মঙ্গলবার, 22 অক্টোবর, 2024

পিরিয়ডের সময় শুকনো গোবর ব্যবহার করছে অভিবাসী নারীরা!

পিরিয়ড বা ঋতুচক্রের সময় নারীদের ব্যবহার্য পণ্যের মূল্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সম্ভবত বর্ধিত এই খরচ মেটাতে সবচেয়ে বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিবাসী নারীদের। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যুক্তরাজ্য, লেবানন, উগান্ডা, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অভিবাসী নারীরা এই পরিস্থিতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত তিক্ত লড়াই করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের চিত্রও অনেকটা একইরকম। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের শিকার নারীদের বেলায় এমন ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। এখানকার নারীরাও পিরিয়ড পণ্যের চড়া মূল্যের কারণে স্বাস্থ্যকর প্যাডের পরিবর্তে টয়লেট টিস্যু এবং পুরনো কাপড় ব্যবহার করতে বাধ্য হয়।

শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্য যে, সারা বিশ্বে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রায় নানাবিধ সংকট দেখা দিচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট এতটা চরমে পৌঁছেছে যে , পিরিয়ডের সময় অভিবাসী নারীদের অনেকে গরুর গোবর এবং পুরনো চাদরকে স্যানিটারি প্যাড হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।

উত্তর উগান্ডার শরণার্থী শিবির; যেখানে প্রধানত সুদান থেকে আসা কয়েক হাজার শরণার্থী বসবাস করে। অ্যাকশনএইড সেখানকার শরণার্থী নারীদের ঋতুচক্রের সময় স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কথা বলেছে। সেখানকার নারীদের থেকে প্রতিষ্ঠানটি জানতে পেরেছে- ঋতুচক্র চলাকালে নারীরা কাগজ, কম্বল এবং পশুর বর্জ্য জাতীয় কিছু উপকরণ ব্যবহার করে থাকে। অ্যাকশনএইড সতর্ক করে জানিয়েছে, ঋতুচক্র চলাকালে সুবিধা দেয়ার কথা বলে অনেকেই অর্থের বিনিময়ে যৌন সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

আরো পড়ুন:

জলবায়ু পরিবর্তন নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে

অ্যাকশনএইড বলছে, ঋতুচক্র চলাকালীন অনেক মেয়ে পর্যাপ্ত স্যানিটারি পণ্যের সুবিধা না থাকায় স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। সংস্থাটির মতামত, এতে করে তাদের বাল্যবিবাহ ও প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। স্যানিটারি পণ্যের মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাতব্য সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, ইউক্রেনের যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত জীবনযাত্রার সংকট দারিদ্র্যকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

‘কেউ কেউ টয়লেট পেপার এবং বইয়ের কাগজ ব্যবহার করেন’

২৫ বছর বয়সী রাজিয়া ইয়াজিদ উগান্ডার শরণার্থী শিবিরের নারী ও মেয়েদের ঋতুচক্র বিষয়ে নানাভাবে সহায়তা করছেন। তিনি তাদের পুনরায় ব্যবহারযোগ্য প্যাড তৈরি করতে শেখাচ্ছেন এবং নারীর অধিকার ও পরিবার পরিকল্পনার উপর গুরুত্ব দিয়ে নানা কর্মশালায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

ইয়াজিদ বলেন, ‘শরণার্থী শিবিরে বেশিরভাগ নারী নানাবিধ চ্যালেঞ্জ সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের প্যাড এবং সাবানের মতো প্রচুর স্যানিটারি উপকরণের অভাব রয়েছে। সেখানে গেলে দেখা যাবে; বেশিরভাগ নারীরা পর্যাপ্ত স্যানিটারি প্যাড না থাকায় শুকনো গোবর ব্যবহার করছে। গোবরকে তারা প্যাডের আকারে শুকিয়ে নিচ্ছে। যাতে তারা ঋতুচক্রের সময়টা কোনোভাবে পার করতে পারে। কিছু নারী এবং মেয়েরা পাতা ব্যবহার করে। কেউ কেউ টয়লেট পেপার ব্যবহার করেন। আবার কেউ কেউ কাগজের বই ব্যবহার করে থাকে।’

তিনি এও বলেন, কিরিয়ানদোন্দোর শরণার্থী শিবিরের অধিকাংশ মেয়েই তাদের ঋতুচক্র চলাকালীন সাত দিন পর্যন্ত স্কুলে যায় না; জামা-কাপড়ে রক্তের দাগ লাগবে এই ভয়ে। কারণ অনেকইে এ নিয়ে উপহাস করে থাকে।

লেবানন, মায়ানমার, হাইতি, দ্য ডিআরসি এবং জিম্বাবুয়ে- এই পাঁচটি দেশে বাজার ব্যবসায়ী এবং সম্প্রদায়ের সদস্যদের জরিপ করে দেখা গেছে, ‘এই অঞ্চলগুলো জলবায়ু সংকট, মানবিক অবস্থা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অশান্তি দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত।’ দাতব্য সংস্থাটি দেখেছে যে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভোক্তাদের জন্য স্যানিটারি পণ্যের দাম ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।

জিম্বাবুয়ের কিছু অঞ্চলে পণ্যের দাম ১৭০ শতাংশ, হাইতির পেটিট গোভ এলাকায় ১৫০ শতাংশ এবং লেবাননের বেকা জেলার বালবেক এলাকায় ১৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির পেয়েছে। আবার কিছু জায়গায় এই সংখ্যাটি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এখানে পণ্য এখনও প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আরো পড়ুন:

শরণার্থী নারীদের ধানচাষে বদলে গেছে গোটা একটি রাজ্য

‘আমি শেষ পর্যন্ত স্কুলে যাচ্ছি না’

১৯ বছর বয়সী এলিজাবেথ তার মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গে উগান্ডার ইভেম্পি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন। ১৩ বছর বয়সে তার ঋতুচক্র শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘ওই বয়সে আমি ঋতুচক্র সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। প্রথমবার যখন আমার ঋতুচক্র শুরু হয় তখন আমি স্কুলে ছিলাম। এটা দেখার পর আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে বাড়িতে চলে এসেছিলাম।’

তার মা তাকে কিছু প্যাড কিনে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে কিছু প্যাড পালকের তৈরি ছিল। কিন্তু সেগুলি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা তিনি জানতেন না। যখন পর্যাপ্ত স্যানিটারি প্যাড থাকে না, তখন এলিজাবেথ স্কুলে যেতেন না। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে প্রতি মাসে পর্যাপ্ত প্যাড থাকে না, কারণ ওতো সামর্থ্য আমাদের নেই। ফলে আমি স্কুলে যাই না। আমার মা এসে আমাকে জিজ্ঞাসা না করা পর্যন্ত আমি কেবল ঘরের ভেতরেই থাকি। যদি আমার কাছে টাকা থাকে তখন কিছু প্যাড কিনি, নাহলে ঋতুচক্র শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাই না।’

এখন তিনি কমিউনিটি ট্রান্সফরমেশন এজেন্ডা (সিওটিএ) এর পরিচালিত কর্মশালায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একটি কমিউনিটি-ভিত্তিক এবং অ্যাকশনএইড-এর নারী-নেতৃত্বাধীন অংশীদার। এবং ক্যাম্পের অন্যান্য মেয়েদের এ কাজে সমর্থন করেন; যাদেরকে তিনি ‘ছোট বোন’ বলে সম্বোধন করেন।

‘কর্মশালায় শেখানো হয়েছে কীভাবে পুনঃব্যবহারযোগ্য প্যাড তৈরি করতে হয়। এছাড়াও এর প্রভাব, গুরুত্ব এমনকি কীভাবে স্বাভাবিকভাবে ঋতুচক্র পরিচালনা করা যায়, সেসব প্রশিক্ষণও এখানে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই আমি অন্য মেয়েদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। এবং আমি বিশ্বাস করি যে, এমন কাজ আমি আরো চালিয়ে যেতে পারব।’

ডিআরসি-তে কিছু মেয়ে বলেছে যে, তারা আর স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে না। বরং তারা তোয়ালে ব্যবহার করে। এবং অনেকেই ঋতুচক্র চলাকালে স্কুল যায় না। জিম্বাবুয়েতে অ্যাকশনএইড দেখেছে যে, পিরিয়ড পণ্যগুলি প্রায়শই দান করা হয় সেখানে। আবার কেউ কেউ বাড়িতে তৈরি স্যানিটারি পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহ দিয়ে থাকে। অথচ লেবাননের দোকানদাররা বাড়তি খরচের ফলে নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করেছে।

আরো পড়ুন:

পশ্চিমা দেশে যাওয়ার পরই কেনো এত সিরিয়ান নারী তালাকপ্রাপ্ত হন ?

‘অধিকাংশ নারী তাদের খাবারের কিছু অংশ বিক্রি করতে বাধ্য হয়’

উগান্ডার ইমভেপি শরণার্থী শিবিরের ২৮ বছর বয়সী কমিউনিটি কর্মী জুলিয়েট তুমসওয়েসিগিয়ে বলেছেন যে, নারী পিরিয়ড পণ্য কেনার জন্য খাবার বিক্রি করছেন। ‘ইমভেপির কিছু স্কুলে মেয়েদের প্যাড পরিবর্তন করার জন্য কোনো ব্যক্তিগত টয়লেট নেই। আবার অনেক স্কুলে ছাত্রদের মধ্যে পিরিয়ড সম্পর্কে সচেতনতার অভাবও রয়েছে। ফলে যখন মেয়েদের পিরিয়ড হয়, তখন তাদের সমর্থন করার পরিবর্তে তাদের নিয়ে উপহাস করে থাকে। এতে করে মেয়েরা বিব্রত বোধ করে এবং এ সময় বাড়িতেই থাকতে চায়।

‘প্যাডের বদলে কিছু মেয়ে পুরানো পোশাকের টুকরো কিংবা কম্বলও ব্যবহার করে থাকে। বেশিরভাগ নারীই তাদের খাবারের কিছু অংশ বিক্রি করতে বাধ্য হয়, যাতে তারা নিজের এবং মেয়েদের জন্য প্যাড কিনতে পারে।’ সিওটিএ- এর হিসেব মতে, তিনি শিবিরে নারী ও মেয়েদের মধ্যে প্যাড বিতরণ করছেন এবং পিরিয়ড পরিচালনার বিষয়ে কর্মশালায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

গত বছর অ্যাকশনএইড-এর সঙ্গে মিলে সিওটিএ ১৬০টি স্যানিটারি কিট- পুনঃব্যবহারযোগ্য প্যাড, সাবান এবং অন্তর্বাসসহ একশো জন মেয়ে এবং ৬০ জন নারীকে বিতরণ করেছে। যুক্তরাজ্যেও এমনটাই করা হয়েছে। ইউগভ- এর একটি জরিপে দেখা গেছে যে, যুক্তরাজ্যের ১২ শতাংশ নারী গত ছয় মাসে পিরিয়ড পণ্য কিনতে হিমশিম খেয়েছেন। এর মধ্যে তিন চতুর্থাংশ বলেছে যে, তারা স্যানিটারি পণ্যের চেয়ে খাবারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

প্রায় অর্ধেক নারী বলেছেন যে, তারা অনেক বেশি সময় ধরে একই স্যানিটারি পণ্য ব্যবহার করেছেন। অন্যরা টিস্যু ব্যবহার করেছেন। আবার অন্তর্বাস দ্বিগুণবার ব্যবহার করছেন বা টয়লেট পেপারকে প্যাডে ভাঁজ করে ব্যবহার করছেন।

আরো পড়ুন:

বানিশান্তা:  বিস্মৃত নারীদের এক জনপদ

‘অনেক লোক স্যানিটারি পণ্যগুলির নাগাল পাচ্ছে না। যেটা বিশ^জুড়ে ঋতুচক্র হওয়া লক্ষ লক্ষ নারী এবং মেয়েদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়। অ্যাকশনএইড ইউকে-এর সিইও ফ্রান্সিস লংলি বলেছেন যে, ‘করোনার সময় লকডাউনের কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে। এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে গেছে; এটা কলঙ্ক এবং লজ্জার ব্যাপার।

‘পিরিয়ডের কলঙ্ক শুধু যুক্তরাজ্যের নারীদেরই বিব্রত, উদ্বিগ্ন এবং দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা তৈরি করে না; বিশ্বজুড়ে আমরা যে সব নারী ও মেয়ের সঙ্গে কাজ করি, তাদের অনেকেরই অস্বস্তিকর, অস্বাস্থ্যকর এবং অকার্যকর উপায়ে তাদের পিরিয়ড পরিচালনা করতে বাধ্য করা হয়। এটি তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকার দাবি তুলতে নিস্ক্রিয় করে দেয়।’

সূত্র: আইনিউজ

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা