‘অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের পেশাগত যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও তারা এখনো অযোগ্য পেশায় কাজ করছে’
অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ফেডারেল নির্বাচনে সম্প্রতি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন দাই লা নামের একজন শরণার্থী নারী। যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের শিকার হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থিঁতু হতে বাধ্য হয়েছিলেন। জীবনের কঠিন ও দুঃসহ সেই স্মৃতির ভার কাঁধে নিয়ে শরণার্থী হয়েও কীভাবে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের মন্ত্রী সফলতা ছিনিয়ে আনলেন সেই গল্পই এবার সংসদে দাঁড়িয়ে নিজের সবার সামনে প্রকাশ করেছেন দাই লা। গত সোমবার দাই লা সংসদে আবেগঘণ এক শুভেচ্ছা বক্তব্যে
গত মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লেবার পার্টির (সংক্ষেপে লেবার হিসেবে পরিচিত) প্রার্থী সাবেক সিনেটর ক্রিস্টিনা কেনেলিকে হারিয়ে জনাব দাই লা ছিনিয়ে আনেন ঐতিহাসিক জয়। এই জয়কে ঐতিহাসিক বলার কারণ হলো, ফাউলারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সিডনির আসনটিতে এর আগে সবসময় নিজেদের জয় ধরে রেখেছিলো লেবার পার্টি।
সংসদে বক্তব্য দেয়ার সময় দাই লার পড়নে ছিলো অস্ট্রেলিয়ান পতাকার ছাপ সমন্বিত একটি ঐতিহ্যবাহী ভিয়েতনামী পোশাক। এই উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি একদিকে যেমন দেশপ্রেম প্রকাশ করেছেন অন্যদিকে যে দেশটি তাকে ও পরিবারকে পরম মমতায় আগলে রেখেছে এবং সেই দেশের একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগিতা করেছে, সেই দেশের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
‘অস্ট্রেলিয়া, আপনি আমার মাকে, আমার পরিবারকে প্রসারিত হাতে স্বাগত জানিয়েছেন, আপনি আমাদের আরাম, খাবার এবং ঘুমের জন্য একটি উষ্ণ বিছানা দিয়েছেন’-আবেতাড়িত কণ্ঠে বলেন দাই লা। ‘অভিবাসনের এই গল্প আমাদের সবার। এই গল্প আমাদের এবং আমরা সবাই এটা প্রকাশ করতে পেরে গর্বিত হতে পারি’-যোগ করেন সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্য দাই লা।
ফাউলার এর আগে লেবার পার্টির জন্য একটি নিরাপদ ও নিশ্চিত আসন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। চলতি বছর লেবার এমপি ক্রিস হায়েস অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ১২ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে আসনটি নিজেদের করে রেখেছিলো দলটি।
‘প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে ফাউলারের জনতা এমন একজন প্রতিনিধি চেয়েছিলো, যিনি তাদের গোত্র থেকে এসেছেন এবং তারা যে ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতাগুলির মুখোমুখি হয়, তা যেন কখনোই তিনি ভুলে না যান… শুধু নির্বাচনের সময় নয়, প্রতিদিন’-বলেন দাই লা।
‘যদিও ফাউলারের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা একটি বিশেষ অধিকার, কারণ আমরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ নই। আমরা বিস্মৃত মানুষ, তারপরও আমরা অস্ট্রেলিয়ার মেরুদণ্ড’-জোর ভাষায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন দাই লা।
স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন দাই লা। যদিও তিনি সেই রোগ থেকে এখন মুক্ত। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ‘অসাধারণ’ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। ক্ষমতার মেয়াদ থাকাকালের মধ্যে তিনি তার আসনের ভোটারদের আরো পরিষেবার দেয়ার জন্য লড়াই করে যাবেন বলে জানিয়েছেন সংসদে।
ফাউলারে ১০ শতাংশ বেকারত্ব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি অস্ট্রেলিয়ার দক্ষতা ঘাটতি মোকাবিলায় স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ‘অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের পেশাগত যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও তারা এখনো অযোগ্য পেশায় কাজ করছে’- বলেন দাই লা। ‘আমাদের অবশ্যই তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতি জন্য দ্রুত পথ তৈরী করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। যাতে করে আমরা তাদের দক্ষতাকে আমাদের সমাজে প্রয়োগ করতে পারি।’
দাই লা সংবাদ মাধ্যম এবিসি’র বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন এবং এরও আগে ক্যাবরামাট্টার জন্য লিবারেল প্রার্থী হিসেবে এনএসডব্লিউ পার্লামেন্টে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন।
আরো পড়ুন: ভিয়েতনাম যুদ্ধ সমাপ্তির পর যেভাবে শরণার্থী সংকট তীব্রতর হয়েছে
২০১২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ফেয়ারফিল্ড সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই পদে তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। ‘আমি কখনোই রাজনীতিবিদ হতে চাইনি। আমি শুধু এমন মানুষদের উপযুক্ত সহযোগী হতে চাই যারা প্রধান প্রধান দলগুলির দ্বারা অবহেলিত এবং পরিত্যক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।’
প্রাক্তন দক্ষিণের রাজধানী সাইগনের পতনের পর মাত্র সাত বছর বয়সে মা ও বোনদের সঙ্গে কীভাবে নৌকায় করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম থেকে পালিয়ে এসেছিলেন সেই বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে ভুল করেননি দাই লা। তিনি জানান, তাদের নৌকাটি ঝড়ের মধ্যে পড়ে ডুবতে বসেছিলো।
বিদেশে একাধিক শরণার্থী শিবিরে থাকার পর দাই লা ও তার পরিবার শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিলো। ‘আমি সেই মুহূর্তটির কথা মনে করি যখন আমরা অস্ট্রেলিয়ায় শরণার্থী হিসেবে পুনর্বাসিত হওয়ার জন্য গৃহিত হয়েছিলাম… এবং আমরা কিংসফোর্ড স্মিথ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সময় কৃতজ্ঞতা এবং স্বাধীনতার অনুভূতি বোধ করেছিলাম। যখন আমরা অসীম সম্ভাবনার দিগন্তের পানে তাকিয়েছিলাম তখন আমরা আশায় পূর্ণ হয়েছিলাম।’
দাই লা ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রাক্তন রাজধানী সাইগুনে জন্মগ্রহণ করেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার সঙ্গে তার পরিবারের ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল যেদিন উত্তর ভিয়েতনাম সাইগুন দখল করে, সেদিন সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত একদল লোক দাই লা ও তার পরিবারের সদস্যদের বন্দরে এনে ফিলিপাইনের উদ্দেশ্যে একটি নৌকায় উঠিয়ে দেয়। তার পরিবারকে বলা হয়েছিলো, তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হবে এবং পরবর্তীতে তার বাবা তাদের সঙ্গে যোগ দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো কথাই আর রাখা হয়নি। এরপর ফিলিপাইনের একটি শরণার্থী শিবিরে তিন বছর থাকতে হয় তাদের। এরপর নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ঠাঁই হয় দাই লা ও তার পরিবারের।
সূত্র: এএফআর