বৈশ্বিক করোনা বিপর্যয়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগসহ নানাবিধ কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আজ সম্মুখীন হয়েছে অর্থনৈতিক অস্থিরতার। বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল বা রিজার্ভ কমে যাওয়াতে (যেখানে আগস্ট ২০২১ এ ছিল ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার তা নেমে আগস্ট ২০২২ এ দাঁড়ায় ৩৯ বিলিয়নে, সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক) দেশের অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে, বাড়ছে জ্বালানি ও ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম।
ডলারের তারল্য সংকট ও এর বিপরীতে টাকার মান নিম্নমুখী হওয়াতে আমদানি ও রপ্তানিতেও সংকট দেখা দিচ্ছে। আমদানি পণ্যের উপরে ভর্তুকি দিয়েও সংকট উত্তরণের পথ খুঁজতে সরকার আজ দিশেহারা। এই মুহূর্তে তাই প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (Foreign currency reserve), যার জন্য আজ একমাত্র ভরসা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। আশা করা যায়, করোনাকালীন সময়ের মতো প্রবাসীরা দেশে রেখে আসা স্বজনদের কষ্ট লাঘবের ও দেশের রেমিট্যান্সের রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পরিমান রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে পাঠিয়ে এই সংকট উত্তরণে সরকারকে সহায়তা করবে।
শ্রম অভিবাসন চিত্র:
শ্রম অভিবাসনের নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএমইটির (BMET) পরিসংখ্যান অনুসারে ১৯৭৬ হতে অদ্যাবধি প্রায় ১ কোটি ৪৩ লক্ষের অধিক মানুষ ১৭৪ টির বেশি দেশে কর্মসংস্থানের জন্য গিয়েছেন (সূত্র: বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০-২১, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়), যারা প্রায় ২৬৪.৭ বিলিয়ন ডলারের অধিক রেমিট্যান্স দেশে বৈধ চ্যানেলে পাঠিয়েছেন।
বিগত ২০২১ সালেও ৬ লক্ষ ১৭ হাজারের বেশি মানুষ বিদেশে গিয়েছেন বৈধভাবে, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমান ছিল ২২.০৭ বিলিয়ন ডলার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র মতে, বাংলাদেশে গড় পড়তায় প্রতি ১০ জনে একজন বিদেশে থাকেন, ফলে সহজেই অনুমান করা যায় যে এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্সের প্রভাব কতটুকু।
এ সব প্রবাসী শ্রমিকরা কেবল দেশে থাকা পরিবারের নিত্য খরচ ও দেখভালের জন্যই অর্থ পাঠান না, বরং তারা দেশে সম্পত্তি বৃদ্ধি, ব্যবসায় বিনিয়োগ, ও অন্য বন্ধু-স্বজনদের বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে থাকে।
একটি স্বচ্ছল প্রবাসীর পরিবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে উন্নতি করতে পারে রেমিট্যান্সের অর্থে। তাই তাদের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পায় অনেকাংশে। অনেক প্রবাসী শ্রমিক দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে পর্যাপ্ত কারিগরী দক্ষতা (technical skills) ও জ্ঞান (Advanced knowledge) নিয়েও আসেন- যা তারা দেশে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখেন।
বিদেশ ফেরত কর্মীদের বর্তমান অবস্থা:
করোনা অতিমারীর (COVID Pandemic) কারণে চাকুরী হারিয়ে পাঁচ লাখের অধিক অভিবাসী কর্মী বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন, যাদের বিশাল একটি অংশ এখনো বিদেশে পূর্ব কর্মে যোগদান করতে পারেনি বা যাওয়ার প্রক্রিয়ার ভিতরে রয়েছেন। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সূত্র মতে, ফেরত আসা কর্মীদের মধ্যে ৮৮.৭% নিজ পাসপোর্টে এসেছেন, কিন্তু প্রায় ১১.৩% আউট পাস ব্যবহার করে এসেছেন। এর অর্থ, ওই ১১.৩% শ্রমিকদের পুনরায় বিদেশ গমন, বা বর্তমান চাকুরীতে পুনঃযোগদান এক প্রকার অনিশ্চিত।
অন্যদিকে, ফেরত আসা কর্মীদের মধ্যে প্রায় ২৯% ছিলেন সৌদি আরব ফেরত, আর ২৭% এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত হতে। ২০২০ সালে আইওএমের (IOM) এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিদেশ ফেরত প্রায় ৭০% অভিবাসী কর্মীরাই দেশে এসে বেকার থাকেন।
২০২১ সালের জুনে ‘বমসা’ (BOMSA) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ফেরত আসা কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৮৭.৫% করোনাকালীন প্রদত্ত সরকারি কোনো আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার সহায়তা পাননি বা তার সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না। অনেক অভিবাসী কর্মী যদিও কিছু ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন বা বিভিন্ন উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হন, কিন্তু আশানুরূপ মুনাফা বা আয় না হওয়াতে বাধ্য হয়ে কোনো কিছু যাচাই বাছাই না করেই তারা পুনরায় বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যার ফলে অনেকেই আবার অনিয়মিত অভিবাসনের (irregular migration) পথেই পা বাড়ান।
সরকারি যত পদক্ষেপ:
বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীদের পুনর্বাসনের (rehabilitation) জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার ভিতর উল্লেখযোগ্য হলো: সরল সুদে পুনর্বাসন ঋণ (৪% সুদে), উদ্যোক্তা ঋণ (৮% সুদে), এক কালীন সহায়তা, ইত্যাদি। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড হতে প্রবাসীদের আইনগত সহায়তা, মৃত অভিবাসী কর্মীদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে সহায়তা, ও মৃত্যুজনিত আর্থিক সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা, প্রবাসী কর্মীর সন্তানদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান, প্রবাসীদের দক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ সনদ (RPL ) প্রদান ইত্যাদি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সচেতনতার অভাব, পর্যাপ্ত ডকুমেন্টের স্বল্পতা, আমলাতান্ত্রিক বা পরিষেবা প্রাপ্তির জটিলতার কারণে অনেক বিদেশ ফেরত কর্মীরাই এই সব সেবা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, পুনর্বাসন ঋণ বা উদ্যোক্তা ঋণ যতটুকু পরিমান দেয়া হচ্ছে – তা তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সূত্র মতে, ২০২২ এর ফেব্রুয়ারি অব্দি বিদেশ ফেরত কর্মীদের মাঝে রিইন্টিগ্রেশন বা পুনর্বাসন ঋণ বিতরণের হার ছিল মাত্র ২.৩%, যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। অন্যদিকে, তাদের সামাজিক (Social) ও মানসিক (psychological) পুনর্বাসনের দিকে সরকারি-বেসরকারি কোনো ক্ষেত্রেই নজর দেয়া হচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, ও ফিলিপাইনে বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের (Social and Economic reintegration) জন্য যেই ধরণের উদ্যোগ অনেক আগেই নেয়া হয়েছে, আমাদের দেশে এখনো সেই ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে যতটুকু করা হচ্ছে- তাও হচ্ছে বেশি-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগ ও অর্থায়নে।
পুনরেকত্রীকরণ (Reintegration) কি?
পুনরেকত্রীকরন (Reintegration) এমন একটি প্রক্রিয়া (Process) যার অর্থ হলো: বিদেশ ফেরত অভিবাসী শ্রমিকদের (Returnee migrant workers) দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে তাদের পরিবারে, চেনা পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এবং সমাজে মর্যাদার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সম্পৃক্ত হতে ও সর্বোপরি জীবিকা নির্বাহনে সহায়তা করা। তার মানে, পুনরেকত্রীকরণ শুধু অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথেই সম্পৃক্ত নয়, বরং তা অভিবাসী কর্মীর মনোস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত, ও রাজনৈতিক বিষয় গুলোর সাথেও সংশ্লিষ্ট। যদি দেখা যায়, একজন কর্মী বিদেশে গড়ে ৫-৭ বছর থাকেন এবং যখন তিনি দেশে আসেন- তখন তিনি পরিবারে, সমাজে, দেশের অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন দেখতে পান, যার সাথে তার সমন্বয় করে চলতে নানাবিধ সমস্যা হয়। ফলে তিনি সর্বদা একটি মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপের ভিতরে থাকেন- যা তার স্বাভাবিক পুনরেকত্রীকরণ বাধাগ্রস্থ করে। এছাড়া নির্যাতিত ও বিপদগ্রস্থ কর্মীরা যখন ফেরত আসেন- তাদের তাৎক্ষণিক সেবা বা সহায়তার বিষয়টি ও গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না, যা দীর্ঘ মেয়াদে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসন পুনর্বাসন বাধাগ্রস্থ করে।
পুনরেকত্রীকরণ (Types of reintegration) কয় ধরণের?
এক জন বিদেশফেরত অভিবাসী শ্রমিকদের (যা নারী – পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) সাধারণত তিন ধরণের পুনরেকত্রীকরণ প্রয়োজন হয়: মানসিক (Mental), সামাজিক (Social) ও অর্থনৈতিক (Economic)। সাধারণত দেখা যায়, একজন শ্রমিক যেই দেশে (destination country) দীর্ঘদিন জীবন যাপন করেন তিনি সেই দেশের রীতি-নীতি, আইন, সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুশাসন, টেকনোলজি, অর্থনৈতিক লেন-দেন সংক্রান্ত বিষয়গুলো দ্বারা প্রভাবিত হন বা অভ্যস্ত/অভিযোজিত (Adaptive) হয়ে যান। ফলে, দেশে এসে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তার বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে নির্যাতিত ও বিপদগ্রস্থ নারী কর্মীদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়।
মানসিকভাবে পুনরেকত্রীকরণ: র্দীঘদিন পরিবারের ও আত্মীয়-স্বজন হতে দূরে অবস্থান করার কারণে এক জন অভিবাসী মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে তার অনুপস্থিতিতে পরিবারের সকল সদস্য নিজেদের অন্য একটি জগৎ তৈরী করে। এর ফলে ওই অভিবাসী যখন ফেরত আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য, তখন পরিবারের অন্য সদস্যদের আচার-আচরণ, অভ্যাস ইত্যাদির সাথে তাল মিলাতে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হন। তার উপরে রয়েছে বিদেশে তার সময়ানুবর্তিতা, খাদ্যাভাস, সঞ্চয়ের মনোভাব, ধর্মীয় অনুশীলন ইত্যাদি- যা তিনি পরিবার ও সমাজের সাথে সামঞ্জস্য করতে পারেন না।
এছাড়াও তার প্রেরিত রেমিট্যান্সের সঠিক বিনিয়োগ ও সঞ্চয় নিয়েও সবার সাথে খোলাখুলি আলোচনাও অনেক সময় চ্যালেঞ্জিং হয়ে পরে। ফলে, ওই অভিবাসী নানা ধরণের মানসিক চাপে থাকেন। তাই বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীর পরিবারের ও সমাজের নানা পরিবর্তনের সাথে অভিযোজিত হয়ে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন মানসিক শক্তি ও ধৈর্য্য। তাই তাদের মানসিক পুনরেকত্রীকরণ প্রাথমিক পর্যায়ে খুবই জরুরি- যাতে সহায়তা করতে পারেন তার আপনজন ও বন্ধুরা। এর পাশাপাশি, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে বিদেশ ফেরত কর্মীদের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজন হতে পারে বিশেষ প্রশিক্ষণ, কাউন্সেলিং সেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
সামাজিকভাবে পুনরেকত্রীকরণ: আমাদের দেশে সাধারণত সামাজিকভাবে বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীর প্রতি ধারণা থাকে যে, তিনি দীর্ঘ প্রবাস জীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন ও সঞ্চয় করেছেন, এবং তিনি সহজেই যেকোনো ধরণের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন ও লোকসান হলেও তার ক্ষতি হবে না। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি সকলের অর্থনৈতিক চাহিদাও থাকে বেশি।
কিছু বিদেশ ফেরত কর্মীরা অভিযোগ করেন, তিনি বা তার পরিবার কোনো পণ্য কিনতে গেলে বা বাসা ভাড়া নিতে গেলে সকলেরই মনোভাব থাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দর বা মূল্য দাবি করার। অন্যদিকে, প্রতারিত বা সফল নয় এমন বিদেশ ফেরত কর্মীদের প্রতি সমাজের মনোভাব থাকে নেতিবাচক- যা তার স্বাভাবিক পুনরেকত্রীকরণ বাধাগ্রস্থ করে।
স্থানীয় সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা পেতেও তারা নানান ভাবে হয়রানির শিকার হন। তাই এই সকল বিদেশ ফেরত কর্মীদের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে ও তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও তাদের অর্থনৈতিক অবদানকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান।
অর্থনৈতিকভাবে পুনরেকত্রীকরণ: আমাদের দেশে সরকারিভাবে যত উদ্যোগ বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীদের পুনরেকত্রীকরনে, তার বেশিরভাগই অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকে। বিভিন্ন অভিবাসন ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অভিবাসী কর্মীরা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে দীঘ প্রবেশ জীবনের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের সঠিক বিনিয়োগ ও ব্যবহার নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকেন।
পরিবারের সদস্যরাও রেমিট্যান্সের সঠিক ও কার্যকরী ব্যবহার না করতে পারায় অনেক সময় পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও কলহের সৃষ্টি হয়- যার জন্য অভিবাসী কর্মী এক ধরণের মানসিক চাপে থাকেন। তার উপরে দেশে বিনিয়োগে নিরাপত্তাহীনতা ও পরিবেশ না থাকা, সঠিক পরামর্শ না পাওয়া, পর্যাপ্ত ঋণ প্রাপ্তিতে ও সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি- ইত্যাদি তো আছেই। যদিও সরকার বিগত ৪-৫ বছরে প্রবাসীদের দেশে অর্থ প্রেরণে প্রণোদনা দেয়াসহ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ ইত্যাদি উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, অপর্যাপ্ত উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের আয়োজন, প্রবাসীর পরিবারে সচেতনতার ঘাটতি ইত্যাদি কারণে তাদের অর্থনৈতিক পুনরেকত্রীকরণ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে ।
আরো পড়ুন: বৈশ্বিক দুর্যোগকালীন শ্রম অভিবাসনের সুযোগ বৃদ্ধিতে কিছু সুপারিশমালা
কার্যকর অর্থনৈতিক পুনরেকত্রীকরনের বাধা হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করেন প্রবাসীর পরিবারে আর্থিক শিক্ষার (Financial Literacy) ঘাটতিকে। রেমিট্যান্স নিয়ে সঠিক ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা না থাকায় অনেক শ্রমিকই এর সুফল পান না। অন্য দিকে, অপ্রত্যাশিতভাবে চাকুরিচ্যুত বা মেয়াদ পূর্ণ করার পূর্বেই নির্যাতিত হয়ে ফেরত আসা কর্মীরা অর্থনৈতিকভাবে পুনরেকত্রীকরনে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের পুনর্বাসন ঋণ ছাড়া আর কিছুই পান না, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের বিষয়টি না হয় বাদই দিলাম।
কার্যকর পুনরেকত্রীকরনে করণীয় কি?
- মানসিক বা মনস্ত্বাত্বিক পুনরেকত্রীকরনের জন্য তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সেলিং (ব্যক্তি বা দলভিত্তিক) সেবা প্রদান, এবং তার জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান, জেলাভিত্তিক ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- কাউন্সেলিং সেবা প্রদানে দক্ষ লোকবল যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরী করতে হবে।
- পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে অভিবাসীদের অবদানকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে তাদের স্বীকৃতি দিতে ও তাদের প্রতি সহনশীল আচরণে সচেতন করতে হবে।
- নির্যাতিত ও অসফল বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা ও সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে।
- প্রবাসীর পরিবারের ও বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য আর্থিক প্রশিক্ষণের (সঞ্চয় ও ঋণ ব্যবস্থাপনা, সঠিক বিনিয়োগ ও আর্থিক পরিকল্পনা তৈরী) ব্যবস্থা করতে হবে।
- বিদেশে কর্মকালীন সময়ে অর্জিত দক্ষতা ও জ্ঞান অনুসারে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে ও দক্ষতা সনদ দিতে হবে।
- দেশে তাদের সম্পদ, সক্ষমতা ও দক্ষতা অনুযায়ী আয়-বৃদ্ধিমূলক বিষয়বস্তুর উপরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কারিগরি প্রশিক্ষণে কেন্দ্রে বিষয়ভিত্তিক নতুন কোর্স চালু করতে হবে।
- অভিবাসীদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করতে ও সেবা সহায়তা প্রাপ্তিতে স্থানীয় সরকার, প্রশাসন ও ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রগুলোকে সচেতন করতে হবে।
- পুনর্বাসন ঋণে সুদের হার কমাতে হবে ও তা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি লাঘবের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
- সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে বা কোম্পানিতে বিনিয়োগের জন্য প্রবাসীদের সুযোগ করে দিতে হবে।
- বিদেশে থেকে দেশের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসায় বিনিয়োগে সহায়তা করতে হবে।
- এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নীতি ও অ্যাকশন প্ল্যানে অভিবাসীর পুনরেকত্রীকরণ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করতে হবে ও তা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী