসপত্র বাইর করতি করতি ঘরে ঢোকারও আর লাইন নেই। উপায় না পেয়ে বাইর হয়ে গেলাম। চোখের সামনে দেখলাম, আমার ঘর নদীতে তলায় গেছে।’

কথাগুলো বলার সময় আসমার দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ছিল। একপর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘আমার বিয়ে হয়াত্তে শুরু কইরে ধাক্কা খাতি খাতি আজ এই পর্যন্ত। নদী ভাঙতি ভাঙতি আমাদের জীবনও ভাঙ্গি গেছে। প্রতি বছর ঝড় তুফানের সময় আসলি খালি ভাবি, কোন দিক যাবো। আর ঝড় থেমে গেলি ভাবি, কী করবো, কী খাবো, কীভাবে ঘর বানাবো।’

নদী ভাঙনের শিকার হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মানসিক ভারসম্য হারিয়ে অনেকেই বিপর্যস্তকর জীবন পার করে চলেছেন। এদের একজন সালেহা। পঞ্চাষোর্ধ মানসিক ভারসম্যহীন এই নারী  ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হাসতে থাকেন সারাক্ষণ, কথা যতটুকু বলেন তাও গুছিয়ে বলতে পারেন না।

তার হয়ে প্রতিবেশিরা জানালেন, নলিয়ান থেকে খুব ছোটোবেলায় চালনা বাজারে এসেছিলেন এই নারী। তার বাবার গেটম্যানের কাজ করতেন। এখানে যতগুলো পরিবারের বসবাস সেগুলোর মধ্যে এই নারীরই ঘর সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে, কমপক্ষে ২০ বার। এখন তার অন্নসংস্থানই দুরুহ হয়ে উঠছে।

দাকোপ উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে খুবই করুণ পরিস্থিতির মধ্যে দিনানিপাত করছেন। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ভাষ্য, নদীর প্রবল জোয়ারের চাপে প্রায়ই বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। কিছু স্থানে বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে পুরো পোল্ডার এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখনই স্থায়ী সমাধান না করা হলে একটু একটু করে পুরো অঞ্চলই বিলীন হয়ে যাবে।

বারবার নদী ভাঙনের শিকার আসমা বেগমের রোজগারের ঠিক নেই। যখন যে কাজ পান, তাই করেন। কখনো মাছ ধরেন, কখনো মজুর দেন, কখনো বা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন। আসমা বেগমের তিন মেয়ে এক ছেলে। এর মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।

অভিবাসীর সঙ্গে কথপোকথনের মধ্যেই খবর পেয়েছেন, সিজারের মাধ্যমে তার মেয়ে সন্তান প্রসব করেছেন। তাই তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মেয়ে আর নাতিকে দেখতে যাবেন বলে। যদিও এত বড় একটা খুশির খবরে তার মুখে এতটুকু হাসি নেই। কারণ খরচবাবদ হাসপাতালকে অনেকগুলো টাকা দিতে হবে। কিন্তু আসমা বেগমের হাত যে একেবারেই শূন্য!

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
97SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা