শনিবার, 27 জুলাই, 2024

‘বৈসাবি উৎসব আমাদের কাছে ঈদ আর বড়দিনের মতো’

আমাদের দেশের তিন আদিবাসী জনগোষ্ঠী-চাকমা, মারমা, ত্রিপুরার মানুষেরা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার যে উৎসব পালন করে তা বৈসাবি নামেই বাকি সবার কাছে পরিচিত। এ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে সম্মোধন করে। এ উৎসবে নানারকম রীতি-নীতির পালনের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিই। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়াই বৈসাবি উৎসবের প্রধান উদ্দেশ্য। সাধারণত বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বা বৈসাবি পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।

আমরা চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বৈসাবি বা বর্ষবরণ উৎসবকে বিজু বলে ডেকে থাকি। আমরা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করি। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করি।

ফুল বিজুর দিন অরণ্য থেকে ফুল সংগ্রহ করে চার ভাগে ভাগ করে একভাগ ফুল নিমপাতার সঙ্গে বেঁধে ঘরবাড়ি সাজানো হয়। দ্বিতীয় ভাগ ফুল বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। তৃতীয় ভাগ ফুল নদী, খাল বা পুকুরের পাড়ে তৈরী পূজামণ্ডপে রেখে প্রার্থনা করা হয়। চতুর্থ ভাগ ফুল প্রিয়জনদের উপহার দেয়া এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।

মূল বিজুর দিনে ৪৫-৫০ ধরনের কাঁচা তরকারির সংমিশ্রণে পাচন তৈরী করা হয়। এছাড়া পায়েস ও নানা ধরনের পিঠা তৈরী করা হয় এবং মাছ-মাংস রান্না করা হয়। বিন্নি ধানের খই, নাড়ু, সেমাই ও পাহাড়ি পানীয়ও আপ্যায়নের তালিকায় থাকে। এই দিনে আমরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করি। এদিন ছেলেমেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় ও খেলাধুলা করে। সন্ধা ঘনিয়ে এলে বাড়ি ঘর, উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। মন্দিরে গিয়ে মোম জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়।

ছবি: ত্রয়ী চাকমা

শৈশবে আমি যেভাবে বিজু পালন করতাম

ফুল বিজু উদযাপনের জন্য আমাদের একটি রীতি ছিল-যার বাড়ি যত ফুল গাছই থাকুক না কেনো অন্যদের বাড়ি থেকে ফুল চুরি করতে হবে। যথারীতি এদিন খুব সকালে আমি ও আমার অন্যান্য সঙ্গীসাথীরা আশপাশের বাসা থেকে ফুল চুরি করে নিয়ে আসতাম। এখন বড় হয়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করি, কেনো আমরা শৈশবে পাগলের মতো ফুল চুরি করতাম! যাহোক অনেকে ফুল নিয়ে এসে নদীতে ভাসিয়ে দিত। কিন্তু আমি কখনোই তা করতাম না। ফুলগুলো দিয়ে অবশ্যই আমি আমাদের বাড়ি সাজাতাম। আর আমার দাদি নিম পাতা দিয়ে ফুল বেঁধে মূল দরজার সামনে ঝুলিয়ে দিত।

এর কারণ হলো, আমরা পরম্পরা ধরে বিশ্বাস করে আসছি যে, ফুলের সঙ্গে নিমপাতা দরজার সামনে বেঁধে দিলে কোনো খারাপ কিছু বাড়িতে প্রবেশ করবে না। অসুখ বিসুখের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাবো। ফুল বিজু ও মুল বিজু পালন করতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম হয়ে যেত। একারণে গজ্যাপজ্যা বিজুর দিন আমরা কিছুই করতাম না। ওইদিনের পুরোটা সময় আমরা বিশ্রাম নিতাম।

চার দিনে চারটি নতুন পোশাক তো লাগতোই…

ছোটোবেলায় আরেকটা জিনিস করতাম, তাহলো: অন্যরা সবাই নদীতে গোসল করতে গেলেও সকালে আমরা বাড়ির টাংকিতে গোসল করতাম। এরপর হৈহুল্লোড় করে বাকিদের বলতাম, চল বিজু ফুল খেয়ে আসি। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিত। ওদিকে বড়রা সবাই রান্নাবান্না দিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আসলে আমাদের ছোটোবেলায় খুব বেশি আনন্দমুখর ছিল এই বিজু উৎসব। যা এখনকার সময়ে চোখে পড়ে না। আমাদের সময় আনন্দ বেশি ছিল, অনুভূতিটাও কেন জানি বেশি ছিল বলে মনে হয়। আমার এখনো মনে পড়ে ছোটোবেলার প্রতিটি বিজু উৎসবে আমার নতুন জামাকাপড় লাগবেই। যেহেতু চার দিন পর্যন্ত বিজু উৎসব পালিত হয় সেহেতু আমার কমপক্ষে চারটি নতুন পোশাকের বায়না ছিল। যদিও আমি এতগুলো নতুন জামা পেতাম যে, দিনে অন্তত তিন-চারটি জামা পাল্টাতাম। এই স্মৃতি আমার এখনো মনে পড়ে।

পাচন নিয়ে পাঁচ কথা

আমাদের বিজু উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ পাচন তৈরী করা। এ খাবারটি তৈরী করতে অন্তত ৪০-৫০ ধরনের তরকারির প্রয়োজন। যা একসঙ্গে মিশিয়ে পাচন তৈরী করতে হয়। অবশ্য আমরা ছোটোরা রান্না করতাম না, শুধু খেতাম আর ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের রীতি হলো কমপক্ষে সাতটি ঘরে গিয়ে পাচন খেয়ে আসা। ঠিক যেন প্রতিযোগিতা করে সবাইকে দেখাতে হবে যে, দেখো, আমি তোমার চেয়ে বেশি ঘরে পাচন খেয়েছি। বড়দের কাছে এর মানে হলো, যে যত বেশি ঘরে খাবে, তার শরীর তত রোগমুক্ত থাকবে। এখন ওই রীতি কতটুকু পালন করা হয় তা জানি না।

ছেলেদের যা চাই-ই চাই

ছেলেরা এ উৎসবে জগরা নামের একটি পানীয় তৈরী করে, এর প্রধান উপাদান বিন্নি চাল। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি আমার নানিও এটি বানিয়ে আসছেন। এই জগরা বানানোর প্রস্তুতি নিতে হয় কমপক্ষে এক মাস আগে থেকে। চাকমা ছেলেরা আরেকটা কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে করে, তাহলো তারা নিজেদের এলাকায় অন্যের বাসায় গিয়ে নারকেল চুরি করে এবং তা যেভাবেই হোক না কেনো।

উৎসবকে ঘিরে বাবা-মার প্রধান কাজ

যেহেতু এই উৎসবের প্রধান উদ্দেশ্য পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া সেহেতু আমার বাবা-মার প্রধান কাজই যেন ঘরবাড়ির সবকিছু তন্নতন্ন করে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করা। এরপর পুরো ঘরে নতুন কাপড়, জিনিসপত্র দিয়ে সাজান তারা।

দেশের বাইরে থেকে যেভাবে বিজু উৎসব পালন করি

২০১৭ সাল থেকে আমি ভারতে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে অবস্থান করছি। ২০১৭ সালে অবশ্য দেশেই বিজু উৎসব উদযাপন করেছি। এরপর ২০১৮ ও ২০১৯ সালে একটু অন্যরকমভাবে উদযাপন করেছি। আমি নিজ হাতে রান্না করে সবাইকে দাওয়াত করে খাইয়েছি। এ উৎসব উপলক্ষে আমি তাজন্তা বানাতাম। তারপর আমি বন্ধু ও শিক্ষকদের দাওয়াত করে খাওয়াতাম। করোনার সময়ে তো চাইলেও আর সেভাবে উদযাপন করতে পারিনি। ওই সময় আমি ত্রিপুরা ছিলাম। রাঙামাটির মতো ত্রিপুরাতেও বিজু মেলা হয়, সেখানে নানা ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়।

ছবি: ত্রয়ী চাকমা (পেছনে)

বিজু উৎসব মিস করি বললে ভুল হবে!

কিশোর বয়স থেকেই আমি রাঙামাটি ছেড়ে ঢাকা ও রাজশাহীতে অবস্থান করেছি। ফলে শৈশবের মতো খুব ঘটা করে বিজু উৎসব পালন করতে পারিনি। আবার বিদেশের মাটিতে যে মনের মতো উদযাপন করতে পারছি তাও নয়। সবমিলিয়ে বাস্তবতার কারণেই হোক কিংবা অন্য যেকারণেই হোক, বিজু উৎসব খুব মিস করি একথা বললে ভুল হবে। কারণ নানাবিধ প্রয়োজনের কারণে একটা সময় শৈশবের সেই স্নিগ্ধ অনুভূতি হয়তো কারোরই থাকে না।

তবে এটা ঠিক আমার ভেতর প্রশ্ন জাগে, দেশের বাইরে বসে তো আর সাতটি বাসায় গিয়ে পাচন খেতে পারবো না। আমার জীবনসঙ্গী এখানে চাইলেই আমার সঙ্গে বিজু উৎসব পালন করতে আসতে পারবে না। কিংবা চুরি করে আনা ফুল দিয়ে আমার ঘরটি সাজাতে পারবো না। অবশ্য ছোটোবেলা ওভাবে মিস না করার আরো একটা কারণ হলো, এই ভিন দেশে আমি যাদের সঙ্গে পড়াশোনা করি, তাদের নিয়ে আমার একটা পরিবার হয়ে গেছে। আবার ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে সেহেতু আমাদের দেশের সংস্কৃতির অনেক মিল সেহেতু বিজুকে ওইভাবে মনে পড়ে না। যা কিনা ইউরোপ আমেরিকায় যারা থাকে, তারা খুব মিস করে।

এবছর আমি বিজু উৎসব পালন করতে পারবো না

এবছর বিজু উৎসব পালনের জন্য আমার যথেষ্ট ইচ্ছা, আগ্রহ ও প্রস্তুতি আছে। বাজার থেকে সবকিছু কিনেও এনেছিলাম, ইচ্ছে ছিল সবার জন্য রান্না করবো। আমার শিক্ষকের স্ত্রীর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। তিনি তার বাড়িতে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি আমাকে নতুন জামাও কিনে দিয়েছেন এ উপলক্ষ্যে। কিন্তু তা স্বত্বেও আমি আমার ক্যাম্পাসে বিজু উৎসব পালন করতে পারবো না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে বিজু উৎসব পালন করার অনুমতি দেয়নি। এর কারণ কী আমি জানি না। তবে সবার এতটুকু বোঝা উচিৎ, এই উৎসব আমাদের কাছে মুসলমানদের ঈদ আর খ্রিস্টানদের বড়দিনের মতো।

লেখক: ত্রয়ী চাকমা, বর্তমানে ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটিতে চলচ্চিত্র বিষয়ে পিএইচডি করছেন।

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা