
প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে আমরা প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই ডিজিটাল মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল-হোক তা যোগাযোগ, অর্থনৈতিক লেনদেন, কিংবা প্রশাসনিক কর্মের জন্য। প্রবাসী শ্রমিকরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। পরিবার পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ, রেমিট্যান্স প্রেরণ কিংবা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আদান-প্রদানের (বিশেষ করে ভিসা, পাসপোর্ট ও ওয়ার্ক পারমিট সংক্রান্ত) জন্য তারা ব্যবহার করে থাকেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনস।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ইমো; এরপর আসে মেসেঞ্জের, ভাইবার ও হোয়াটস্অ্যাপ। অন্যসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বা মেসেঞ্জিং অ্যাপের তুলনায় ইমোতে কম ব্যান্ডউইথ লাগে অর্থাৎ স্বল্প ইন্টারনেট গতিতেও ইমো ব্যবহার করা যায়। সেই সঙ্গে এই অ্যাপটি একাধিক ডিভাইসে ব্যবহার করা যায়। এ কারণে অ্যাপটি প্রবাসীরা গ্রামেগঞ্জে অবস্থানরত তাদের তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বেশি ব্যবহার করে থাকেন।
আমাদের দেশ হতে স্বল্পদক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক বেশি বিদেশে অভিবাসন করে থাকে, যাদের অধিকাংশ স্বল্পশিক্ষিত ও বিদেশে একাকী থাকেন এবং ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের সতর্কতা সম্পর্কে খুব বেশি একটা জ্ঞান তাদের থাকে না বললেই চলে।
আমাদের দেশ হতে স্বল্পদক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক বেশি বিদেশে অভিবাসন করে থাকে, যাদের অধিকাংশ স্বল্পশিক্ষিত ও বিদেশে একাকী থাকেন এবং ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের সতর্কতা সম্পর্কে খুব বেশি একটা জ্ঞান তাদের থাকে না বললেই চলে। ফলে প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারক শ্রেণী সহজেই তাদেরকে লক্ষ্য করে ইমো একাউন্ট হ্যাক করে প্রতারণার জাল বিস্তার করে ও তাদের থেকে আদায় করে নেয় লক্ষ লক্ষ টাকা।
সম্প্রতি, প্রবাসীদের সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণার হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। অনেক প্রবাসী শ্রমিক তাদের কষ্টার্জিত অর্থ লোকসান দিয়েছেন। যদিও প্রতিষ্ঠিত নয়, কিন্তু বিভিন্ন সূত্র অনুসারে ধারণা করা যায়, প্রায় কয়েক কোটি ডলার প্রবাসী শ্রমিক প্রতিবছর ডিজিটাল প্রতারণার কারণে খুইয়েছেন।

সিঙ্গাপুরের জাতীয় দৈনিক স্ট্রেইট টাইমস এর মতে, শুধু সিঙ্গাপুরে ২০১৭ সালের তুলনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছদ্মবেশী প্রতারকদের দৌরাত্ম্য ৯ গুণ বেড়েছে এবং ২০১৯ সালে অর্থ-সংক্রান্ত প্রতারণা বেড়েছে ৪৩ গুণ; যার ভুক্তভোগী হচ্ছে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসী শ্রমিকরা। ক্যাসপারস্কি সিকিউরিটি সলিউশনসের তথ্যমতে, বিগত ২০২২ সালে কুয়েতে কয়েক হাজার ইন্টারেট ব্যবহারকারী (যার সিংহভাগ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিক) ফিশিং বা ভুয়া মেসেজের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
প্রতারণার ধরণ: ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল ফোনে প্রতারকরা নানা কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। এতে নিঃস্ব হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রবাসী শ্রমিকরা যেসকল ভাবে প্রতারিত হচ্ছে তা হলো:

১. ফোন কল, মেসেজ ও ইমেইল: সাধারণত প্রতারক চক্র প্রবাসীদের ব্যাংকের ডাটা আপডেট করতে কল করে ব্যাংকের ও ক্রেডিট, ডেবিট কার্ডের যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে । আবার কখনও বড় অঙ্কের লটারির প্রলোভন, বিকাশ বা মুঠোফোনে বড় পুরস্কার জেতা, অনলাইনে বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফা অর্জন ও ভাগ্য পরিবর্তন ইত্যাদি দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোবাইল ও ইমেইলে থাকা ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর অনেক তথ্য। অনেকে আবার মেসেজ ও ইমেইল দিয়ে লোভনীয় প্রস্তাব (যেমন বিদেশে মোটা বেতনের চাকুরী, বাড়িতে বিপদগ্রস্থ পরিবার, সহজে ভিসা প্রাপ্তি, বিনা পরীক্ষায় ও টিকা ছাড়া করোনা নেগেটিভ সনদ ও টিকা সনদ ইত্যাদি) দিয়ে অর্থ ও বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি ও তাদের পরিবার।
২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: দেশে থাকা পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকেন স্যোশাল মিডিয়া অ্যাপ ইমো, ম্যাসেঞ্জের বা হোয়াটস্যাপ। আর এই ইমো অ্যাপ হ্যাক করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এছাড়া অনেকে নারীদের দিয়ে প্রবাসীদের সঙ্গে ‘আন্তরিক’ সম্পর্ক স্থাপন করে ব্ল্যাকমেল করেও বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
অনেকে আবার প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতা দূর করতে দ্বারস্থ হন অর্থের বিনিময়ে ভিডিও কলে নারীদের সঙ্গে চ্যাটিংয়ে, যা একসময় পরিণত হয় নেশাতে ও প্রতিদিন তারা এর জন্য ব্যয় করেন ১-২ হাজার টাকা। এসব প্রতারক সাধারণত ৩০-৪০ বছর বয়সী প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের টার্গেট করে থাকে, যাদের সহজে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা যায়।
৩. অবৈধ বেটিং ও ক্রিপ্টো কারেন্সি অ্যাপস: সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অবৈধ জুয়া ও ক্রিপ্টো কারেন্সিতে বিনিয়োগের জন্য প্রবাসীদের প্রলোভিত করা হচ্ছে। অনেক প্রবাসীরাই প্রলোভনে পরে ও অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের আশায় এসব অনলাইন প্লাটফর্মে বিনিয়োগ করছেন ও প্রতারিত হচ্ছেন।
আরো পড়ুন: অভিবাসনে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও নিয়ন্ত্রণের কথকতা
প্রভাব কি? ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণার কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের অনেক ধরণের সমস্যাই হতে পারে- যদিও প্রধান সমস্যা হয় অর্থনৈতিক। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রতারণায় পরে খুয়ালে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত জীবনযাপনে প্রভাব পরে, তেমনি প্রভাব পরে দেশে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমানের উপরও।

প্রতারণার শিকার প্রবাসী শ্রমিকরা এ কারণে অনেক মানসিক চাপের ভিতর ও থাকেন। এর ফলে তাদের স্বাস্থ্যের ও অবনতি হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে তারা বিভিন্ন জটিল অসুখে ভুগেন। দেশে ফেলে আসা পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেয় এবং পারিবারিক কলহের সূত্রপাত হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যেসব মানুষ স্ক্যাম বা ভার্চুয়াল প্রতারণার শিকার হন, তাদের মধ্যে ৭০ ভাগই মামলা করতে চান না ও বিষয়টি গোপন রাখেন। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায় ও ভুক্তভোগী মানসিক চাপে পতিত হন।
করণীয় কি? সতর্কতা, সচেতনতা ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের উপরে শিক্ষা প্রদানই পারে এই ধরণের প্রতারণা হতে সুরক্ষা দিতে। প্রাক-বহির্গমন ওরিয়েন্টেশন বা বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণে এই বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের সচেতন করতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারকেও এই বিষয়ে সচেতন করতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন অনলাইন সাইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে অ্যাপ্লিকেশন বাছাই করতে হবে এবং ব্যক্তিগত তথ্য বিনিময়ের সময় সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কেও তাদের সচেতন করতে হবে।
লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী