দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা ব্যতিক্রম কাজ করতে শুরু করে। তারা আরব দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। মূলত তারা ডাক্তার, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশাগত দক্ষতার অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যারা অভিবাসন করতে চেয়েছিলো। ফলস্বরূপ, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, জর্ডান, মিশর এবং ইরাকের মতো দেশগুলি থেকে অনেক শিক্ষিত লোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। এর মধ্য দিয়ে ‘ব্রেইন ড্রেন’ নামক একটি ঘটনার সূচনা হয়।
১৯৮০ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অটোমান সাম্রাজ্যের বাসিন্দারা যখন আসতে শুরু করে, ঠিক তখন থেকেই সেখানে আরব অভিবাসনের শুরু। ১৯ শতকের শেষের দিকে, অটোমান সাম্রাজ্যের অভিবাসীরা কাজ খুঁজতে কিংবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে বাঁচতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে শুরু করে। কেননা তখন বৃহত্তর সিরিয়া থেকে অভিবাসীরা অটোমান সাম্রাজ্যকে ত্যাগ করতে শুরু করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরব আমেরিকান সম্প্রদায়ের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এসব সম্প্রদায় কিংবা গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বৈচিত্রতা। যারা উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ২২টি আরবি-ভাষী দেশ থেকে এসেছেন। আবার অনেকেই এসেছে, এখানে যাদের পূর্ববর্তী কোনো আত্মীয় ছিলো সেই সুবাদে।
১৯২৪ সালের দিকে এসে এই অভিবাসন প্রক্রিয়া খানিক ধীর হয়ে যায়। কারণ মার্কিন সরকার অভিবাসন কোটা চালু করে। এবং উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপের বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেয়। ১৯৬৫ সালে যখন আবার বাছাই করা হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই কোটা ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পায়।
এরপর আরব অভিবাসনের বেশিরভাগটাই বৃদ্ধি পায় ২০১৭ থেকে ২০১৮ সাল অবধি। প্রধানত মুসলিম দেশগুলিকে লক্ষ্য করে নতুনদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় অভিবাসন প্রক্রিয়াটা ধীর হতে শুরু করে। ২০২১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি বিদ্যমান ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। তা সত্ত্বেও পূর্বের এই নিষেধাজ্ঞাগুলিই আরব অভিবাসনকে উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর করে দিয়েছে।
১৯৮০ সালের দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে আরব অভিবাসন শুরু হয়ে ১৯২৪ সাল অবধি স্থায়ী হয়েছিলো। এ সময়ে প্রায় ৯৫ হাজার অভিবাসীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন ঘটে, যা বৃহত্তর সিরিয়া নামে পরিচিত ছিলো। এবং এটা অটোমান সাম্রাজ্যেরই একটি অঞ্চল ছিলো। এই অঞ্চলে বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ‘দ্য আরব আমেরিকানস’ এর লেখক বলেন, ‘ সর্বোত্তম চালক ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের। এটা ১৯২২ সালে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে মাউন্ট লেবাননে যে আর্থিক চাপগুলি ছিলো তার বিভাজন ঘটে।
লেবাননে রেশম উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তুঁত গাছের একটি ব্লাইট শিল্পের পতন ঘটার ফলে, অনেক রেশমচাষী অন্য দেশে কাজের সন্ধান করতে বাধ্য হয়। ফলে লেবানন এবং বৃহত্তর সিরিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে অভিবাসীরা দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ এবং রাজনৈতিক সমস্যা থেকে বাঁচতে চলে যায়। ১৯ দশকের গোড়ার দিকে, উসমানীয় সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের পাশাপাশি মুসলমানদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত বৃহত্তর সিরিয়ার খ্রিস্টানদের দেশত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক আরব অভিবাসী উত্তর-পূর্ব বা মধ্য-পশ্চিমে কাজ পেয়েছিল, দেশের প্রথম কয়েকটি মসজিদ যথা-উত্তর ডাকোটা, মিশিগান এবং আইওয়া মুসলিম আরব আমেরিকানরা তৈরি করেছিলো। অন্যরা বিক্রেতা হিসেবে কাজ করতো। সারা দেশে ঘরে ঘরে পণ্য বিক্রি করতো।
আরো পড়ুন:
জোরপূর্বক অভিবাসন এবং এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
মিশিগানে ডিয়ারবোর্নে আরব আমেরিকান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের গবেষক ম্যাথিউ জাবের-স্টিফলার বলেন, ‘১৯০০ সাল নাগাদ পেডলিংয়ে ভ্রমণের কারণে, প্রায় সব রাজ্যে একটি করে ছোটো আরব সম্প্রদায় খুঁজে পাওয়া যাবে’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরব অভিবাসন হ্রাস পেলেও অভিবাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ১৯২৪ সালের দিকে।
কারণ তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনসন-রিড আইন নামে পরিচিত একটি অভিবাসন আইন পাশ করে। এই আইনটি একটি কোটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা উত্তর এবং পশ্চিম ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসীদের পক্ষে ছিলো। এটা বিশ্বের অন্যান্য অংশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করার ক্ষমতাকে কঠোরভাবে সীমিত করে।
জনসন-রিড আইনের কোটা ব্যবস্থা চার দশক ধরে বহাল ছিলো। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরব অভিবাসীদের সংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস করে। ১৯২৪ সালে এর উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে আরব বিশ্ব থেকে অভিবাসন বছরে প্রায় এক হাজার বা তার কম লোকে নেমে আসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা ব্যতিক্রম কাজ করতে শুরু করে। তারা আরব দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। মূলত তারা ডাক্তার, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশাগত দক্ষতার অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যারা অভিবাসন করতে চেয়েছিলো। ফলস্বরূপ, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, জর্ডান, মিশর এবং ইরাকের মতো দেশগুলি থেকে অনেক শিক্ষিত লোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। এর মধ্য দিয়ে ‘ব্রেইন ড্রেন’ নামক একটি ঘটনার সূচনা হয়
আরো পড়ুন:
বিমানের আঘাতে অভিবাসী পাখির মুত্যৃর হার বেড়েছে ৪০০ গুণ
এই ব্যতিক্রমী নিয়ম ১৯৪০ সালের শেষ দিকে ফিলিস্তিনিতে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং ইসরায়েল প্রতিষ্টার দিকে পরিচালিত করে। যা কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করে। এর ফলে অনেকে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলো। ১৯৫৩ সালের দিকে শরণার্থী ত্রাণ আইন দুই হাজার ফিলিস্তিনি পরিবারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের অনুমতি দেয়। এর আগেও তারা ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে আরো ৯৮৫ ফিলিস্তিনিকে গ্রহণ করে।
১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অভিবাসন নীতিতে আরেকটি বড় পরিবর্তন অনুভব করে। হার্ট-সেলার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট, ১৯২৪ সাল থেকে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা দূর করে উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপের বাইরে থেকে আরো অনেক লোককে দেশে অভিবাসনের অনুমতি দেয়। যার ফলে আরব দেশসহ সারা বিশ্বের চেয়ে মার্কিন যুত্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়।
১৯৬৬-১৯৯০ আরব বিশ্ব থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি দেখে। নতুন আইনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে আরব। এই সময়ে প্রায় চার লাখ মানুষ আরব বিশ্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়। এদের অনেকেই ছিলো শিক্ষিত পেশাদার কিংবা ছাত্র। যারা মার্কিন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং পরে দেশে কাজ খুঁজে পেয়েছেন। অনেকেই আবার নিজ দেশের দ্বন্দ্ব থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু ছিলো। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লেবাননের গৃহযুদ্ধ থেকে উদ্বাস্তু গ্রহণ করতে শুরু করেছিলো, যেটা ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল অবধি চলেছিলো।
আরো পড়ুন:
বৈশ্বিক দুর্যোগকালীন শ্রম অভিবাসনের সুযোগ বৃদ্ধিতে কিছু সুপারিশমালা
১৯৯০ থেকে বর্তমান পর্যন্ত অভিবাসনের ঢেউ অত্যন্ত জটিল। এই সময়ের মধ্যে অনেক শরণার্থী আরব থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। নাইন/ইলেভেন হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৬ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ মুসলমানদের খুঁজতে শুরু করে, যারা সদ্য আরব দেশ থেকে এসে ছবি এবং আঙ্গুলের ছাপ জমা দিয়েছিলো অভিবাসনের জন্য। যার ফলে অনেক আরব যুক্তরাষ্ট্রে অনাকাক্সিক্ষত বোধ করতে থাকে।
কিছু সময় থেমে থাকার পর ২১ শতকে আরব অভিবাসন আবার বাড়তে থাকে। প্রতি বছর হাজার হাজার আরব অভিবাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে থাকে। ২০১৭ সালের পর আরব অভিবাসন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। যার মাধ্যমে ভ্রমণ, অভিবাসন বা সাতটি মুসলিম প্রধান দেশ থেকে শরণার্থী মর্যাদা দাবি করার ক্ষমতা কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ হয়। এদের মধ্যে রয়েছে ইরাক, ইরান, লিবিয়া, সোমলিয়া, সুদান, সিরিয়া এবং ইয়েমেন।
২০১৮ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সেই সঙ্গে উত্তর-কোরিয়া এবং ভেনেজুয়েলার প্রধান মুসলিম দেশগুলির লোকদের লক্ষ্য করে অভিবাসন নিষেধাজ্ঞার একটি সংশোধিত সংস্করণকে সমর্থন করেছে। পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার সময় এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
সূত্র: দ্য আরব