বয়স মাত্র দুই মাস। পৃথিবীর আলো-বাতাসের সান্নিধ্যে একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল শিশুটি। অথচ এই এতটুকু সময়ের মধ্যেই তার পরিচয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রহীন নামের একটি নির্মম শব্দ যুক্ত হয়েছিল। যে শব্দটি শিশুটির বেড়ে ওঠার পুরো সময়কে করেছিল প্রভাবিত এবং তা নানাভাবে। এতক্ষণ ধরে যে শিশুটির কথা বলা হচ্ছে, তার নাম রোহানা আবদুল্লাহ।
মালয়েশিয়ায় রোহানা আবদুল্লাহর ইন্দোনেশিয়ান মা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ক্লিনারের কাজ করতেন। একদিন কাজে ইস্তফা দিয়ে তিনি ফিরে যান নিজ দেশে। অন্যদিকে রোহানার মালয়েশিয়ান বাবা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান; আদৌ কোনো সন্ধান মেলেনি তার। ফলে জন্মসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কোনো নথি না থাকায় মালয়েশিয়ার আইনি দৃষ্টিতে রাষ্ট্রহীন হয়ে যায় রোহানা নামের ছোট্টো এই শিশু।
মাত্র দুই মাস বয়সে রোহানার বাবা-মা তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় এবং জন্মভূমি মালয়েশিয়াতেই রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঘটনাটি সাধারণ মালয়েশিয়ান আর ইন্দোনেশিয়ানদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল।
মালয়েশিয়ায় জন্ম নিয়ে এভাবে রোহানা আবদুল্লাহর মতো অসংখ্য শিশুর রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঘটনা নতুন নয়। দেশটির আইন অনুযায়ী, মালয়েশিয়ান কোনো বাবা এবং অ-মালয়েশীয় মা-এর বিয়ের আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র যদি না থাকে কিংবা তারা যদি তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি না করেন, তাহলে তাদের শিশু-সন্তানরা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে।
রোহানার ঘটনাটি আরো বেশি মালয়েশিয়ান এবং অন্যদের মধ্যে আলোচিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তাকে দত্তক নিয়েছিলেন একজন চীনা নারী। চি হোই ল্যান নামের এই নারী একই কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করতেন। রোহানাকে তার আসল মায়ের মতোই স্নেহ-মমতা দিয়ে একাকী বড় করে তুলেছিলেন চীনা এই নারী।
নৃতাত্ত্বিক-ধর্মীয় রাজনীতি, সন্দেহ এবং আশঙ্কার সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে ৮৩ বছরের এই চীনা নারী রোহানাকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছেন।
রোহানা আজ ২২ বছরের টগবটে এক তরুণ। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, জন্মসূত্রে পাওয়া নিজ ধর্ম ইসলামের প্রথা পালন করেই বড় হয়েছেন রোহানা। সাধারণভাবে হারিয়ে যাওয়া এই বিস্ময়কে বাস্তবে রুপ দিয়েছেন তিনি। চীনা মা ও রোহানার নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতা এবং বিশ্বাস তাদের মানবিক বন্ধনে চিড় ধরাতে পারেনি এতটুকু, বিশেষ করে রোহানার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতেও।
সত্যিই এ ঘটনা অসাধারণ ও অমূল্য। এ গল্পে নিশ্চয়ই পারস্পরিক সহানুভূতি ও সমব্যথিতার পাশাপাশি দত্তক নেওয়া একজন মায়ের ব্যক্তিগত ত্যাগ রয়েছে। আর এ সবকিছু এক ‘এতিম’ শিশুর জীবনের কঠিন চ্যালেঞ্জ বদলে দিয়েছে।
এই মা তার সবটুকু দিয়ে রোহানাকে বড় করে তুলতে সক্ষম হলেও একটি পরিচয়কে তিনি ঠেকাতে ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন। তিনি তার নিংড়ে দেয়া মাতৃত্ববোধ আর মানবিকতা দিয়ে শিশুটির ললাট থেকে আইনি শব্দে বন্দি রাষ্ট্রহীন পরিচয়টিকে মুছে দিতে পারেননি। এমনকি রোহানা স্কুল থেকেও ঝরে পড়েছিল শুধু তার ব্যক্তিগত শনাক্তকরণ কাগজপত্র না থাকার কারণে।
কঠিন এই সময়গুলোতে পাশে থাকার পাশাপাশি অন্য অভিভাবকদের মতো চি সেই দিনের অপেক্ষা করেছেন-যেদিন রোহানা বিয়ে করতে পারবে, ক্যারিয়ার গড়তে পারবে আর নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবে।
বছরের পর বছর ধরে রোহানা ও তার মা চি বুঝতে বাধ্য হয়েছে রাষ্ট্রহীনতার অর্থ উন্নত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া, ক্যারিয়ার গড়তে না পারা, সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা এবং অনাবিল আনন্দে সামিল হতে না পারা।
রোহানা ২০১৬ সালে মালয়েশিয়ায় নাগরিকত্বের আবেদন করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া পাননি।
মালয়েশিয়ার সাবেক নারী পরিবার এবং যোগাযোগ বিষয়ক উপমন্ত্রী হান্না ইয়োহ জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজাহ জৈনুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের কাছেও রোহানার সমস্যা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু হান্না ইয়োহ এর মন্তব্য, রোহানার এ দুর্ভোগ কোনো বিরল ঘটনা নয়।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, লাখ লাখ না হলেও মালয়েশিয়ায় হাজার হাজার রোহানারা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে রয়েছে। যাদের বেশিরভাগের কথাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে সংবাদমাধ্যমে আলোড়ন তোলেনি।
রাষ্ট্রহীন পরিচয়ে বেড়ে ওঠা এসব রোহানারা এখনো আগ্রহ ভরে অপেক্ষায় রয়েছে কবে নাগাদ ঘুচবে তাদের রাষ্ট্রহীনতার পরিচয়, কবে নাগাদ তারা দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারবে-আমরা রাষ্ট্রহীন নই, মালয়েশিয়া আমাদের জন্মভূমি, মালয়েশিয়া আমাদের স্বদেশ।
চি এর দেখানো মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মালয়েশিয়ার সরকার বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় পরিচয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে থাকা রাষ্ট্রহীন মানুষের সমস্যা নিরসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে।
রাষ্ট্রহীন মানুষেরা প্রতিটি সপ্তাহ, মাস কিংবা বছর ধরে অতিক্রান্ত হওয়া সময়টা মনে রাখেন। কারণ তারা প্রতি মুহূর্তে বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন।
অবশ্য একটি বিষয় খেয়াল রাখা বাঞ্চনীয় যে, প্রতিটি আলাদা ঘটনা ধরে ধরে যদি রাষ্ট্রহীনতার এই সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে তা ব্যর্থ হবে। কারণ রাষ্ট্রহীনতা নামের এই সমস্যার সত্যিকার নিরসনে দরকার নাগরিকত্বের নীতি এবং আইনের প্রয়োজনীয় বদল।
মালয়েশিয়ার সংবাদ মাধ্যম ‘আলিরান’ এ প্রকাশিত ‘স্টেটলেস ইন মালয়েশিয়া’ শিরোনামের এ নিবন্ধটি লিখেছেন মোস্তফা কে আনুয়ার। বাংলায় ভাষান্তর করেছেন বর্ষা ইসলাম